বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-১৫]

তালুকদার বাড়ির পেছনে একটি বাঁশবন আছে। অসংখ্য বাঁশে ভরপুর সেই বন।অশোক তালুকদারের মেজো ভাই রুবেল তালুকদার বাঁশবনের সামনে ফুলের বাগান করেছেন।প্রতিদিন তিনিই সেই বাগানের পরিচর্যা করেন বলা চলে।নানান ফুল গাছে মধুরিত সেই বাগান।আজও একই কাজে লেগে গেছেন বসন্ত।বাঁশবনে খুব একটা যাওয়া হয় না তালুকদার পরিবারের।আজকাল অশোক তালুকদারও খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।স্ত্রী শোকে কাতর ছিলেন কদিন। দ্বিতীয় স্ত্রী মৃত্যুর পূর্বে প্রাণোচ্ছল, প্রাণবন্ত ছিলেন এখন ঠিক তেমনই শান্ত,বিষণ্ণ।তবুও জীবন তো বসিয়ে রাখলে চলবে না।নিজেরও তো কাজ আছে। রাজনীতির মতো পেশায় জড়িয়ে।সামনেই আবার ইলেকশন।এ নিয়েও অনেক কাজ করতে হচ্ছে। অশোক তালুকদারকে পূর্ণ সহযোগিতা করছে ছোট ভাই বসন্ত। লোকটা এখনও অবিবাহিত।বয়স পঞ্চাশের অধিক।বিয়ে সাদীর বিষয়ে সেই যুবক বয়স থেকেই খুবই উদাসীন।

রুবেল বাগানে কাজ করছেন।গাছে পানি দিচ্ছেন। পাশেই একটি বড় শিউলি ফুলের গাছ আছে। শিউলি ফুলের গাছটিতে আগের তুলনায় এবছর বেশি শিউলি ফুটেছে।শিউলির গন্ধে আশেপাশে মো মো করছে।তন্নি উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেখানে আসে। বাবার নিকটে গিয়ে আহ্লাদী স্বরে বলে,“ বাবা আমি আজ বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাব।যাইই?”

রুবেল নিজের মেয়েকে খুব ভালোবাসেন।না করতে পারেন না।অনেকদিন পর এমন আবদার করলো। রুবেল শুধু এটুকু বলেন,“ সাবধানে যাবি সাবধানে আসবি।বাড়ির গাড়িতে করে যা।”

“ না বাবা৷ আমরা নিজেরা অটোরিকশাতে চড়েই যাব।”

মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন রুবেল সাহেব।তন্নি ড্যাংড্যাং করে চলে যায়।রুবেল সাহেব আবারও কাজে লেগে পড়েন।ভারী কর্মঠ তিনি।আলাদা কোনো পেশায় নিযুক্ত নন তবে কাপড়ের ব্যবসা আছে বড়বাজারে।বিশাল বড় দোকানটিতে মানুষের ঢল লেগে থাকে প্রতিনিয়ত।অন্যান্য গ্রাম থেকেও মানুষজন আসেন রুবেল সাহেবের দোকানে।কিছু মানুষ আবার অশোক তালুকদারকে বলতে না পেরে রুবেল তালুকদারের দোকানে গিয়ে উৎস’র নামেও বিচার দিতে যান।বেশিরভাগ বিচার উৎসের মারপিটের।কারণ জিজ্ঞাসা করলে তখন আবার উপযুক্ত কোনো কারণ দেখাতে পারেন না।বা মাঝেসাঝে এমন কারণও পেশ করেন যে ‘গাছ থেকে একটি ফল পেরে খাওয়ার কারণেও নাকি উৎস ও তার বন্ধুরা মারামারি করেছে।’

উৎসকে বিশ্বাস করেন রুবেল।উৎস এমন কাজ করবেনা।হয়তোবা কোনো ভুলক্রুটির ফলে ও গ্রামের ছেলের সাথে মারামারি করবেন এমন হতেই পারে। আজ দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।বুদ্ধি এঁটেছেন স্ত্রী শায়লার কাজে হাত লাগাবেন।বাড়িতে যাওয়ার জন্যই পা বাড়াচ্ছিলেন তখনই বাঁশবনের দিকে চোখ যায় উনার।মোটা সুতোর একটি বস্তা পড়ে আছে।রুবেল সাহেব কপাল কুঁচকান।এই বস্তা কোথা থেকে এলো?এতক্ষণ নজরে এলো না কেন? এগিয়ে যান সেদিকে।দুটো বাঁশের মাঝখানে পড়ে আছে বস্তাটা।বস্তাটা খুব ময়লা আবার লাল লাল কিছু যেন লেগে আছে বস্তায়।তাই বস্তাটার আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই কেমন যেন পচা গন্ধ পান তিনি।এতেই যেন চমকে ওঠেন।কিছুটা পেছনে সড়ে যান।সাহস জুগিয়ে আবারও সেই বস্তাটার কাছে গিয়ে বস্তাটা খোলার চেষ্টা করেন।মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা বস্তাটা কষ্ট করে খুলতেই বিভৎস কিছু দেখে উনার মস্তিষ্কই কাজ করা বন্ধ করে দেয় যেন। চেঁচিয়ে হালানকে ডাকতে থাকেন।হালান তাদেরই বাড়িতে কাজ করে।রুবেল সাহেব বস্তাটার দিকে তাকাতেও পারছেন না হাত পা অবশ হয়ে আসছে উনার।মাথা ঘুরছে নিজেরও।হালান সেখানে আসতেই চেঁচিয়ে ওঠে লাশটা দেখে।রূপক নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দেখার চেষ্টা করে কি হয়েছে।তার বাবা আর হালানকে বাঁশবনের সামনে দেখে কৌতূহলী হয়ে নিচে নেমে আসে।আর সেখানটায় যায়। 

“ কি হয়েছে বাবা?”

কথাটা বলে সামনে তাকাতেই নিজেও চমকে ওঠে রূপক।বিভৎস লাশ সে নিজেও দেখেছে অনেকবার। তবে এমনটা কখনো দেখেনি(লাশের বর্ণনাটা লিখেছিলাম তবে খুবই নৃশংস ছিলো বলে আবার কেটে দিয়েছি)।বস্তার পাশে পাকস্থলিটা পড়ে থাকতে দেখে চোখ বন্ধ করে নেয় রূপক।তার টিমকে কল করে আসতে বলে।বাবা আর হালানকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।আশেপাশে একবার চোখ বুলাতে থাকে। বস্তাটা এমনি এমনি তো আর এখানে আসবে না।তবে বস্তাটা কি টেনে আনা হয়েছে নাকি কাঁধে করে আনা হয়েছে এটা বুঝতে পারলো না।আরেকটু গভীরে যেতেই একটি আংটি পড়ে থাকতে দেখে রূপক। রুমাল দিয়ে সেটা নিয়ে নেয় রূপক।ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই চিনে ফেলে এটা কার?রূপক শুধুই একটা বাঁকা হাসি দেয়।তার টিমের লোকগুলো এসে গেছে।এবার হাসপাতালের দিকে রওনা হয় তারা।একটি এম্বুল্যান্স আনা হয়েছিলো লাশটির জন্য।সেটাও হাসপাতালের উদ্দেশ্যেই রওনা হয়।

_______________________

উৎস জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।উচ্ছ’র এই ফ্ল্যাট-টা দোতলায়।উৎস শুধু হিসাব করছে ঠিক কতক্ষণ সময় লাগবে এই জানালা থেকে নিচে নামতে।গতকাল দেখেছিলো উৎস এই জানালার পাশেই একটি মোটা পাইপ লাগানো আছে।জানালায় আবার গ্রিলও দেওয়া নেই।শুধুই কাঁচ দিয়ে বাধানো। খোলাও মুশকিল।গতকাল রাতে উচ্ছ বিয়ে করে নিয়েছে মেয়েটিকে।ভাই হিসেবে গতকাল রাতে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে এই বাসায় ছিলো উৎস।ভাই আর ভাইয়ের বউকে সময় দেওয়া উচিত বলেই মনে করে উৎস।পেছনে ঘুরে দরজার সামনে যায় উৎস।দরজা খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।বাইরে থেকে লাগিয়ে রাখা হয়েছে।উৎস গা কাঁপিয়ে হাসে।খুব হাসি পাচ্ছে তার।বাইরে থেকে দরজা হঠাৎ খুলে যায়।বাইরে থেকে পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে।উৎস মুখ কুঁচকে বলে,“ এখনই আসার সময় হলো?”

উচ্ছ জবাব দেয় না।দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। উৎস চোখ খুলে উচ্ছ’র দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।উচ্ছ উৎসের চোখে আজ দিকে তাকিয়ে আছে।চোখে অবমাননা,ঠোঁটের হাসি নির্লিপ্ত।উচ্ছ শুধুই এটুকুই বলে,“ তোর থেকে এটা আশা করি নি উৎস।”

কথাটা শুধু বলেছে তখনই উৎস হুট করেই উচ্ছ’র মুখের সামনেই দরজা লাগিয়ে দেয়।লক করে সেই জানালার সামনে গিয়ে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। খুব সহজেই কাঁচগুল ভেঙ্গে যায়।মাথাটা বাইরে দিয়ে দেখে পাইপটার অবস্থান।এদিকে পেছন থেকে উচ্ছ বারবার দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।আর চেঁচাচ্ছে।উৎস শুধু হাসে আর বলে,‘ বেকুব।’ জানালার পাশে থাকা সেই পাইপ বেয়ে নিচে নেমে যায় উৎস।একটু কষ্ট হয়েছে তবে সে সয়ে নিয়েছে।নিচে নেমে দ্রুত বিল্ডিংয়ের চারপাশে থাকা দেয়ালটা টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে।তবে পুলিশের গাড়িগুলো তার থেকে কিছুটা দূরেই ছিলো।তখনই একটি বাইক তার সামনে এসে থেমে যায়।উৎস সেই বাইকে উঠে পড়ে।বাইকটি মুহুর্তের মাঝেই উৎসকে নিয়ে চলে যায়।তবে পেছনে পুলিশের গাড়িগুলোও ধাওয়া করতে থাকে।উচ্ছ সেই জানালা দিয়ে তা দেখে।রূপকই ফোন করে জানিয়েছে গ্রামের সেই সমস্ত খুনসহ, মিসেস উষা তালুকদারের খুনও নাকি উৎসই করেছে।সেই কাজের মেয়েটি স্বীকার করেছে সাথে আজ সকালেই একটি লাশ পেয়েছে।সাথে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটি আংটি পেয়েছে যেটা কিনা উৎস’র বন্ধু বিশালের।বিশালকে জেরা করে জানা গিয়েছে কাজটা উৎসই করতে বলেছে তাকে।এছাড়া উৎসদের জঙ্গলের ভেতর সেই কুড়েঘরে আরও একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে।বিশালকে জেলে রাখা হয়েছে।এখন উৎসকে ধরা বাকি।এদিকে উৎসও পালিয়ে গেলো।খবরটা ফোনকলের মাধ্যমে রূপককে জানায় উচ্ছ।রূপক শুধু হেসে বলে,“ পালিয়ে যাবে কোথায়?”

