বৃষ্টি হয়ে নামো [পর্ব-২১]

হোটেলে ফেরার কয়েক মিনিট পূর্বে ধারা চোখ খুলে।এতক্ষণ ঘুম ছাড়া চোখ বুজে থাকাও কষ্ট!শরীর ঝিমিয়ে এসেছে।ঠান্ডায় ধারার শরীর দূর্বল।বিভোর পাঁজাকোলা করে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়।বের হবার আগে বলে,

—–“বের হবেনা রুম থেকে।আমি তোমার খাবার রুমে নিয়ে আসবো।”

ধারা না করেনি।বিভোর বার বার রুমে আসুক।আর সে প্রাণভরে, মনভরে বিভোরের উপস্থিতি উপভোগ করুক।বিভোর রুমে এসে দেখে সায়ন বিছানায় শুয়ে পড়েছে জুতাসহ।খিটখিট করে বলে,

—–“তুই তো একা ঘুমাবিনা রাতে।আমারো ঘুমাতে হবে।বিছানায় জুতা নিয়ে কেন উঠলি?দেখ চাদরে ময়লা লাগছে।”

সায়ন উঠে দাঁড়ায়।ঘুমু ঘুমু চোখে বলে,

—–“সরি দোস্ত।”

এরপর জুতা খুলে আবার শুয়ে পড়ে।বিভোর শার্ট চেঞ্জ করে বললো,

—–“খাবিনা?”

—–“সন্ধ্যার পর।এখন ঠান্ডা বের হমুনা।”

বিভোর আর কিছু বললোনা।হাতে টাকা কম থাকায় দুজন এক রুম নিয়েছে এখানে।গতকাল পুরো রাত বিভোর ঘুমাতে পারলোনা সায়নের জ্বালায়।সায়ন মেয়েদের মতো গুটিসুটি মেরে বুকে এসে শুয়ে পড়ে। অদ্ভুত!

সন্ধ্যে সাতটা।প্রচণ্ড শীতের কারণে ডিনারের জন্য লাল বাজারে যেতে মন চাইছিল না।তাই ওরা হোটেলের পাশেই একটি ডোমিনোজ পিজ্জার দোকানে যায়।বিভোর ধারার খাবারটা রুমে নিয়ে আসে।সায়ন-দিশারি রুমে ফিরে কম্বলের নিচে ঘুম।তখন বিভোর ধারা গল্পে মশগুল।ধারা কম্বল গায়ে দিয়ে আধাশোয়া হয়ে বসে আছে।বিভোর বিছানার কোণে দু’পা ভাঁজ করে বসেছে।ধারা বললো,

——“আপনাকে বিপদে ফেললাম ঘুরতে এসে।বার বার বিভিন্ন প্রবলেমে পড়ছেন।”

বিভোর হেসে বললো,

——“আমি একা তুমি বলবো?তুমি কি ‘তুমি’ বলবেনা?”

ধারা পিজ্জায় কামড় বসিয়ে বললো,

—–“চেষ্টা করবো।”

——“কালতো ফিরে যাচ্ছি।তো কই যাবে?রাজশাহী নাকি দিশারির বাসায়?”

——“আপুর বাসায়।”

কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা।বিভোর কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।এখানেও যখন তখন বৃষ্টি হয়।একটা জানালা খোলা।বিভোর লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল।ধারা মানা করে।বিভোর কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,

—–“আসি।”

—–“এখনি চলে যাবেন?থুক্কু যাবা?বসোনা। অনেক ঘুমিয়েছি এখন ঘুম আসছেনা।কিছুক্ষণ গল্প করি?”

—–“আমি গল্প করতে পারিনা।”

—–“আচ্ছা আমি যা প্রশ্ন করি জাস্ট উত্তর দিয়েন।”

—–“আবার আপনি বলছো।”

ধারা মৃদুস্বরে বললো,

——“চেষ্টা করছি।অভ্যেস চেঞ্জ হতে সময় লাগে।”

বিভোর জবাবে হাসলো।ধারা প্রশ্ন করলো,

——“তোমার প্রিয় খাবার কি?”

——“সব।যখন যা সামনে পাই তাই প্রিয় মনে হয়।”

——“ইন্টারস্টিং!আচ্ছা প্রিয় গান?”

——“নতুন সব গানই প্রথম দু’দিন প্রিয় মনে হয়।”

ধারা হাসে।আবার প্রশ্ন করে,

——“প্রিয় খেলা?”

——“ফুটবল ভালো লাগে।তবে প্রিয় না।”

——“আচ্ছা,প্রিয় মানুষ?”

——“কাছের সব মানুষই প্রিয়।”

——“দারুণ,প্রিয় শখ?”

——“পাহাড় চড়া।”

ধারা যদিও জানে বিভোরের প্রিয় রং কি।তবুও জিজ্ঞাসা করলো,

——“প্রিয় রং?”

বিভোর নখ কামড়ে মুচকি হাসে।এরপর বললো,

——“তুমিতো রীতিমতো ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করেছো।”

——“গল্প করছি।’

——“আচ্ছা বলছি,প্রিয় রং আকাশি তবে কালোও ভালো লাগে।”

——“প্রিয় অভ্যাস?”

বিভোর কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

——-“সরি!এটা বলতে পারছিনা।”

——-“আচ্ছা রং,খেলা,খাবার,প্রিয় মানুষ,শখ,অভ্যেস সব মিলিয়ে কি সবচেয়ে ভালো লাগে?মানে পৃথিবীর কোন জিনিষটা সবচেয়ে পছন্দ?”

——-“বৃষ্টি দেখা,বৃষ্টিতে ভেজা আমার সবচেয়ে ভালো লাগার মুহূর্ত।সব ভালো লাগার উর্ধ্বে বৃষ্টি।আম্মা বলে,আমি নাকি একদম বাচ্চা থেকেই বৃষ্টি পছন্দ করি।বৃষ্টি হলে ঘরে থাকতেই পারতামনা।এখন অবশ্য পারি।কিন্তু বৃষ্টির চেয়ে সুন্দর দৃশ্য দুনিয়াতে দু’টো নেই।অন্তত আমার কাছে।বৃষ্টি মানে সুখ,বৃষ্টি মানে প্রেম।বৃষ্টি পৃথিবীকে নতুন প্রাণ দেয়।”

ধারা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে বিভোরের দিকে।বৃষ্টি সে একদমই পছন্দ করেনা।অন্য মেয়েদের বৃষ্টি ভালো লাগে শুনেছে।তবে,একজন ছেলের এতো ভালো লাগতে পারে ভাবেনি।যতক্ষণ বিভোর বৃষ্টি নিয়ে কথা বলেছে কন্ঠে যেন কি ছিল।ধারা বললো,

——“এতো প্রিয় বৃষ্টি?”

বিভোর তাকায়।হালকা আলোয় বিভোরের দৃষ্টি অচেনা মনে হলো।তবে আকর্ষণীয়।বিভোর বললো,

——“হুম।আচ্ছা তুমি ঘুমাও আমি আসি।”

বিভোর বিছানা থেকে নেমে জুতা পরে।ধারার ইচ্ছে হচ্ছে ঝাঁপিয়ে ধরে আটকে রাখতে।কিন্তু পারছেনা।বিভোর কেনো সরাসরি প্রকাশ করছেনা,সে ধারাকে  ভালবাসে।ধারা নিজেও বলতে পারছেনা।সে অনেক বেশি ভালবেসে ফেলেছে বিভোরকে।বিভোর বের হবার আগে তাকায়।দেখে ধারার চোখ দু’টিতে জল চিকচিক করছে।বিভোর উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো,

——-“ধারা কাঁদছো?”

ধারা দ্রুত চোখের জল মুছে।আমতা-আমতা করে বলে,

——“না মাথাটা একটু ব্যাথা।তাই জল পড়ছে।”

বিভোর এগিয়ে আসে।ধারার পাশ ঘেঁষে বসে।ধারা হকচকিয়ে যায়।বিভোর ধারার হাতটা ধরে।ধারা ঠাওর করতে পারছেনা বিভোরের ভেতরে কি চলছে।বিভোর আলতো করে ধারার হাতে চুমু দেয়।ধারার চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ে।বিভোর ধীরকন্ঠে বললো,

——“আমি দ্রুত চেষ্টা করবো সব ঠিক করার।”

বিভোর বেরিয়ে যায়।ধারা কথাটার মানে বুঝার চেষ্টা করছে।কিসের দ্রুত চেষ্টা?বিভোর কোন অদৃশ্য দেয়ালের তাড়নায় নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে?কে জানে।তবে,বিভোর ভালবাসে তাঁকে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

_____________________________________________

পরদিন বিকেলে নিজ দেশের রাজধানীতে পা রাখে ওরা।পথে ধারা অনেকবার লুকিয়ে কেঁদেছে।কতদিন বিভোরকে ছাড়া থাকতে হবে কে জানে।বিভোর ধারার বিষণ্ণতা খেয়াল করেছে।তাঁর নিজের মনটাও তেঁতো হয়ে আছে।নিজের বড় ভাই বাদলের কাছে যা শুনে,এতে সে এইটুকু বুঝেছে দুই ফ্যামিলি সহজে এক হবেনা।দিশারির বাসার সামনে এসে সিএনজি থামে।ধারার পা দু’টি স্তব্ধ হয়ে আসে।এখানেই তাহলে গন্তব্য শেষ।তাঁর গলায় দলা পেকে ঘুরপাক খেতে থাকে কান্না।ছলছল চোখে বিভোরের দিকে তাকায়।বিভোর তাকাচ্ছেনা।দিশারি সায়নকে একবার জড়িয়ে ধরে।তারপর বললো,

——“বাসায় ঢুকেই কল করবি।”

—–“তুমি বল।”

—–“আচ্ছা তুমি।আর তোর ফেসবুক পাসওয়ার্ড, ইন্সটাগ্রাম পাসওয়ার্ড মেসেজে পাঠাবি।”

সায়নের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে যায়।দিশারি চোখ পাকিয়ে বলে,

——“কথা না শুনলে তোরে কাঁচা চিবামু সায়ইন্নে।”

——“ছিঃ হবু বরকে কেউ এভাবে বলে?”

——“তাইলে পাসওয়ার্ড টা পাঠিয়ে দিও বাবুতা আমি আর এভাবে কথা বলবনা।”

সায়ন সরু চোখে দিশারিকে দেখে।তারপর মুচকি হেসে কপালে চুমু দিয়ে বলে,

—–“আগের অনেক মেয়ের সাথে চ্যাট আছে।ওসব দেখে মন খারাপ করবিনা।আর কথা বলবনা প্রমিজ।”

দিশারি মাথা নাড়ায়।সায়ন সিএনজিতে বসে।

দিশারি ধারার হাতে ধরে নামায়।ধারা আরেকবার তাকায় বিভোরের দিকে।বিভোর অন্যদিকে ফিরে বসে আছে।ধারা দ্রুত গেইটের ভেতর ঢুকে পড়ে।সিএনজি গুলশানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।ধারার পুরো মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছে।কি হলো তাঁর।এতো এলোমেলো লাগছে কেনো নিজেকে।কি করবে বুঝে উঠছেনা।রাগে কেডস খুলে ফেলে।দিশারি ধমকায়,

——“কিরে জুতা খুলছস ক্যান?”

ধারা তাকায়।দিশারি আৎকে উঠে। ধারার চোখ জলে টুইম্বুর।এবং লাল।ধারা কিছু না বলে উল্টো দৌড়াতে থাকে।দিশারি কেডস হাতে নিয়ে পিছুন ডাকে,

——“ধারা কই যাস।কি হইছে তোর?”

ধারা গেইট থেকে বের হয়ে ভাবে সিএনজিটা কোনদিকে গেলো।এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে।ডান পাশের রাস্তার শেষ মাথায় লেদারের জ্যাকেট পরা বিভোরকে দেখতে পায়।বিভোর দ্রুত পা ফেলে এদিকেই আসছে।ধারা বিভোরের দিকে দৌড়াতে থাকে।বিভোর ধারাকে দেখে আরো দ্রুত হাঁটছে।দিশারি বিভোরের চেয়ে কিছুটা দূরত্বে সায়নকে দেখতে পায়।সায়ন বিভোরকে ডাকছে।বিভোরকেও এলোমেলো,বিধ্বস্ত লাগছে।হলোটা কি এদের?

দুজন দ্রুতগামী বিধ্বস্ত মানুষ দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে।শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।ধারা আওয়াজ করে কেঁদে উঠে।বিভোর জড়ানো গলায় বলে,

——-“ভালবাসি তোমায়।আমার শূন্য ভরা খরা হৃদয়ে বৃষ্টি হয়ে নামো ধারা।”

বিভোরের এমন হৃদয়স্পর্শকর প্রপোজে ধারা রোমাঞ্চিত হয়ে আরো শক্ত করে খামচে ধরে বিভোরকে।উত্তর দেয়,

——-“ভালবাসি।অনেক বেশি ভালবাসি।তোমাকে ছাড়া থাকা সম্ভব না।প্লীজ সাথে নিয়ে চলো।”

বিভোর ধারাকে বাঁধন থেকে আলগা করে দেয়।ধারার চোখের দিকে তাকায়।ধারাও তাকায়।বিভোর দু’হাতে ধারার দু’চোখের জল মুছে দেয়।তারপর কপালে চুমু দিয়ে বললো,

——–“চলো।”

দিশারি সায়ন হতভম্ব।সায়ন দিশারিকে বলেছে, বিভোর মোড়ে গিয়ে সিএনজি ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে তারপরই এদিকে দৌড়াতে থাকে।

চলবে…….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *