তাঁর চোখে আমার সর্বনাশ [পর্ব-১২]

গতকাল রাত থেকেই দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি আমি।বুকের ভেতরটায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে আমার। ভীষণ রাগ হচ্ছে এই মুহূর্তে । বাকিদের চোখে যেটা নিছক হিংসে। আমার কাছে সেটা নিসন্দেহে অধিকারবোধ। এই অধিকারবোধ থেকেই আমার কাউকে খু*ন করে ফেলতে  ইচ্ছে করছে। আর যাকে নিয়ে আমার এমন সাংঘাতিক চিন্তা মাথায় এলো, সে আর কেউ না নাদিমের একমাত্র ছোটবোন ‘ইরা’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা ছয় বন্ধু। যার মধ্যে একজন হচ্ছে আমার প্রেমিক বন্ধু ‘অভ্র’। সে দাঁড়িয়ে আছে আমার ঠিক মুখ বরাবর। চোখে মুখে রাজ্যের চিন্তার ছাপ তাঁর। তাঁর চিন্তার মূল উত্তপ্তি আমার থেকেই। আমার চেহারা তখনো অমাবস্যার মতোন অন্ধকার হয়ে আছে। অভ্র এই অন্ধকার চেহারায় অসহায় চোখ রেখে, নরম কন্ঠে শুধালো-

-ফেইজবুক পাসওয়ার্ড লাগবে?

অভ্রের কথার কোনো উত্তরই আমি দিলামনা। আমার বক্ষপট থেকে তখনো দানবীয় পাথরটা নামেনি। ওর স্নিগ্ধ মুখে চেয়েও আমার এতোটুকুও মায়া হলোনা। ওর নৈকট্যে পেতেই প্রকট রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলাম ক্লাসে। কিছুক্ষণ পর বাকি পাঁচজনও আমার পেছন পেছন ক্লাসে এলো। বেঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছি আমি। মাথা তুলে সরু লোচনে আপাদমস্তক ওঁদের দেখে নিলাম।

অভ্র ব্যতিত সকলের চোখে মুখেই রাজ্যের বিস্ময়ভাব। 

-মাই গড! তুই তো সাংঘাতিক পজেসিভ মেয়ে রে,মিতু! এই সামান্য বিষয়ে এভাবে মেরে দিলি দাবাং মার্কা চর টা! আয়হায় চরের সাথে ইরার মান ইজ্জতেরও রফাদফা করে দিলি বইন!(দুই দিকে মাথা দুলিয়ে)

সিফাতের কথার জবাবে আমি গরম দৃষ্টি ওর দিকে নিক্ষেপ করতেই বেচারা মুহুর্তেই মিয়িয়ে গেলো। অসহায় মুখ করে মিনমিন করে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো-

-না মানে বলছিলাম যে চর টা আরেকটু জোড়ে দিলেও পারতি, এতো সামান্য চরে পিঁপড়ার শরীরও সটান থাকবে।

 অভ্র তখনো টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার মুখপানে । তাঁর সকল মনোনিবেশ এই মুহূর্তে আমার রনমূর্তি চেহারায়। আমার এমন রুপে ও মোটামুটি অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে। আমি যে এমন কিছু করে বসবো সেটা হয়তো ও কল্পনাই করতে পারেনি। 

-আচ্ছা হইসে তো। যে-ই বন চটকানা মারলি! আজীবন আর এমন কিছু করার দুঃসাহস দেখাইবোনা। এখন তো একটু রাগ টা কমা বাবু ।

মেঘার শান্তনা সূচক কথায়ও কোনো কাজ হলো কি-না বুঝতে পারলামনা। অভ্র এবার আমার পাশে এসে বসলো। কিছুক্ষণ আপাদমস্তক আমাকে দেখে নিয়ে নিজের কপাল চাপরে ওর ফোন টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-

-যেভাবে আমাকে কন্ট্রোল করতে পারলে তুই শান্তিতে থাকবি ওইটাই কর। তা-ও এভাবে রেগে থাকিসনা।

ওর কথায় আমার মনঃপুত হলো না। গরম চোখে ওর অসহায় মুখে চেয়ে, হাতের ব্যাগটা ওর দিকে ছুঁড়ে মেরে,চেঁচিয়ে বলে উঠলাম-

-ওর সাহস কি করে হয় তোকে আই লাভ ইউ লেখার?

আমার চেচামেচি তে বাকিরা কিঞ্চিত হতচকিত হলেও অভ্র পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছে। কোনো হেলদোল দেখতে পেলামনা ওর মধ্যে আমি। ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আমার রাগ আরো বেড়ে গেলো। এবার আমি পূর্বের চেয়েও উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম-

-এখন গিয়ে ওকে বলে আসবি তোর গার্লফ্রেন্ড আছে। 

আমার কথায় বাকিরা একসাথে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। যেনো বিরাট বড় কৌতুক শুনিয়ে ফেলেছি আমি ওদের। আমি পূনরায় অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করার আগেই অভ্র হাতের ইশারায় ওদেরকে হাসতে বারণ করলো। মেঘা বিজ্ঞের ন্যায় পূনরায় বললো-

-তোদের দুইজনের মধ্যে কি সম্পর্ক এইটা ক্যাম্পাসের সকলেই জানে। নতুন করে ইন্ট্রোডিউস করানোর প্রয়োজন নেই। আর ইরার এমনিতেও অভ্রের দিকে কু দৃষ্টি রয়েছে,সেটা অনেক আগে থেকেই। এটা তুইও জানতিস।  তবে, ইরা কিভাবে এতো দুঃসাহস নিয়ে প্রপোজ করে বসলো সেটাই বুঝতে পারছিনা। তাছাড়া তুই যেই চর টা মারলি এতে তো মনে হয় ইরার আজন্ম শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।আর আগাবে বলে মনে হয়না।

থেমে পূনরায়-

 -আর এসবে অভ্রের কোনো দোষই তো দেখছিনা আমরা। তাছাড়া ও তো বললো মেসেজটা দেখার পর ও ইরাকে তাৎক্ষণিক ব্লক করে দিয়েছে। তারপরও এমন করছিস কেনো?

আমি রাগ দেখিয়ে বললাম- 

-কেনো ওর মুখ নেই? ও কিছু বলতে পারলোনা তখন?

অভ্র জবাবে পূনরায় কপাল চাপরালো। তারপর ব্যাগটা নিচে থেকে তুলে ঝেরে টেবিলে রাখতে রাখতে বললো-

-যেসব বিষয়ে অভ্রের কোনো আগ্রহ নেই,সেসব ব্যপারে অভ্র একটা শব্দও ব্যবহার করতে রাজি নয়। আর এটা করা মানে নিজেকে ছোট করা আর ইরাকে গুরুত্ব দেওয়া। কোনো থার্ড পার্সনের জন্য এক ফোটা নেগেটিভ মনোযোগও আমি দিতে চাইনা, মিতু। ওকে আমার হ্যা,না কোনো কিছুই বলার প্রয়োজন নেই। আমার জীবনে তুই ছাড়া কোনো মেয়েরই কোনো কালেই অস্তিত্ব ছিলনা। যার কারনে ভার্সিটি লাইফের শুরু থেকেই তোর প্রতি আমার আচরণ দ্বারা আমি সকলকে আমার জীবনে তোর এক্সিসটেন্সের ব্যাপারে আগাম জানান দিয়ে দিয়েছি। তারপরও কেউ যেচে চর খেতে চাইলে তো তুই আছিস ই(দুষ্টু হেসে)

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলো অভ্র। ওর কথায় এবার মনে হয় আমার হৃদয়ের বরফের পাহারটা একটু একটু করে গলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ ছলছল চোখে ওর স্নিগ্ধ মুখে তাকিয়ে আমি ঠোঁট উল্টে বলতে লাগলাম-

-আমার খুব কান্না পাচ্ছে অভ্র। আমি এতো হিংসুটে কবে থেকে হলাম? ওকে ওভাবে থাপ্পড় মারা টা বোধহয় আমার উচিৎ হয়নি!

অভ্র মৃদু হেঁসে জবাব দিল-

-তুই বড্ড বোকা রে মিতু! আমার তোর এমন বোকা বোকা রুপটাই ভীষণ পছন্দ! সারাজীবন এমন বোকা বোকা কাজ করে আমাকে এন্টারটেইন করার দায়িত্ব কিন্তু তোর। বুঝলি?

বাসায় ফিরতেই দেখতে পেলাম আম্মু তড়িঘড়ি করে ঘর পরিস্কার করা, ঘর গুছানো শুরু করে দিয়েছে। এতো আয়োজন দেখে আমি হতভম্ব হলাম। জানালার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদরটা পর্যন্ত নতুন বিছানো হয়েছে। বাসায় ঢুকে কিছুক্ষণ হতচকিত চোখে সবকিছু দেখতে লাগলাম। আমাকে দেখামাত্রই আম্মু আমাকে টেনে নিয়ে নিজে নিজেই আলমারি থেকে কয়েকটা শাড়ী বের করে শুধালো-

-দেখ তো কোনটা বেশি ভালো লাগছে?

কোনোরকম পাল্টা প্রশ্ন না করে আমি ক্লান্ত মুখে জবাব দিলাম-

-নীল টা।

 আম্মু হাসিখুশি মুখ করে মিনমিন করে বলতে লাগলো-

-আমারো এটাই ভালো লাগছে। ওহহ,তাহলে তো ব্লাউজ টা আরেকটু ফিটিং করতে হবে।

আমি কিছুক্ষণ ভ্রু বাঁকিয়ে আম্মুর যাওয়ার পথে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে পূনরায় আমার রুমে চলে গেলাম।

দুপুরে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে রাত দশটায় আমার ঘুম ভাঙলো অভ্রের ফোনে। আমি ঘুমুঘুমু কন্ঠে বললাম-

-হ্যালো।

-ইশশ! কি আদুরে কন্ঠ রে তোর! কন্ঠস্বর খাওয়ার কোনো স্কোপ থাকলে তোর বলা প্রতিটা শব্দই ব্লান্ডার করে জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলতাম আমি! এতো মধু মধু লাগে কেনো তোকে?

ওর কথায় শব্দ করে হেঁসে ফেললাম আমি। তারপর অস্পষ্ট গলায় শুধালাম –

-কি করছিস?

-তোকে মিস করছি।

অভ্রের দায়সারা জবাব

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভ্র পূনরায় বলতে শুরু করলো-

-একটা গুড নিউজ আছে!

আমি কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

-কি গুড নিউজ?

-আমার কানাডা’র ভিসা হয়ে গিয়েছে। আর কিছুদিন পর অনার্সটা শেষ করেই চলে যেতে পারবো।

ওর কথায় আমি থম মেরে বসে পরলাম। আমার মাথার উপর যেনো আকাশ ভেঙে পরলো। আমাকে চুপ থাকতে দেখে অভ্র পূনরায় বললো-

-তুই খুশি নস?

-তুই কানাডা’র জন্য পেপারস জমা দিয়েছিলি আমাকে আগে বলিসনি কেনো?

-বলিনি কারন এসব নিয়ে আমার কোনো হেলদোল ছিলনা ট্রাস্ট মি। আর পেপারসগুলোও ভাইয়াই জমা দিয়েছিল,আমি এসবের কিছুই জানতাম না। তোর বাপ আবার প্রতিষ্ঠিত ছেলে ব্যতিত মেয়ে দেবেন না। তোর বাপের তো আবার বড় বড় দেশে থাকা ছেলে খুব পছন্দ।  তা-ই ভাবলাম তোকে পাওয়ার জন্য এতোটুকুও বিসর্জন দেওয়াই যায়। 

আমাকে পূনরায় চুপ থাকতে দেখে ও হয়তো আবার বুকের ভেতরে বয়ে চলা ঝরের মাত্রাটা আচ করতে পারলো। এবার অভ্র কোমল কন্ঠে শুধালো-

-আমাকে পাওয়ার জন্য এতোটুকু দূরত্ব সহ্য করতে পারবি না,মিতু? 

আমার চোখ বেয়ে আপনাআপনি জ্বল গড়িয়ে পরতে লাগলো। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম-

-বাসায় কবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছিস?

অভ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিল-

-আর মাত্র কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। কোনোরকম ঝুঁকি নিয়ে আমি দেশ ছাড়ছি না। আপনার প্রতি সকল অধিকারের লিখিত বৈধতা নিশ্চিত করেই আমি বিদেশে পারি জমাচ্ছি, ম্যাডাম। 

থেমে-

-এসব নিয়ে তোকে কোনো রকম প্রেশার নিতে হবে না। তোকে মানায় শুধু খিলখিলে হাসিতে,টেনশনে নয়। আর তোকে সবসময় হাঁসানোর দায়িত্ব শুধুই অভ্রের,বুঝলি?

অভ্রের আদুরে শান্তনায় আমি শব্দ করেই হেঁসে ফেললাম। মনে মনে এটা ভেবে নিজেকে দমিয়ে রাখলাম, নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে অনিচ্ছা থাকার সত্বেও যে  নিজের দেশ,নিজের মানুষদের ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো দেশে একা একা বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে,তার বিসর্জনের কাছে আমার ওর জন্য দেশে বসে অপেক্ষা করার বিসর্জন কোনো বিসর্জনই না। অন্তত আমি নিশ্চিত হলাম এই মানুষটা আমার রইলো!অন্তত তাঁকে আমার আজন্ম হারিয়ে ফেলার কোনো আফসোস নিয়ে বেঁচে থাকতে হবেনা! যদি পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করে অপেক্ষা করা যায় তবে সে অপেক্ষাতেও রয়েছে স্বর্গীয় সুখ!

চলবে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *