রাস্তার মধ্যে পা গ লের মত কান্না করছে চৈতি।তাও আবার কিসের জন্য? ভালোবাসার জন্য। ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে পা গ লের মত ছুটে এসেছে তার সাথে দেখা করতে।
“আরিফ আমি তোমাকে ভালোবাসি এটা তো তুমি জানো বল?”
চৈতির কথা শুনে দু পা পিছিয়ে যায় আরিফ।কিছুটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে।
“ওয়াট?আর ইউ সিরিয়াস চৈতি? তুমি আমাকে ভালো বাসতেই পার কিন্তু তার মানে এটা নয় আমিও তোমাকে ভালোবাসি।আর তুমি এই যে রাত দুপুরে যা শুরু করেছ তাতে এখন আমার মা কে সব কিছু জানাতেই হবে।”
অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে চৈতি,কিছু করার নেই তার সত্যি সে আরিফ কে ছাড়া থাকতে পারবে না, প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছে যে। চৈতি এগিয়ে এসে ঝাপটে আরিফের হাত দুখানি ধরে বলে।
“আরিফ এমন কর না প্লীজ আমি কী করব?কী হবে আমার? ভালোবাসি তোমায় অনেক বেশি। সত্যি আমি তোমাকে চাই।”
আরিফের কাছে চৈতির প্রতিটি কথা ন্যা’কামো মনে হচ্ছে,সে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে।
“উফ্ চৈতি ছাড় তো এসব।প্লীজ বাসায় চল আর নাটক ভালো লাগছে না।আর তুই যদি যেতে না চাস তাহলে আমাকে যেতে দে।”
বাড়িতে গেলেই যেন লোকটা অন্য কারো হয়ে যাবে,যেটা ভাবতেই ভেতর টা কেঁপে উঠছে চৈতির। এদিকে আরিফ আর চৈতির অপেক্ষা না করে হাঁটা শুরু করে, শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে দৌড়ে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরে চৈতি।
“আরিফ এমন কর না,, ম’রে যাব আমি। ছেড়ে যেও না আমাকে।”
এক প্রকার লাথি মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয় চৈতি কে আরিফ।
“আবার যদি এসব কিছু বলিস তাহলে খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।”
চলে গেল আরিফ,ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে চৈতি,মাটিতে বসে আছে বুকটা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। চিৎকার করে কান্না পাচ্ছে।
“আরিফফফফফফফফফ।”
পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল চৈতির, আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই ঘুমাচ্ছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এখন রাত বারোটা দেশে ফিরতে ফিরতে ছয়টা বেজে যাবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চৈতি। বাড়ির কথা মনে হতেই দম বন্ধ কর পরিস্থিতি হয়ে আসে।আরিফ চৈতির ছোট চাচার বড় ছেলে ছিল, ছোট থেকেই আরিফের প্রতি কোথাও একটা দূর্বলতা ছিল চৈতির কিন্তু এই দূর্বলতা কখন যে ভালোবাসায় বদলে গেল তা সেই ছোট্ট চৈতি টেরই পায়নি।সব ভালোবাসা তো আর পূর্ণতা পায় না ওর বেলাও ঠিক এটাই হলো। বাড়ির প্রায় অর্ধেক মানুষ সবসময় চৈতি কে বলত সে আরিফের বউ হবে তাতেই যেন চৈতি হাজারো স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।যা এখন তার দুঃস্বপ্নে পরি’ণত হয়েছে। নিজের খালাতো বোন নিপার সাথে আরিফের বিয়ে হয়েছে,মাঝে মাঝেই ওদের এক সাথে দেখা যেত কিন্তু তখন ততটাও পাত্তা দেয়নি চৈতি।সে সবসময় ভাবত খালাতো বোন দেখা করা এক, কথা বলা এটাই স্বাভাবিক কিন্তু না কিছু দিন পর এই বিষয়টা ভীষণ ভাবে ভাবায় চৈতি কে,যখন ভালোবাসা দিবসের দিন নিহা আর আরিফ কে এক সঙ্গে দেখেছিল।তার উপর নিহার হাতে গোলাপ ফুল ছিল। এরপর একদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে জানতে পারে আরিফের বিয়ে ঠিক হয়ে তাও আবার নিহার সাথে,যেটা শুনে রিতিমত আকাশ থেকে পড়ে চৈতি। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবে না চৈতি, তাই কয়েক দিন পরেই পাড়ি দেয় দূর দেশে।
________________
সকাল থেকে রান্নাবান্না নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আসিফা রহমান।এত বছর পর মেয়ে বাড়িতে আসবে তাই উনি নিজ হাতে সবটা তৈরি করবেন। ওনার হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিছে নিহা আর শান্তা রহমান।
‘ আপু তুমি বরং রান্না গুলো নিজের মত করে ফেল, আমি আর নিহা বাকি কাজ গুলো দেখছি।’
নিহা নিজের শাশুড়ি শান্তা রহমান এর কথায় সহমত পোষণ করে বলে।
‘ হ্যা বড় মা তুমি বরং এগুলো করে ফেল আমি আর মা বাকি কাজ করে ফেলব, চিন্তা কর না।’
শান্তা আর নিহার কথায় মুচকি হাসে আসিফা রহমান।
কলেজে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে নিশা,ডাইনিং টেবিলে এসে খাবার না পেয়ে চেঁচিয়ে বলে।
‘ মা মা নাস্তা কোথায় আমার? উফ্ আজকে আমার কলেজে টেস্ট আছে তো এমনিতেই এতটা লেইট হয়ে গেছে তার উপর এখন আরও,,,,
নিশা কথা পুর করতে পারল না তার মাঝখানেই আনোয়ার রহমান বলে উঠে।
‘এত তাড়া কিসের আস্তে আস্তে শান্ত ভাবে খেয়ে তার পর কলেজে যা।’
‘ না বাবা বুঝতে পারছ না আজকে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে তার উপর টেস্ট।’
মেয়ের এত চিৎকার শুনে খাবারের বাটি গুলো নিয়ে টেবিলের কাছে আসেন শান্তা রহমান।
‘ উফ্ বাবা সকাল সকাল বাড়ি একে বারে মাথায় তুলে ফেলেছিস দেখা যাচ্ছে।এই নে খেয়ে নে।’
‘ হুম দাও।’
‘ গুড মর্নিং এভরিওয়ান।’
উৎফুল্ল হয়ে বলেন আফতাব রহমান।
‘ আসুন ভাইয়া আপনিও বসে পড়ুন আর খেয়ে নিন।’
আফতাব রহমান টেবিলে এসে বসেন ঠিকই কিন্তু কিছু মুখে নিচ্ছেন না, মনে হচ্ছে কারও জন্য অপেক্ষা করছে।সবটাই লক্ষ্য করছে শান্তা, মুচকি হেসে রান্না ঘরে এগিয়ে গেলেন।কফির কাপ আফতাব রহমান এর সামনে ধরলেন আসিফা রহমান,স্মিত হাসে আফতাব। আসিফার হাতের চা না না কে দিন শুরু করা মানে নিজের বিপ’দ নিজেই ডেকে আনা।
‘ তোমরা খেয়ে নাও সবাই, আর আমাকে উদ্ধার কর।’
হেসে হেসে বলল শান্তা।কপি নিয়ে উপরে নিজের রুমে গেল নিহা। ফোনের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে আরিফ,নিহার আগমন টের পেয়ে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘ কী ব্যাপার এভাবে ভয় পেয়ে গেলে কেন?আর আমাকে দেখে ফোন রেখে দিলে যে?’
‘ কই না তো,ভয় পাব না আর ফোন রেখে দিয়েছি তার কারণ অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে তো। আচ্ছা সোনা থাক গেলাম আমি।’
নিহা কে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি আরিফ, অফিসের ফাইল গুলো নিয়ে বেরিয়ে যায়।
‘ সিফাত বাবা কী করছিস তুই এখানে?চৈতি কে এয়ার পোর্ট থেকে আনতে যাবি কখন?’
খালি গায়ে বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে ছিল সিফাত, সম্পর্কে চৈতির বড় ভাই সে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে।
‘ উঁহু মা এখনও আসেনি ও?আর আমাকেই যেতে হবে? অন্য কাউকে পাঠাও না প্লীজ।’
আসিফা রহমান কফির মগ পাশের টেবিলের উপর রেখে বিছানায় ছড়িয়ে থাকা কাপড় গুলো গুছাতে গুছাতে বলে।
‘ দেখ বাবা আরিফ অফিসে চলে গেছে আর তোর বাবা তোর চাচার সাথে কিছু ধানমন্ডির জমি নিয়ে জরুরি কথা বলছে এখন শুধু তুই আছিস,যা না বাবা মেয়েটা এত দিন পর আসছে কেন এমন করছিস? গিয়ে নিয়ে আয় না?’
‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে যাচ্ছি আমি।’
‘এই তো আমার সোনা ছেলে।’
_______________
দীর্ঘ দুই বছর পর দেশের মাটিতে পা রাখলাম, সব কিছু কেমন জানি বদলে গেছে মনে হচ্ছে,চেনে শহরটাই কেমন জানি অচেনা লাগছে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস টেনে নিলাম, আহ্ প্রশান্তি। সব কিছু বদলে গেলেও বাতাসে উড়ে বেড়ানো মিষ্টি গন্ধ যে প্রশান্তি তা তো রয়েই গেছে।
ইয়ার পোর্টে অপেক্ষা করছে চৈতি,মা কে ফোন করার পর জানতে পারল সিফাত আসছে ওকে নিতে, কিন্তু এখনও আসেনি।বার বার হাতে থাকা ঘড়িটির পানে চোখ বুলাচ্ছে চৈতি। হঠাৎ করেই পিছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরে চৈতি কে,ভয়ে আঁতকে উঠে সে। কিন্তু পিছন ফিরে তাকাতেই পরিচিত মুখ দেখতে পায়।
‘ সিফাত ভাইয়া।’
এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিফাত, ছোট্ট বোনটিকে এত দিন পর দেখে মনের ভেতরে একটা সুন্দর অনুভূতির উদয় হচ্ছে।সদরে নিজের বড় ভাই কে জড়িয়ে ধরে চৈতি।
‘ আহ্ শান্তি কত দিন পর তোর মুখ থেকে ভাইয়া ডাকটা শুনলাম বল?’
‘ উঁহু মিথ্যা কথা, তোমাকে তো রোজ ফোনে ভাইয়া বলতাম।’
‘ ধেত পা গ লী ওভাবে দূর দেশে থেকে ভাইয়া ডাকে কী শান্তি মেলে? আচ্ছা চল তাড়াতাড়ি বাসায় যাই সবাই তো তোর জন্য অপেক্ষা করছে নাকি?’
‘ হ্যা চল,কত দিন মা বাবা, বাড়ির সবাই কে দেখিনি।’
কথাটা বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চৈতি, বোনের মন খারাপ ছট করে দূর করে দেয় সিফাত।
‘ উঁহু মন খারাপ করে না রে এখন তো এসে গেছি আর কিছুটা পথ গেলেই তো বাড়ি তখন না হয় প্রাণ ভরে সবাই কে দেখিস।’
‘ হুম।’
বাড়ির পথে ছুটে চলছে গাড়ি। গাড়ির জানালা খুলে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে চৈতি, আশেপাশে কত কিছু বদলে গেছে। ফুটপাতের সেই ছোট ছোট দোকান গুলো উঠছ গিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে বড় বড় বিল্ডিং, উঁচু উঁচু দালান কোঠা।বেড়ে গেছে লোকজনের ভিড়, সৃষ্টি হয়েছে জ্যামের উপ’ক্র’ম।
____________
রুম্পা সিদ্দিক ব্যাগ গুছিয়ে তুফা কে ডাকেন।
‘ তুফা এই তুফা কোথায় তুই?
মায়ের ডাক শুনে ছাদ থেকে দৌড়ে নেমে আসে তুফা।
‘ হ্যা মা বল।’
‘ কী করছিস তুই?তোর প্যাকেজিং হয়েছে?’
রুম্পার কথা শুনে কপাল চুলকায় তুফা।
‘ উপ্স সরি,মা আমি না একদমই ভুলে গেছি হি হি।’
‘ হ্যা হ্যা তুমি তো ভুলবেই , আচ্ছা তুমি কী চাও বল তো? তুমি কী চাচার বাসায় যেতে চাও নাকি না?’
‘ওহ মা অবশ্যই আমি যেতে চাই,এত দিন পর চৈতি আসছে আর আমি যাব না এটা কী হতে পারে?’
‘ তাহলে কী প্যাকেজিং করে নাও।’
‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে এখুনি যাচ্ছি, তুমি রাগ কর না। তুমি না আমার মিষ্টি মা?’
‘ হয়েছে আর নিজের ভাইয়ের মত বাতাস দিতে হবে না। আচ্ছা ভালো কথা হিমেল কোথায়?’
‘ তুমি তো জানো ভাইয়া এই সময়ে কোথায় থাকে?’
চলবে……তোমার নামে সন্ধ্যা নামুক