উৎস হেলমেট পড়েছে।ফোনটা হাতে নিয়ে নিহালকে কল করে।নিহাল কল রিসিভ করতেই উৎস বলে উঠলো,“ আমি এখন সোজা গাজীপুর যাব।তুই আর শাওন চলে আয়।তবে সাবধান।”

বলেই কল কেটে দেয়।বাইক চালানো ব্যাক্তিকে বলে,

“সাবাশ ব্যাটা ঠিক সময়েই এসেছিস একদম।”

হেলমেটের আড়ালে হাসে।আর বলে,“ আমি অভি। আমার পক্ষে সবই সম্ভব।”

অভি উৎস’র ভার্সিটি ফ্রেন্ড।ভার্সিটি থাকাকালীন অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিলো তাদের মাঝে।গ্রামে যাওয়ার পরও বন্ধুত্বটা কমে নি।অভি উৎসকে জিজ্ঞাসা করে,“ চলছেটা কি মামা?পুলিশ তোর পেছনে কেন?”

উৎস তাচ্ছিল্য হাসে।বলে,“ একমাস আগে গ্রামে লাশ পাওয়া গেলো।লাশগুলো আমাদের গ্রামের না আবার অন্যগ্রামের।বাবা রূপকরে ফোন কইরা বিষয়টা জানাইলো রূপকও গ্রামে গেলো।লাশগুলা পোস্টমর্টেমের পর জানা গেলো যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু তবে মৃত্যুওটা সাধারণ নয় চেহারা দেইখাই বোঝা যায় কি নৃশংস সেই মুখবিবর।রূপক তদন্ত শুরু করলো। তবে ওই শালা কোনো উন্নতি করতে পারলো না কেসের।কয়েকদিন পরে আরও লাশ পাইলো একটা না দুইটা।পাশের গ্রামে খোজ নিয়া জানলো লোকগুলা নাকি বাড়ি থেকে কিছু একটা বইলা চইলা যাইতো আগামীকাল সকালে ফিরমু কইয়া।ওহ হ্যা আরেকটা ব্যাপার কইতে ভুইলা গেছি।মিসেস উষাও এর মাঝে ওপারে চইলা গেলো।উনার মৃত্যুর জন্য রূপক আর বাড়ির লোকেরা ভাই আমারেই সন্দেহ করে।এটা কোনো কথা তুইই বল দেহি?এই রূপক তো আসল খুনিরে ধরবার পারলো না উলটা আমার পেছনে লাগলো।গতকাল রাতে নিহাল কল দিয়া বলে বিশাল নাকি রূপকরে কইছে আমিই খুন করছি সব।হাস্যকর।”

বলেই খুব জোরে জোরে হাসে উৎস,“ ঘটনা যে আমার বিপক্ষে যাইতেছে এইটা অনেকদিন আগেই ঠাওর করতে পারছি।আমরা যেই কাঠঘরে মাল খাইতে যায় ওইখানেই লাশগুলা কেডা জানি রাইখা যায়।পরে আবার ঠিকি যে আনে সেই নিয়া যায়। আমি তখন খুব একটা পাত্তা না দিলেও রক্ত দেইখা একদিন বুইঝা গেছিলাম।”

এবার একটু ভাবুক হয়ে বলে,“ খুবই ঘাপলা আছে মামা।তুই ওইদিন ফোনে বললি শহরেও নাকি এমন কয়েকটা জায়গায় হইছে।বৃদ্ধ কয়েকজন উধাও সাথে লাশ পাওয়া গেছে।তাইলে বুইঝা দেখ এইটার সাথে গ্রামের সেই ঘটনা কিন্তু একই।আর এই রূপক হালায় দোষ দেয় আমারে।ছিহ।”

অভিও কিছু একটা মনে করে বলে,“ শুধু শহরে না কিছু কিছু গ্রামেও এমন হয়েছে তবে সেটা কয়েকমাস আগে।কোনো প্রমাণাদি পাওয়া যায় নি বলে কেইসটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

উৎস শুধু শুনতে থাকে।

রাত তখন নয়টা বাজে।গ্রামের হাসপাতাল খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত মানুষজন নিজ বাসগৃহে গিয়ে ভিড়ে।শুধু থেকে যায় পাহাড়াদাড় আর নাইট শিফটে কাজ করা কিছু ওয়ার্ডবয়,নার্স ডাক্তার।ইভান নিজ কেবিনে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে।কক্ষ কাঁপিয়ে কল আসতেই রিসিভ করে জানতে পারে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা আনা হয়েছে।কল কেটে ফোন এপ্রোনের পকেটে ঢুকিয়ে হাতে গ্লাভস পড়ে নেয়।খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে যাবে এখন।হেঁটে গিয়ে নিচতলার একটি পরিত্যক্ত কক্ষে প্রবেশ করে ইভান। স্ট্রেচারে শোয়ানো এক বৃদ্ধ লোকের লাশ।ইষৎ পেট উঁচা নামাতে বোঝা যাচ্ছে বেঁচে আছে তবে শুধু অজ্ঞান করা হয়েছে। পাশে দাঁড়ানো দুজন লোক। ঠোঁটে তাদের কুটিল হাসি।তাদের মধ্য থেকে একজন এই গ্রামের পুলিশ অফিসার।যার একবছর আগেই এখানে পোস্টিং হয়েছে।অন্যজন হলো ডাক্তার শাহর। ইভান কাছে এগোয়।প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম রাখা আছে।কাজ শুরু করার তাগদা দেয় শাহর। কেচি নিয়ে আগে কানের কাছ থেকে চামড়াটা ছিলতে চায় ইভান।যেন মুরগির চামড়া তুলে ফেলবে। চেষ্টা করলো কিয়ৎক্ষণ তবে পারলো না কিন্তু বৃদ্ধর কুঁচকে যাওয়া চামড়া ভেদ করে ঠিকই রক্ত বের হলো।তবে খুব একটা কাজে না দিলে ছোট্ট নাইফটা হাতে নিয়ে সোজা মাঝ বরাবর জোরে আঘাত করে। রক্ত গলগল করে বেরোয়।ইভান হেসে ফেলে।এরপর মাথার চামড়া টেনে তুলে ফেলে।চুলবিহীন মাথা থেকে চামড়া তুলতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। পরপর শুরু হয় ভয়ানক এক কাজ।পাশে থাকা দুজনের পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে ইভানের চোখেমুখে লেগে আছে হাসি। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইভান মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষ।সাইকো একজন ডাক্তার।বুক থেকে পেট পর্যন্ত কেটে শরীরের অভ্যন্তরে যাবতীয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বের করে কয়েকটি বিশেষ কাঁচের পাত্রে রেখে দেয় ইভান। মূলত বৃদ্ধদের মেরে তাদের এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হয় যদি সেটা গ্রহণযোগ্য হয় তবে আলাদাভাবে সুরক্ষিত করে রাখা হয়।পরবর্তীতে সেটা বাইরের দেশে কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।আর মোটা অঙ্কের টাকা হাতে এসে পৌঁছায় এই মানসিক ভারসাম্যহীন লোকগুলোর কাছে।তবে এর পেছনে মাস্টারমাইন্ড একজন আছে।এতদিন ড. শাহর কাজটা পরিচালনা করলেও ইভান আসার পর ইভানই এই কাজ করে।ইভানের রূপকের ওপর খুব হাসি পায়।ছেলেটা বুঝতে পারছেও না কিছু।সেই কাচা ব্রেইন দিয়ে যে কিভাবে এসপি অফিসার হলো এটাও বুঝে আসে না ইভানের।অবশ্য কোনো ক্লু না পাওয়ারই কথা এমন ভাবে তারা সমস্ত প্ল্যান করে রাখে এতে কেউ ঠাওরও করতে পারবে না।ড. আশিন যাওয়াতে তাদের কাজ আরও বেশি ভালোভাবে করতে পারছে।এখানে পার্মানেন্ট থাকার ব্যবস্থা শুধু এখন ইভানের।

___________________

রূপক বেশ রাত করে বাড়ি ফিরছে।রাস্তাটা বিপদজনক মনে হয় এখন তার কাছে।গ্রামের লোকজনও কেমন উদাসীন আজকাল।প্রাণবন্ত গ্রাম অঢেল মানুষের নিখোঁজে শশ্মানঘাটে পরিণত হওয়ার জোগাড়।রূপক ঠিক কোনদিকটা সামাল দেবে বুঝে উঠতে পারছে না।তার ধারণা তারই টিমের কেউ একজন তার সমস্ত পরিকল্পনা সেই খুনীদেরকে দিচ্ছে।এবার রূপক ঠিক করে সে নিজে একটা সিক্রেট মিশনে নামবে। উৎসকেও ছাড়বে না সে।উৎস অবশ্যই এই কাজের সাথে জড়িত বলে রূপকের ধারণা।তবে উৎসও তো আজ পালিয়েছে। রূপক ভাবে পালিয়ে যাবে কোথায়?সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করবে যেই এই কাজগুলো করছে আর উৎসের বিরুদ্ধে।মৃত্যুদন্ডও যেন ভয় পায় সেই লোকগুলো।এই ভেবেই নিজের গাড়িটি নির্জন জায়গা ধরে চালাচ্ছিলো এমন সময় সামনে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে।পুরোটাই সাদা।রূপক ভয় পায় না কোনোকিছু।খুব সহজেই গাড়ি থেকে নেমে জিনিসটা দেখতে যাবে সেসময় তার ওপর তিনজন লোক এসে আক্রমণ করে বসে।রূপক ট্রেনিং প্রাপ্ত সমস্তকিছুতে তাই প্রতিহত করতে খুব একিটা বেগ পেতে হয় না।এটাও বুঝতে পারে এটা সেই খুনীদেরই কাজ।দূর্ভাগ্যবশত সেই লোকগুলো পালিয়ে যায়।নয়তো তাদের থেকেও কিছু তথ্য কালেক্ট করতে পারতো। রূপক নিজেও কিছুটা আহত হয়।আবারও গাড়িতে উঠে বসতেই ফোনে কল আসে।ফোনের স্ক্রিনে দেখে উচ্ছ নামটা জ্বলজ্বল করছে।এই ছেলে বিয়ে করেছে তাও আবার তারই কলিগকে এর কারণটা রূপক গোপন তথ্যসূত্রে জানতে পেরেছে।অফিসের একটি পার্টিতে মদ্যপান করে দুজনের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের কুফলে মেয়েটির গর্ভবতী।তাইতো অনিচ্ছা স্বত্তেও বিয়ে করতে হয়েছে মেয়েটিকে উচ্ছর।মেয়েটি তার নামে কেইস করবে বলে হুমকি দেয়।এমনকি সমস্ত প্রমাণও উচ্ছর বিপক্ষে তাইতো বাধ্যতামূলক এই বিয়ে।তপ্ত শ্বাস ফেলে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উচ্ছ বলে,‘‘উৎসর খোঁজ পেয়েছিস?’’

‘‘উৎসকে ধরার জন্য তোর অনেক তাড়া দেখছি।’’

ওপাশ নিরব হয়।কিছুক্ষণ পরই উত্তর আসে,‘‘ও একটা খুনী আর আমার তাড়া থাকাটা স্বাভাবিক।’’

রূপক ঠান্ডা আওয়াজে বলে,‘‘এতো শিওরিটি দিচ্ছিস?’’

চুপ হয়ে যায় উচ্ছ।কল কেটে দেয়।রূপক বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে থাকে মস্তিষ্কে হাজারও চিন্তাভবনা নিয়ে।

___________________

আজ সকালে রবিন সাহেবের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেলো ক্যানসার হয়েছে তাও আবার লাস্ট স্টেজে।আশিনের মাথায় হাত।চোখ বন্ধ করে বসে আছে।ডাক্তাররা এসে অবশ্য আশিনকে স্বান্তনা দিয়ে গিয়েছেন।আশিন নিজেই একজন ডাক্তার হয়ে বাবার চিকিৎসা সে নিজেও করায় না।এমনকি আগেও কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নি।কারণ আশিন ভেবেছিলো এত বড় কোনো রোগ নয়।তবে এখন তার ধারণা ভুল হলো।সর্বোচ্চ কয়েকমাস বাঁচার সম্ভাবনা আছে রবিন সাহেবের।আশিনের হৃদয় ফেঁটে চৌচির হওয়ার জোগাড়।তবুও অশ্রুবিহীন চোখ খুলে সামনে তাকায়।সামনেরই একটি কেবিনে তার বাবাকে শিফট করা হয়েছে। দীর্ঘদিনভাবে এই হাসপাতালেই তার বাবাকে চিকিৎসারত থাকতে হবে।দরকার পরলে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার মতো কথাও উঠেছে।তবে আশিনের মনোভাব ভারি কঠিন বোঝা যায় না।আশিনের সামনে কেউ একজন আসে।আশিন চোখ তুলে তাকায় না।সামনের জনই কথা বলে ওঠে,‘‘কি ভাবছো আশিন?আঙ্কেলকে কি দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাবে?’’

আশিন চুপ থাকে।ক্যানসার থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা খুব সীমিত।আশিনকে আবারও কিছু বলতে যাবেন আশিনই জবাব দেয়,‘‘আমায় কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও নেহা।’’

নেহা আশিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। রাত সাড়ে এগারোটা বাজছে।এই সময় হাসপাতাল কিছুটা নিরব হয়ে যায়।এই সময় মানুষের আনাগোনাও নেই বললেই চলে।আশিনই একা বসে আছে তার বাবার কেবিনের দরজার সামনে। নড়াচড়াহীন আশিন যখন বসে থাকায় মগ্ন তখনই তার সামনে প্রকট হয় কালো অদ্ভুতুরে কিছুর। আশিন চোখ তুলে তাকায় না।হাটুতে কনুই দিয়ে ভর দিয়ে মাথায় দুহাত রেখে বসে আছে নির্বিঘ্নে। বেশ কিছুক্ষণ সেটা আশিনের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে। আশিন চোখ বন্ধ করে।আবার চোখ খুলতেই সামনের সেই অদ্ভুতুরে জিনিসটা আর দেখতে পায় না।তবে জুতার আওয়াজ কানে শুনতে পায়।ঠক ঠক আওয়াজে কেউ আসছে।আশিন এবারও ফিরে তাকায় না।আর না তার চোখেমুখে কোনো ভয়ভীতি। সে তো নির্বিকার ভঙ্গিমায় ভাবতে ব্যস্ত তার বাবাকে নিয়ে কি করবে?এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ায় সম্পূর্ণ কালো পোশাকে আবৃত একটি লোক। তবে লোকটি হুট করেই আশিনকে ছুরি আক্রমণ করতে গেলে আশিন সড়ে পড়ে।চোখ তুলে সেই লোকটির দিকে তাকাতেই দেখে মুখোশে আবৃত সম্পূর্ণ মুখবিবর।আশিনকে আবারও ছুরি দিয়ে আঘাত করতেই আশিন লোকটির হাত ধরে ফেলে।সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটিকে ঘুষি মারে।লোকটি পিছিয়ে যায়।হাড়ে হাড়ে টের পায় বসের কথা।আশিন মোটেও সাধারণ নারী নয়। আশিন কাছে গিয়ে লোকটির উন্মুক্ত চুলগুলো টেনে ধরে মুখ বরাবর কয়েকটা ঘুষি মারে।পুরুষ হয়েও আশিনের শক্তির সাথে মোটেও পেরে উঠছে না লোকটি।আশিন সাধারণ কেউ নয় এটা একদমই শিওর সে।আশিন এবার লোকটিকে ইচ্ছেমতো জখম করে দেয়।লোকটি মনেপ্রাণে এখন বাঁচতে চায়। টাকার লোভে এসেছে মৃত্যুর কাছে।এখন সেও বুঝতে পারছে না তার শেষ পরিণতি ঠিক কি?

আশিন ধাক্কা মারে।লোকটি নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়।মুখ থেকে রক্ত পড়ছে ফোটা ফোটা।আশিন পাশে থাকা টুলের ওপর কাঁচের ফুলদানিটার দিকে তাকায়।লোকটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বারবার পলক ফেলে তাকাতে থাকে।আশিন সেই কাচের ফুলদানিটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে।সেখান থেকে এক টুকরো কাঁচ নিয়ে হাটুগেড়ে বসে লোকটির পাশে।সজোরে আগে একটি চড় মারে। লোকটি এবার ভয়ে কান্না করতে করতে ক্ষমা চাওয়া শুরু করে।

‘‘আমাকে ক্ষমা করে দিন আশিন।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন।’’

আশিন কানেও তোলে না সেসব।বরঞ্চ লোকটির গলা চেপে ধরে শীতল আওয়াজে শুধায়,‘‘আশিনকে মারতে এসেছিস?এত বড় কলিজা তোর?’’

আবারও ক্ষমা চাইতে থাকে লোকটি।আশিন শোনে না মাস্কটি খুলে লোকটির পুরো মুখশ্রী দর্শন করে বাঁকা হেসে কাঁচের সেই টুকরোটি সোজা লোকটির বাম চোখে ঢুকিয়ে দেয়।গলগল করে বেরোয় রক্তের স্রোত। লোকটির আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে সেই জায়গাটি। আশিনের বাবা যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন ভীষণ তাই উনাকে অজ্ঞান হওয়ার ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।উনি শুনতে পাবেন না।আর আশেপাশে রোগীদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।এই ফ্লোরের কক্ষগুলোতে ভি-আইপি রোগীদেরকেই রাখা হয়।চিৎকার শুনে দুএকজন নার্স কোথা থেকে যেন আসে।তবে দূর থেকেই ভয়ার্ত চোখে দেখতে থাকে সেই ভয়ানক দৃশ্য।আশিন কাঁচের টুকরোটি বের করে এবার ডান চোখে ঢুকিয়ে দেয়।আবারও ভয়ানক আর্তচিৎকার করে ওঠে লোকটি।নৃশংস এই দৃশ্য দেখে ড. নেহাও আর একমুহুর্ত থাকে না সেখানে।এদিকে লোকটি প্রাণের ভিক্ষা চাইছে সেটা কিনা আশিন কখনোই দেবে না।আশিনের সামনে এসে দাঁড়ায় ড. কাব্য। আশিন সেদিকে গুরুত্ব দেয় না আর না কাব্যও কিছু বলে।লোকটি অসহনীয় যন্ত্রণা গলাকাটা মুরগির মতো ছটপট করছে শুধু।এবার আশিন পাশ থেকে আরেকটি কাঁচের টুকরো নিয়ে লোকটির কপালে ঢুকানোর চেষ্টা করে।চামড়া ভেদ করে রক্ত বের হচ্ছে।তবে বেশিকিছু করতে না পেরে গালের মাংসেই এবার ঢুকিয়ে দেয় সেই কাঁচের টুকরো।লোকটি শুধু ছটফট করছে আর চিৎকার করছে।মুরগির গলা কাটার পর মুরগিগুলো যেমন করে লোকটির অবস্থাও ঠিক তেমন।একটি সুস্থ লোককে এভাবে নির্মমভাবে হত্যার মতো নৃশংস বিষয়বস্তু আর কি-ই বা হতে পারে?আরেকটি কাঁচের টুকরো নিয়ে এবার লোকটির কণ্ঠনালীতে সজোরে চাপ প্রয়োগ করে ঢুকিয়ে দেয়।চিৎকার করতে না পেরে গোঙাতে থাকে লোকটি।হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে।আশিন কাব্য’র দিকে তাকাতেই কাব্য নিজের ভীতি লুকিয়ে আশিনের চক্ষু ইশারা মোতাবেক দুজন ওয়ার্ডবয়কে ডাকে।ওয়ার্ডবয়রা এসে এমন ভয়ানক কিছু দেখে নিজেরাই পিছু হটে।মুখের অবস্থা ভীষণ ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।কাব্যের কথামতো লোকটিকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়।কাব্য আশিনের কাছে গিয়ে বলে,‘‘হাত পা ধুয়ে আসুন ড. আশিন।আপনাকে দেখতে ভয়ানক লাগছে।’’

আশিন চোখ তুলে কাব্য’র দিকে তাকাতেই কাব্য চোখ নামিয়ে নেয়।নার্সরা তো ভয়ে চলে গিয়েছে। তারা কিছুই করতে পারবে না।এই হাসপাতালের চেয়ারম্যান নিজেই তো কিছু করতে পারবেন না। তারা সেখানে তুচ্ছ বলা চলে।আশিন ওয়াশরুমে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে। 

‘‘আশিন।’’

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে আশিন পেছনে ফিরে তাকায়। সাথে কাব্যও।হতবম্ভ চোখে উৎস দাঁড়িয়ে আছে। উৎস যে সমস্তকিছুই দেখে নিয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।উৎসকে দেখতে কেমন যেন লাগছে।বাম গালে একপাশে কাটা দাগ,রক্ত শুকিয়ে গেছে, ডান হাতের কবজিতে রক্ত।বাম হাতের তালুতে কাটা দাগ।আর এখন এগিয়ে আসছে কেমন খুড়িয়ে খুড়িয়ে।উৎসর এমতাবস্থা দেখে আশিন। কাব্য’র এপ্রোনের পকেট থেকে রুমালটা নিজ হস্তে বের করে হাত মুছে নেয়।সাদা রুমাল মুহুর্তের মাঝে শ্বেত রক্তবর্ণ ধারণ করে।উৎস নিজের চমকিত ভাব লুকায় না।কাছে এসে আশিনকে জিজ্ঞাসা করে,‘‘এটা কি করলে?’’

আশিন সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়,‘‘তুমি চাইলে তোমার ওপর ডেমো দেখাতে পারি।’’

চোখ ছোট ছোট করে দেখে আশিনকে।আশিন তুমি করে বলছে।এটা অবশ্য স্বাভাবিক।মাঝে মাঝে তো তুই করেও বলে।তবে আশিনকে উৎসর মোটেও আজ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।লোকটিকে মারার সময় কেমন হিংস্রতা ছিলো আশিনের সুন্দর মুখশ্রীতে।চোখ দুটো কেমন ভয়ানক ছিলো।তবে লোকটিকে কেন মারলো এ বিষয়ে কৌতূহলী হয় উৎস। আর আশিনই বা এমন হিংস্র কেন হলো?

‘‘মারলে কেন?’’

উৎস’র প্রশ্ন শুনে আশিন উৎস’র দিকেই দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,‘‘আমায় মারতে এসেছিলো তাই।’’

‘‘তুমি যে এভাবে মানুষ মারতে পারো জানতাম না।’’

‘‘তাহলে আজ থেকে জেনে নিন।ভবিষ্যতে কাজে লাগতেও পারে।’’

আশিনের কথাগুলোতে কেমন অন্যরকম একটা অনুভুতি মিশে আছে।ভয়ানক সেই অনুভুতি।ভয়ানক সেই কণ্ঠস্বর।আগে রাগান্বিত স্বরে কথা বললেও কেমন মধুর শোনাতো আর আজ শান্ত স্বরে কথা বলেও ভয়ানক শোনাচ্ছে।উৎস বলে,

‘‘তুমি তো খুবই ডেঞ্জারাস।’’

‘‘জানতে দেরি করেছো।’’

‘‘যত যাই করো তোমার পিছু আমি ছাড়ছি না।’’

‘‘কি জন্য এসেছো?’’

‘‘দেখতেই পাচ্ছো আমার হাল।আমি ভীষণ আহত।আমায় যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করা তোমার কর্তব্য।’’

‘‘তোমায় না খুনের অপরাধে পুরো শহর জুড়ে পুলিশ খুজে চলেছে।এখন আমরা যদি ফোন করে পুলিশকে তোমার ব্যাপারে বলে দেই।’’

উৎস হাসে,

‘‘সেটা তুমি কখনোই করবে না আশিন।’’

‘‘এত আত্মবিশ্বাস?’’

‘‘এতই আত্মবিশ্বাস।’’

আশিন কাব্য’র দিকে তাকাতেই কাব্য বলে,

‘‘আপনি বরং ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি দেখছি উনাকে।পুলিশকে কল করবো?’’

আশিন কাব্যর কথা শুনে উৎসর দিকে একবার তাকায়।উৎস আত্মবিশ্বাসী হয়ে বসে আছে।আশিন ঢিমে আওয়াজে বলে,

‘‘না।’’

বিজয়ের হাসি হাসে উৎস।আজ আশিনের ব্যবহার খুবই শান্ত লাগছে তার।তবে বুকের ভেতরে কোথাও একটা আতঙ্ক কাজ করছে আশিনের লোকটিকে ওভাবে মারতে দেখে।আশিন কাব্যের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই কাব্য একজন নার্সকে ডেকে পাঠায়।উৎস ততক্ষণে সেখানে একটি চেয়ারে বসে পড়েছে।নার্সটি ট্রে তে করে কিছু সরঞ্জাম নিয়ে আসে।আশিন উৎস’র সামনে এসে দাঁড়ায়।

‘‘পালিয়ে বেরাচ্ছো নিশ্চয়?তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম আজ।আমি তো আবার মানুষকে সুন্দর জীবন দিতেই বেশি পছন্দ করি।তাই তোমাকেও বাঁচিয়ে দিলাম এখন, ভবিষ্যতে কিভাবে বাঁচো সেই দায়িত্ব তোমার।’’

‘‘চিন্তা করো না তোমাকে নিয়েই বাঁচবো।খুউউব সুখে।’’

‘‘ক্ষত তো অনেক?’’

‘‘ভালোবাসার ক্ষত থেকে এটা নিছকই তুচ্ছ।’’

‘‘এত ভালোবাসা কবে থেকে?’’

‘‘যেদিন থেকে চোখে পড়েছে।’’

‘‘এটাতো তবে ভালোলাগা।এখনও পার্থক্য বুঝতে শিখো নি দেখছি।’’

‘‘পার্থক্য বুঝতে শিখিনি তবে সংমিশ্রণ বুঝতে শিখেছি অনেক আগেই।’’

‘‘একটুও ভয় হচ্ছে না?’’

ঠোঁট বেকিয়ে হাসে উৎস,‘‘হ্যা হচ্ছে তো, না পাওয়ার ভয়।’’

আশিন তুলো নিয়ে স্যাভলন দিয়ে ভিজিয়ে উৎসর গালের কাছে ক্ষতস্থানে ধরতেই জায়গাটায় জ্বলে ওঠে।উৎস নড়েচড়ে ওঠে।আশিন নিজের কাজ করতে থাকে।উৎস আশিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। আশিনের হাত এখনও ইষৎ লাল।একমন বলছে মেয়েটা খুবই নরম হৃদয়ের তো অপরমন বলছে মেয়েটা ভয়ানক।আশিনের দিকে নিপুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাকালীন আশিন উৎসর দিকে তাকায়। চোখ সড়ায় না আজ আর না চোখে রাখে কোনোপ্রকার তেজ।বরং সেই শীতল চোখে আজ নিজের জন্য কিছুটা হলেও অন্যরকম অনুভুতি দেখতে পায় উৎস।আশিন গালের ক্ষতস্থানে ওয়ানটাইম লাগিয়ে দেয়।চোখ সড়িয়ে কবজির শুকনো রক্ত পরিষ্কার কিরে দিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়।হাতের তালু পরিষ্কার করে দিয়ে সেখানে প্রলেপ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়।নার্সটি ভয়ে ভয়ে চলে যায় আবারও।উৎস উঠে দাঁড়ায়।কাব্যও চলে গিয়েছে এখন এখানে শুধু উৎস আর আশিন।উৎস আশিনের কানের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো ব্যান্ডেজ লাগানো হাতেই কানের পিছে গুজে দেয়। আশিন বাধা দেয় না শুধু স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে উৎসর কাজ।গালের কাছে আঙুল বুলিয়ে উৎস বলে,

‘‘নারী কোমলতায় সুন্দর, রহস্য তাদের চোখেমুখে খুব কমই শোভা পায়।নারীদের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা উচিত লজ্জা, আর চোখে আড়ালে মায়া।’’

‘‘মায়া,লজ্জা দুটো বিষয়ই খুবই বিরক্তিকর।’’

‘‘আমিই পরিবর্তন করিয়ে দেব।’’

আশিন এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,‘‘ওহ, তাই নাকি?’’

‘‘আগ্নেয়গিরির আন্দোলিত অক্ষিদয়ে আজ নমনীয়তার ছোয়া দেখে নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারছি না।এই উৎসর প্রতি মনকাড়া অনুভুতির লক্ষণ যথেষ্টা ভালো।আমি সত্যিই শিহরিত,পুলকিত।প্রেমে পড়লে বুঝি?’’

‘‘প্রেম ভারি হাস্যকর আমার কাছে।শত্রু বলা চলে।’’

উৎস আশিনের একটু কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,‘‘হাস্যকর বিষয়টিই আবার না সত্যিকারে পরিণত হয়।গ্যারান্টি তো দেওয়া যায় না।অবশ্য লেটেস্ট ব্র্যান্ড, দেওয়া গেলেও যেতে পারে। তবুও প্রেমটুকু এবার হয়ে যাক না ড.।’’

চলবে…. …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *