শীতের এই কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল ভীষণ প্রিয় চৈতির।গায়ে সুইটার জড়িয়ে সাথে একটা চাদর নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে হাঁটতে,বলতে গেলেই একা হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ এর মধ্যেই পৌঁছে যায় রুম্পা ফুপির বাড়িতে।
শীতে কাঁপতে কাঁপতে সোফায় এসে বসেন রুম্পা, হঠাৎ কেউ পিছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরতেই আঁ’তকে উঠে উনি। পরক্ষণেই পরিচিত মুখ দেখে ,মুখে ফুটে উঠে হাসির রেখা।
‘ চৈতি মা তুই?’
‘কেন ফুপি তুমি কী ভেবেছিলে?’
‘ওহ মা তুই যে আসবি ভাবিনি রে, আচ্ছা আয় ভেতরে। তুই বস আমি তোর জন্য চকলেট নিয়ে আসছি।’
‘ না না ফুপি তুমি থাকো আমি তুফার সাথে দেখা করে আসি। কোথায় ও?’
‘ওতো উপরে নিজের রুমে আছে।’
‘ আচ্ছা উম্মাহ্।’
চৈতি দৌড়ে তুফার রুমে চলে যায়, রুমের কাছে যেতেই দেখতে পেল দরজা কিছুটা ফাঁক হয়ে আছে,ভেতরে উঁকি দিতেই দেখতে পায় গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে কেউ। গায়ের চাদর টা সোফার উপর রেখে ফট করে কম্বলের ভেতর ঢুকে গেল চৈতি, জড়িয়ে ধরল ভেতরের মানুষটিকে।
‘ তুফাআআআ কি ঠান্ডা রে বাইরে, একটু জড়িয়ে থাক বোন।’
কথাটা বলার পর কেউ যেন নিজের বলিষ্ঠ হাতে জড়িয়ে নেয় চৈতি কে, প্রথমে একটু অন্য রকম লাগে চৈতির।মনে মনে ভাবে তুফার হাত এমন লাগছে কেন তখনি কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ বলে।
‘ চড়ুই পাখি।’
ডাক টা কর্ণকুহ হতেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় চৈতি। কম্বলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হিমেল, হিমেল কে দেখে রিতিমত থ হয়ে যায় চৈতি।
‘হিমেল ভাই আপনি?’
‘ কী বলব?তুই তো আমার রুমে আসলি তার উপর এভাবে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লি।’
ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারল এটা হিমেল ভাইয়ের ঘর, এভাবে এসে ওনাকে জড়িয়ে ধরছে ভাবতেই চৈতি কেমন জানি বিব্রত বোধ করছে। কিছুটা জোরপূর্বক হেসে বলে।
‘ সরি সরি ভাইয়া আমি একদমই বুঝতে পারিনি,আসলে আমি ভেবেছিলাম এটা তুফার রুম।’
নিজের নাম চৈতির মুখে শুনে খুশি হয়েছিল হিমেল কিন্তু তা মূহুর্তেই উবে গেল ভাইয়া ডাক শুনে, নাক মুখ কুঁ’চকে ফেলে হিমেল।
‘ ঠিক আছে ঠিক আছে ,এত প্যানিক করার কিছু হয়নি।’
“হি হি হি।’
চৈতি আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না,বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। নিজের কাছে কেমন জানি লজ্জা অনুভব হচ্ছে ওর, এভাবে কাউকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল? ইশ্ ভাবতেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে।
‘ ধা’প্পা।’
পিছন থেকে তুফা এসে চৈতি কে জড়িয়ে ধরে, কিন্তু চৈতি নিজের ভাবনায় মগ্ন।
‘ কী রে কী হলো?’
তুফার কথায় ঘোর কা’টে চৈতির, সোফায় ধ’পাস করে বসে বলে।
‘ আর বলিস না কী যে করছি ভাবতেই লজ্জা লাগছে।’
তুফাও খুব উৎসুক হয়ে চৈতির পাশে বসে জিগ্গেস করে।
‘ কেন রে কী করেছিস যে এত লজ্জা পাচ্ছিস?’
একে একে হিমেলের সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছু খুলে বলে তুফা কে চৈতি,তুফা সবটা শুনে হুঁ হুঁ করে হেসে উঠল।ওর হাসি দেখে গা জ্ব’লে যাচ্ছে চৈতির।
‘ তুই হাসছিস? এদিকে আমার হাত পা কাঁপছে ভীষণ ভাবে।’
মিথ্যা হাসি থামানোর চেষ্টা করে তুফা,আর বলে।
‘ তুই যা করেছিস তার পর আর না হেসে থাকা যায়? সত্যি তুই পারিসও বটে।’
‘ আচ্ছা এসব কথা বাদ দে, আমার তোর সাথে কিছু জরুরী কথা আছে।’
‘ হুম বল কী বলবি?’
‘ না আসলে বাবা বলেছে এখানে ভার্সিটিতে এপ্লাই করতে, এখন আমি ভাবছি তুই আর নিশা তো একই কলেজে পড়িস তো ওখানেই এপ্লাই করি কী বলিস?’
‘ ওয়াও তাহলে তো ভালোই হবে,হ্যা হ্যা তুই এখানেই এপ্লাই কর তার পর তিন জন এক সাথে ভার্সিটিতে যাব।’
_________________
নাস্তার টেবিলে বসে আছে আরিফ রহমান, আনোয়ার রহমান আর আফতাব রহমান। সবাই খাওয়ার পাশাপাশি অফিসের কাজ নিয়ে আলোচনা কলছে। তারই মধ্যে বাড়িতে আসে চৈতি আর তুফা।চৈতি কে দেখে আড় চোখে তাকায় আরিফ, নিজের চোখের সামনে চির চেনা মানুষটিকে দেখে বুকের ভেতর কেপে ওঠে চৈতির।
চৈতিকে এক প্রকার কষ্ট দেওয়ার জন্য মুখে মিথ্যে হাসি নিয়ে আরিফ বলে উঠে।
‘ কী রে চৈতি কেমন আছিস?আর এত সকালে কোথায় গিয়েছিলি?’
চৈতি নিজের বাবার হাতের ইশারায় এসে ওনার পাশের চেয়ারে বসে,কিছুটা স্মিত হেসে বলে।
‘ জ্বি আরিফ ভাইয়া আমি ভালো আছি তুমি কেমন আছো?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ঘর সংসার নিয়ে অনেকটাই ভালো আছি।’
আরিফের প্রতিটি কথা বিষবানে মত বুকে এসে বিঁধছে চৈতির, তবুও সে নৈঃশব্দ্যে বসে আছে।
‘শুনছ? আজকে তোমার বড় মেয়ে আসছে।’
আসিফার কথা কর্ণকুহ হতেই ভ্রু কুঁ’চকে ফেলে আফতাব রহমান,বড় মেয়ে তানিয়ার উপর তার অনেকটা অভিমান জমে আছে। ভীষণ আদরের মেয়ে সে চেয়েছিল অনেক ভালো পরিবারে ওদের বিয়ে দেবে কিন্তু সে কী না অন্য একটা ছেলেকে ভালবাসে ।ছেলে দেখতে শুনতে খারাপ নয় কিন্তু তবুও ওনার একটা ইচ্ছে ছিল,সেই জন্য অনেক অভিমান জমেছে ওনার মনে।
চৈতি উৎসুক হয়ে বলে।
‘ সত্যি আপু আসছে?’
আসিফা রহমান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলে।
‘ হ্যা রে মা সত্যি তানিয়া আসছে।’
কত দিন পর নিজের বড় বোন কে দেখতে পাবে ভাবতেই আনন্দ লাগছে চৈতির। হঠাৎ পিছন থেকে সিফাত চৈতির মাথায় একটা চা’টি মে’রে ওর পাশের চেয়ারে বসে।নাক মুখ কুঁ’চকে নেয় চৈতি।
‘ উফ্ ভাইয়া তুমি এমন কর কেন?’
‘ চুপ কর,বাবা আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিফাতের দিকে আফতাব রহমান।
‘ হ্যা বল।’
‘ বাবা তোমার মনে হয় না বাড়িতে নতুন বউ আসা উচিত?’
ছেলের কথা কর্ণকুহ হতেই চায়ের কাপ ছিটকে পড়ে যায় নিচে,আসিফা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিফাতের দিকে, কিন্তু সিফাত এসব কিছু পা’ত্তা না দিয়ে আবারও বলে।
‘ হ্যা বাবা,বল কিছু?এই দেখো বাড়িতে মা আর নিহা ভাবি একা কত কাজ করবে বল? আমার মনে হয় এটাই সঠিক সময় আমার বিয়ে করার।’
আসিফা মুচকি হেসে রান্নাঘরে প্রস্থান করে, আফতাব রহমান গলা খাঁ’কারি দিয়ে বলেন।
‘ সিফাত তোমার কী মনে হয় না তুমি খুব নি’র্লজ্জ হয়ে যাচ্ছ?’
নির্লজ্জ শুনে হুঁ হুঁ করে হেসে উঠল চৈতি, ওর হাসি দেখে তুফাও হাসতে লাগল। ওদের হাসি দেখে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় সিফাত,ভয়ে দুজনেই গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে।
‘ তো বাবা তুমি কী বললে আমি নি’র্লজ্জ?আমি যদি নি’র্লজ্জ হই তাহলে তুমি কী?
‘ কী বললে?’
‘ সত্যিটা বললাম, আমি যদি নির্লজ্জ হই তাহলে তুমিও নির্লজ্জ। তুমি যদি নির্লজ্জ না হতে তাহলে আমি কেমনে আসতাম?চৈতি তানিয়া আপু, আমরা কোথা থেকে আসতাম?তার মানে তো তুমি,চাচা ফুপা সবাই নি’র্লজ্জ।’
ছেলের এমনতর কথা শুনে আর এক সেকেন্ডও বসে না আফতাব, তড়িগড়ি করে উঠে ফাইল হাতে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওনার পিছু পিছু আরিফও বেড়িয়ে যায়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সিফাত, টেবিলের উপর হাত হেলান দিয়ে মাথা গব্জীতে ভর দিয়ে চৈতি সিফাতের উদ্দেশ্য বলে।
‘ ভাইয়া তোমার মনে হয় না তুমি একটু বেশি আশাবাদী মানুষ?’
‘বেশী কথা বলিস না বুঝলি? না হলে কিন্তু হিমেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেব, এরপর ওর খাঁচায় বন্দী চড়ুই পাখি হবি।’
হিমেলের সাথে বিয়ে কথা শুনে নাকের পাটাতন ফুলে উঠে চৈতির,ওর এমন অবস্থা দেখে খাওয়া রেখে দাঁত কে’লিয়ে হাসছে তুফা।
চলবে….