রঘুদা

 আজকের গল্পটা আমি আমার রাঙা কাকুর কাছ থেকে শুনেছি | তিনি আজ নেই, তাঁর সেই বলা ঘটনাটিকেই সাজিয়ে নিয়ে লিখলাম |

 আজ অনেক বছর হলো, সালটা ছিলো ১৯৭৮, গ্রাম বাংলার পরিবেশ টাই ছিলো এক্কেবারে অন্যরকম | বড় বড় বহুতলের জায়গায় ছিলো পুকুর বাগান মাঠ ,আর পিচ ঢালা রাস্তাও ছিলো খুব কম | এত আলোর ঝলমলে রোশনাই বা ছিলো কোথায় ? তখন বৰ্ধমান জেলা টাও ছিলো অভিন্ন, পূর্ব বর্ধমান- পশ্চিমবর্ধমান বলে কিছু ছিলো না | সেই বর্ধমান জেলার একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম শঙ্খনগর | আমার তখন বয়স চব্বিশ বছর, বিভিন্ন জায়গায় চাকুরীর এ্যপ্লিকেশন করছি তো করছি | আমি শহরের ছেলে, শহর কোলকাতার মানিকতলার ছেলে

আমি, যাই হোক অবশেষে কয়েক ডজন পরীক্ষা দিতে দিতে যখন প্রায় ক্লান্ত তখন হঠাৎ ভাগ্যের শিকেটা ছিঁড়লো বটে, তবে  পুরো ছিঁড়লো বলবো না, কোনো মতে ছিঁড়ে যেন উপড়েই আংটায় ঝুলে রইল আর কী, সমস্ত ইন্টারভিউ শেষে পোষ্ট মাস্টারের চাকরীটা আমার হলো বটে তবে বর্ধমান গ্রামের একেবারের শেষ প্রান্তে সেই শঙ্খনগর গ্রামের এক অখ্যাত গঞ্জের কাছে, তখনও চাকুরীর আকাল ছিলো বটে তবে বর্তমানের মত এত তীব্র ত্বর নয় | নতুন চাকুরী বলে কথা, ফুর ফুরে মনে অনেকস্বপ্ন নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে উপস্থিত হলাম চাকুরীস্থলে | স্বপ্নময় চতুর্দিক, সবুজের গাছগাছালি ভরা বিস্তীর্ণ শস্য ভরা আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, বাঁশের শাঁকো, আমগাছের নীচে আম বাগানে বাঁশের মাচা, ছোট বড় পুকুরে মাছ রাঙার ব্যস্ততা, ছোট্ট ছোট্ট প্রায় অর্ধ উলঙ্গ শিশুদের দৌড়োদৌড়ি, রাখাল বালক ,লাঙল কাঁধে চাষী, বাঁশবাগান এক কথায় কল্পিত গ্রামের  স্বপ্নসুন্দর সকল উপকরণ এখানে বিদ্যমান | 

মন্দ লাগছিলোনা এসব | গাড়ির হর্ণের একটানা কর্কশ শব্দ নেই, কংক্রিটের জঙ্গল নেই, পার্টি পলিটিক্সের কচকচানি নেই, আছে কেবল অনাবিল আনন্দ আর সামান্ন প্রাপ্তিতেই পরম তৃপ্ত কিছু নিখাদ সরল মানুষ | তথা কথিত শিক্ষাদীক্ষায় হয়তো এরা কিছুটা পিছিয়ে, কিন্তু জীবনের প্রকৃত মূল্যবোধে, সততায়, সরলতায় একে অপরের প্রতি কর্তব্য বিশ্বাসে এরা অনেক-অনেক এগিয়ে | স্টেশনের কাছেই কিছু টিন টালির ছাউনি দেওয়া দোকান , আর একটি এ্যাসভেস্টর ছাউনি দেওয়া নতুন পোষ্ট অফিস | কাজ কর্ম সারাদিন বিশেষ কিছু নেই বললেই চলে, আমার সহকর্মী বলতে বছর চল্লিশ বয়সের রঘুদা, রঘু দা পিওন, তারও কাজের চাপ সেই রকমই আর কি, ঐ রঘুদার দৌলতেই কোনো মতে একটু অবস্থাপন্ন

এক চাষীর বাড়ীর বাইরের দিকের একটা ঘর ভাড়ায় পেলুম, আমি একা মানুষ, সঙ্গে লট বহর বলতে তেমন বিশেষ কিছুই নেই,

একটা হোল ডোল আর টিনের একটা বড় বাক্স | সত্যি বলতে কি আমার আপদে বিপদে আমার ছোটখাটো নিজস্ব দরকারেও আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ,আমার একমাত্র ভরসা হয়ে উঠেছিলো সেই রঘু দা | পদ মর্যাদার গন্ডি আমাদের মধ্যেছিলো না | বয়সে আমার চেয়ে বড় হলেও আমরা দুজন ছিলুম দুজনের খুব বন্ধু | ঐ গ্রামে সকলে রঘুদা কে বেশ ভালবাসতো | বেশ হাসি খুশি মানুষ এই রঘুদা, একদিন হঠাৎ দেখলাম রঘুদা কেমন চুপচাপ, এমন চুপ তো রঘুদাকে কোনো দিন দেখি না, জিজ্ঞাসা করলাম, কি হলো রঘু দা? আজ কি বাড়ীতে বৌদির সঙ্গে ঝগড়া টগরা করে এসেছো নাকি? প্রথমটায় কোনো উত্তর দিলোনা রঘু দা, আমি বল্লুম তা যাকগে | ছাড়ো বাড়ীর চিন্তা, তুমি বরং কালুর দোকান থেকে ঐ চা আনার গ্লাসটা করে আমাদের দু-জনের জন্য একটু চা নিয়ে এসো দেখি | চা পেটে গেলে

দেখবে মন একদম ফুর ফুরে হয়ে যাবে | রঘু দা যন্ত্রের মত উঠে জানালার  তাকে রাখা গ্লাসটা নিয়ে চা আনতে বেড়িয়ে গেল | আমি আমার কাজে মন দিলাম, খানিক বাদে চা নিয়ে ঢুকলো রঘুদা, তারপর দুজনের দুটি কাপ জল ধোয়া করে তাতে চা ঢেলে আমাকে এক কাপ দিয়ে ঘরের কোনের টুল টায় নিজের চা টা নিয়ে বসলো | চায়ে চুমুক দিয়ে রঘু দার দিকে চেয়ে মনে মনে ভাবছি, কিছুতো একটা হয়েছে বটেই, মনে হচ্ছে কোনো একটা কথা যেন রঘুদা আমায় বলতে চেয়েও বলতে পারছে না , আমতা আমতা করছে | নীরবতা ভঙ্গ করে আমিই রঘু দাকে বল্লুম, রঘুদা তুমি কি আমায় কিছু বলবে? আমার কি জানি কেন মনে হচ্ছে তুমি আমায় কিছু বলতে চাইছো | রঘু দা এবার বল্লে মাস্টামশাই ছেলেটা এবার দশকেলাসের বড় পরীক্ষা দেবে, পরশু ওর ইস্কুলে পরীক্ষার টাকা জমা করার শেষ দিন, অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু টাকাটা কোথা থেকেও জোগাড় করে উঠতে পারিনি, টাকাটা জমা দিতে না পারলে পরীক্ষায় বসতে পারবে না | আমি হেসে বল্লুম ওঃ এই ব্যাপার, রঘু দা তুমি না আমার বন্ধু, এই তুমি আমার বন্ধু! পকেট থেকে মানিব্যাগ টা বাড় করে একটা একশ টাকার নোট বাড় করে রঘু দার হাতে দিয়ে বল্লুম সমস্যা খতম | এই নিয়ে  চিন্তা ! তুমি কিন্তু ভীষন অন্যায় করেছো, এটা তো আমায় একবার বলতে পারতে, যাও তুমি এখনই একবার বাড়ী যাও ,আমি এ দিকটা সামলে নেবক্ষন, আজতো চিঠি বিলির তেমন চাপ নেই, তোমার বাড়ি যাবার পথেই ঐ পাঁচটা চিঠি-সোনা গ্রামের আছে, ঐ কটা দিয়ে যাও, সোনা গ্রাম তো তোমার বাড়ী যাবার পথেই পরবে | রঘু দা ছল ছল চোখে মুখ তুলে একবার চাইলে আমার দিকে, তারপর ধীরে ধীরে বল্লে, মাষ্টামশাই আপনাকে কী করে বলি, আগের দু- শো টাকা টাও এখনো দিয়ে উঠতে পারিনি তার উপর … |আমি থামিয়ে দিয়ে বল্লাম, থামতো তুমি, যাও, রঘু দা কাঁদো কাঁদো স্বরে বল্লে, মাষ্টামশাই আপনি যে আমার কত বড় উপকার করলেন, আমি জীবনেও ভুলতে পরবো না | আমি যেমন করেই হোক আপনার দেনা আমি ঠিক শোধ করে দেব | আমি একটু গম্ভির হয়েই বল্লাম , থামো, যখন খুশি ফেরৎ দিও ক্ষন | আমি যাচ্ছি মাষ্টারমশাই | রঘু দা সেদিন চলে গেল| আমি মনে মনে ভাবলুম শহরের কত মানুষ কত কত টাকার পাহাড়ে বসেও চুরি করছে লোক ঠকাচ্ছে কত বাজে পথে টাকা ওড়াচ্ছে, আর এরা, উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও সৎভাবে সংসার চালাতে নাভিশ্বাস তুলছে |

পরের দিন দেখলাম রঘু দা এলো না | তিনদিন বাদে রঘু দার ছেলে এসে খবর দিয়ে গেল, বাবার খুব জ্বর, তাই আসতে পারছে না |

আমি বল্লাম,তাই নাকি, ডাক্তার দেখিয়েছো? ছেলেটি বল্লো, মা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গেছে | আমি স্কুলে যাচ্ছি, দুটো টাকা জমা দেবার ভেট চলেগেছে, আজ শেষ তারিখ …..

আমি যাই, ছেলেটি আমায় একটা ঢিপ করে প্রনাম করলো | আমি বল্লাম, আরে- আরে করছো কী !! সাবধানে যাবে , কোনো চিন্তা কোরো না | বাবা কেমন থাকে জানিও | ছেলেটি ঘাড় নেড়ে চলে গেল | ভাবলুম রঘুদা বয়সের তুলনায় একটু বেশী- ই বুড়ো হয়ে গেছে | শুনেছি, এখান থেকে বাড়ী ফিরে আবার বাড়ী বসে বিড়ি বাঁধে, বাবা-মা বউ বাচ্চা নিয়ে পাঁচটা পেট | এই সামান্য বেতনে …. | ভীটেটুকুই সম্বল | কত কষ্টেই না দিন কাটায় | আরও তিন দিন পার হয়ে গেল,

কোন খবর পাইনি রঘু দার, অফিস টেবিলে বসে এমন সাত-পাঁচ ভাবছি, হঠাৎ এমন সময় রঘুদা ঢুকলো | আমিতো অবাক, তার সেই প্রসিদ্ধ ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তোলা সাইকেলের আওয়াজ পেলাম না তো! দেখি মিটি মিটি চোখে রঘু দা হাসছে | শান্ত গলায় বলে উঠলো কি মাষ্টামশাই অবাক হয়ে গেলেন? হ্যাঁ, অবাক তো হয়েছি বটেই ,তুমি এলে কিসে ?! তোমার ছেলে আমাকে তোমার খবর দিয়ে যাবে বলে ছিলো, সেও এলো না, তাই ভেবেছিলুম রবিবার দিন তোমার বাড়ীতে এক বার যাবো | না- না তার আর দরকার হবেনা মাষ্টামশাই, আজ কিন্তু আমি কাজে আসিনি, আজ এসেছি আপনার দেনা শোধ করতে, রঘুদা ফতুয়ার পকেট থেকে গুনে গুনে কয়টা এক শো টাকা বার করে বল্লে, মাস্টা মশাই, দয়া করে টাকাটা রাখুন | আমি বল্লাম এই মাসের শেষে র দিকে এক সাথে এত গুলো টাকা ফেরৎ দিচ্ছ তোমার অসুবিধা হবেনা ?! রঘুদা মুচকি হেসে _ বল্লে

,না মাষ্টামশাই এখন না দিতে পারলে আর কখন ও যদি না দিতে পারি, উপকারীর উপকার ভুলতে নেই, দেনা মাথায় নিয়ে মরে ও যে শান্তি পাব না | রঘু দা তুমি থামবে, কবে থেকে আসছো সে কথা বলো ? আসবো আসবো আগে টাকাটা রাখুন তারপর দেখছি, আসার আগে ছেলে এসে আপনাকে ঠিক জানিয়ে যাবে | বড় দুর্বল হয়ে গেছি, কালাজ্বরতো | একটা অনুরোধ মাষ্টামশাই আমার যদি কিছু একটা ভালো মন্দ হয়ে যায় ছেলেটাকে একটু দেখবেন | আমারি মত অস্থায়ী কর্মী হিসাবে একটা ব্যবস্থা করে দেবেন | খুব বাধ্য ছেলে আমার |

আমি বল্লাম ধুৎ, অতো চিন্তা করছো কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ তবে আমি চলি মাষ্টামশাই বড় কষ্ট হচ্ছে | আমি বল্লাম হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি সাবধানে বাড়ী যাও | রঘু দার মধ্যে কেমন একটা চঞ্চলতা দেখলাম, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আমি আর কী বলি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম | মাসের শেষ আমারও পকেটের অবস্থা ভালো নয়, রঘুদার দেওয়া টাকা কটা মানিব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে বাইরের খোলা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম, ভাবছি এত গুলো টাকা রঘু দা পেল কোথায় ! হয়তো কারো কাছে ওষুধের জন্য ধার করেছে। ভেতরের গুমোট গরম থেকে বাইরের হাওয়াটা বেশ ভালো লাগছে | হঠাৎ দেখি, রঘুদার ছেলে এদিকে হেঁটে আসছে সমবয়সি আর একজন কে সঙ্গে নিয়ে, রঘু দার ছেলের বেশ ভূষা দেখে আমি চমকে উঠলাম, ও মুখাগ্নির পরের ধরা ধারণ করেছে কেন! রঘু দার ছেলে বসন্ত আমার কাছে এসে হাউ হাউ করে কেঁদে বল্লে মাষ্টামশাই বাবা আর নেই | কি বলছো কি বসন্ত !! বসন্তের সঙ্গে আসা ছেলেটি আমায় বল্লে গত পরশু দিন রঘু কাকু যার বাড়ী থেকে মশলা পাতা এনে বিড়ি বাঁধতো, তার বাড়ী কাকীর হাজার বারন সত্ত্বেও যায়, বাঁধা বিড়ি দিয়ে টাকা আনতে, বিড়ি দিয়ে টাকা নিয়ে বাড়ী ফিরে আসার সময় গাজন তলার মাঠের ধারে মাথা ঘুরে পড়ে যায়, গ্রামের সত্যেন কাকা হাট থেকে ফেরার পথে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে গাঁয়ের সকল কে খবর দেয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে যেতে সব শেষ | বসন্ত বল্লো, আগামী ১৫ তারিখ বাবার কাজ, আপনি বাবার খুব কাছের লোক ছিলেন একটি বার দয়া করে আসবেন আমাদের বাড়ী | আমি তখন নির্বাক পাথর মূর্তি | আজ আমি কর্ম জীবন থেকে অবসর নিয়েছি | বিগত দিনের স্মৃতি রোমন্থনের সময় রঘু দাকে বড্ড বেশী করে মনে পরে | কত সৎ ছিলো গ্রামের ঐ সরল মানুষটা |

  • রঞ্জন ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *