তোমার নামে সন্ধ্যা নামুক [পর্ব-১১]

সুন্দর আবহাওয়া, মাঝে মাঝে রোদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে সূর্য মামা,এই শীত কাল প্রায় অধিকাংশ মানুষের প্রিয়, ঠিক তেমনি চৈতিরও শীত কাল ভীষণ পছন্দ।চাদর গায়ে দিয়ে কুয়াশা মাখা সকালর পরিবেশ উপভোগ করার মধ্যে এক অন্য রকম সুখানুভূতি পাওয়া যায়,তার বর্ণণা করা সম্ভব নয় যদি তা নিজে অনুভব না করা হয়।

কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বাড়িতে ফিরে আসে চৈতি,ছাদে উঠে যায়, গিয়ে দেখতে পায় তার আগেই অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

ব্ল্যাক জ্যাকেটে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল, নিজের চড়ুই পাখির আগমনে দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করে তার পানে।চৈতি হিমেল কে দেখে দু পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘ আপনি এত্ত সকালে এখানে?’

‘ ইয়েস চড়ুই পাখি, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।’

‘ আমার জন্য? কিন্তু কেন?’

‘‌নিয়ে যাবো তাই।’

‘ কোথায় যাবো?’

‘ আমাদের বাড়িতে,মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বুঝতে? এভাবে সবাই কে অপেক্ষা না করিয়ে চলুন এবার।’

‘ কিন্তু মা?’

‘ আমি মামী কে বলে দিয়েছি যে তুমি আমাদের ওখানে যাচ্ছ,তাই এত্ত কথা না বাড়িয়ে গিয়ে রেডি হয়ে আসুন।’

চৈতি নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়, এদিকে সিফাত বাড়িতে এসে সবাই কে নিচে আসার জন্য বলে। হঠাৎ সমাবেশ বসানোর কারণ খুঁজে পায় না কেউ।আসিফা রহমান শান্তা রহমান,আর আনোয়ার রহমান এবং আফতাব রহমান,নিহা তানিয়া সবাই নিচে আসে।আফতাব রহমান সিফাত কে উদ্দেশ্য করে জিগ্যেস করেন।

‘ কী হয়েছে সিফাত হঠাৎ এভাবে ডাকলে যে?’

আসিফাও একই প্রশ্ন করেন।

‘ হ্যা বাবা কিছু কী হয়েছে বল আমাদের?’

সিফাত ফুস করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলে।

‘ আমি একটা মেয়ে কে পছন্দ করি, অনেক দিন ধরে।ওরা তেমন বড়লোক নয়, ওর বাড়িতে শুধু ওর মা আছে , বাবা ছোট বেলায় মা’রা গেছে।ওর নাম আরুহী, একজন স্কুল শিক্ষক। আমি ওকে বিয়ে করব মানে করবই, অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছি তো এখন তোমাদের আমার কথা মানতেই হবে।’

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে শেষ করে সিফাত, সবাই ওর দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। সিফাত এবার একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ালো আবার বলে।

‘ কী হয়েছে? তোমরা এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

সিফাতের এমন বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে ফিক করে হেসে উঠে বাড়ি সুদ্য লোক। আফতাব রহমান আনোয়ার রহমান সোফায় গিয়ে বসে,নিহা ওদের জন্য চা নিয়ে আসতে যায়।আসিফা রহমান ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে বলে।

‘পাগল ছেলে আমার।’

উনিও গিয়ে বসেন সোফায়, ওনার পাশে গিয়ে বসে শান্তা।

‘ কী হলো বাবা মা?কেউ কী কিছু বলবে না?’

আফতাব হালকা হেসে বলেন।

‘ আমরা তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম যে তুমি কী কাউকে পছন্দ করো? এখন তো দেখা যাচ্ছে তুমি নিজেই সব কিছু বললে তাহলে আর আপত্তি কিসের?’

সিফাত নিজের বাবার পায়ের কাছে এসে বসে বলে।

‘ সত্যি বাবা? তাহলে তোমরা আরুহীর সাথে বিয়ে দেবে?’

আনোয়ার সিফাতের কথা শুনে হুঁ হুঁ করে হেসে উঠে,আর বলেন।

‘ আরে বাপ বুঝতে পারলি না তোর বাবা রাজী,আর হ্যা আরেকটা সিক্রেট কথা শুন।’

‘ কী সিক্রেট কথা চাচ্চু?’

হিমেল আর চৈতি এক সঙ্গে বসার ঘরে আসে,চৈতি সিক্রেট কথা শুনে কথাটা জিজ্ঞেস করে।

‘ আরে চৈতি মা,আয় বস বলছি তোদের বাবার কথা।

ওদের মধ্যে আফতাব রহমান বলে উঠেন।

‘‌দেখ ছোট দয়া করে মান সম্মান খেয়ে ফেলিস না?’

আনোয়ার রহমান আবারও হুঁ হুঁ করে হেসে বলেন।

‘ তোরা কী জানিস তোদের বাবা মানে ভাইয়া লাভ ম্যারেজ করেছে?’

মা বাবা লাভ ম্যারেজ করেছে শুনে অবাক হয় চৈতি ও সিফাত, ওদিকে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে হাসছে হিমেল।চৈতি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘ সত্যি চাচ্চু?কী বাবা তুমি আর মা লাভ ম্যারেজ?’

আনোয়ার রহমান বলেন।

‘ তাহলে আর বলছি কী?কত যে কাহিনী আছে,বলার মতো না।’

নিহা সবার জন্য চা নিয়ে আসে এবং দুজনের জন্য কফি।একে একে সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে হিমেল ও সিফাত কে কফি দেয়।ওরা বরাবর কফি খেতে পছন্দ করে, আফতাব স্মিত হেসে বলে।

‘ কী আর বলব রে মা? তোদের দাদু তো অনেক আগেই মা’রা গেছে এরপর আমি মা কে নিয়ে থাকতাম তখন আমাদের গ্রামের এক মেয়ে কে পছন্দ করি আর সেই হলো আসিফা, কিন্তু তোদের দাদী এটা মানতে পারে না অনেক বুঝিয়ে কষ্ট করে রাজী করিয়ে আমাদের বিয়ে হয়েছে। বলতে যতটা সহজ হচ্ছে জার্নিটা ওতটা সহজ ছিল না, এখনও তোদের দাদী আসিফা কে তেমন একটা পছন্দ করে উঠতে পারেনি।’

‘‌ওয়াও এত্ত বড় লাভ স্টোরি।’

‘ হুম। আচ্ছা তাহলে কাল না হয় আমরা সিফাতের হবু বউ কে দেখতে যাবো?’

আসিফা বলে।

‘ হ্যা ঠিক বলেছো,চল শান্তা আমরা সব কিছু গুছিয়ে নেই।’

‘ হ্যা আপা চলো।’

সিফাত ভীষণ খুশি হয়ে নিজের বাবা কে জড়িয়ে ধরে, সত্যি ভাবতে পারছে না সব কিছু এত সুন্দর করে হয়ে যাবে। মনে মনে আল্লাহকে শুকিয়ে জানায় সিফাত।

_____________

পার্কের বেঞ্চে একা বসে আছে নিশা, মন খারাপ তার কিন্তু তা বুঝার মানুষটি পাশে নেই। সত্যি হয়তো একটু বেশী স’স্তা করে ফেলেছি নিজেকে। কী চেয়েছিল?শুধু একটু ভালোবাসা তাতেই হতো আর কিছু চাই না। কিন্তু তাও পেলো না।

ভেতর থেকে এক রাশ দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে, রোদের মধ্যে হঠাৎ কারো ছায়া এসে সামনে দাঁড়ায়, চোখে তুলে দেখে ইশান। ওকে দেখা মাত্র নিশার নয়ন ভরে উঠে,তাকাতে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। সত্যি আর কখনও ভালোবাসা চাইবে না সে,যাই হয়ে যাক।

‘ কী হলো নিশা?ওই মেয়ে কোথায়? আমি যে বললাম দেখা করতে তার কী নিজের প্রশ্নের উত্তর চাই না?’

নিশা ফুস করে শ্বাস নিতে বলে।

‘‌না লাগবে তার,সেই মেয়ে আর জানতে চায় না ।’

‘ ইশ্,এত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে গেছে বুঝি?’

নিশা আর কিছু না বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল, পার্ক থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইশান ওর হাত ধরে এক টানে নিজের বাহুতে নিয়ে আসে।নিশা মৃদু স্বরে ‘উফ্’বলে উঠে।ইশান এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে নিশা, কিন্তু বেশিক্ষণ পারেনি ওই চোখে যে নিশার স’র্বনা’শ লেখা আছে।

‘ হাত ধরলেন যে?’

ইশান স্মিত হেসে বলে।

‘ দুদিনেই শেষ? একটু অপেক্ষা করলে হয়তো মেয়ে ভালোবাসা পেয়ে যেত কিন্তু তার তো ধৈর্য নেই।’

নিশা নিচের দিকে তাকিয়ে বলে।

‘‌লাগবে না তার ভালোবাসা, আপনি বরং ওই ভালোবাসা রেখেই দিন।’

‘ উঁহু।’

ইশান নিজের মুখে নিশার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে।

‘ মেয়ে কে বলে দিও,তাকে এই ছেলে নিজের আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা থেকে এক চিলতে নয় মহাকাশ সম ভালোবাসা দিতে রাজী আছে।’

নিশা ইশান এর কথা শুনে চোখ তুলে তাকায়, কেমন জানি লজ্জা লাগছে ভীষণ ভাবে। ইশ্ ওই চোখে তাকিয়ে থাকার মত সাহস হয়নি এখনও।

‘ হাত ছাড়ুন বাড়ি যাবো।’

‘ গাড়িতে বসো পৌঁছে দিচ্ছি।’

আরুহী একটা কথাই ভাবছে সে যা করছে বা করতে চলেছে তা কী ঠিক হচ্ছে? না আর চুপ থাকা যায় না সব কিছু খুলে বলা উচিত সিফাত আর ওর ফ্যামিলি কে। আমি চাই না ওরা একটা মিথ্যা নিয়ে থাকুক,যদি এখন আমার ওর বিয়ে হয় হঠাৎ করে একদিন আমার অতীত জেনে যায় পরে তো আমাকে মেনে নেবেই না উল্টো অনেক কিছুর মুখমুখি হতে হবে।

কথা গুলো ভাবছিল তার মধ্যে ঘাড়ে কারো কোমল স্পর্শ পেয়ে পিছন ঘুরে দেখে রোশনা বেগম দাঁড়িয়ে আছে।

‘ মা তোমার কী মনে হয় আমি ভুল করছি?’

রোশনা বেগম মেয়ের কথা শুনে মুচকি হেসে আরুহীর মাথায় হাত রেখে বলে।

‘ তুই যা করছিস একদম ঠিক, আমি জানি তুই ভাবছিস পরে সমস্যা হবে।আমিও তোর সাথে সহমত, শুধু একটা কথাই বলব যা করবি ভেবে চিন্তে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে করবি তাহলে সব ঠিক হবে।’

‘ হ্যা মা।’

____________

তাহলে মা তুমি এখন খুশি তো?’

রুম্পা সিদ্দিক ছেলের রুমে এসে জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে রাখছিল তার মধ্যে হিমেল এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কথাটা জিজ্ঞেস করে। রুম্পা সিদ্দিক চওড়া হাসি দিয়ে বলেন।

‘ হ্যা বাবা আমি এখন ভীষণ খুশি,আর সত্যি আমি সবসময় চাইতাম যাতে তোর আর চৈতির বিয়েটা হোক। অবশেষে আল্লাহ পাক আমার দোয়া কবুল করেছেন।’

‘ হুম মা এখন শুধু চড়ুই পাখি কে বাড়িতে নিয়ে আসি এরপর আনন্দ মিছিল শুরু হবে আমাদের বাড়ি জুড়ে।’

‘ পাগল ছেলে আমার। আচ্ছা নিশা কোথায় জানিস?’

‘ হ্যা তোমার মেয়ের মনে রং লেগেছে।’

‘ মানে?’

হিমেল বিছানায় গা এলিয়ে বলে।

‘ মহারানী প্রেমে পড়েছেন।’

‘ কী?এসব কী বলছিস?আর তুই বা জানলি কী করে?’

‘ মা ও আমার বোন হয় আমি সব কথাই ওর জানি।’

‘ আজ আসুক বাড়িতে খবর নিতে হবে।’

গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে মাহমুদ এর ঘাড়ে মাথা রেখে বসে আছে তুফা। এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে হয়ত পৃথিবীর সব থেকে শান্তির জায়গা এটা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

‘ তুফা।’

‘‌জ্বি।’

‘ ভালো লাগে আমাকে?’

‘উহু।’

‘ তাহলে?’

‘ আপনাকে কখনও ভালো লাগে না, ভালোবাসি খুব খুব খুব বেশি ভালোবাসি।’

চলবে … ……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *