পক্ষীকূজনে মুখরিত চারপাশ।আকাশটা সাদা মেঘে ভরা।মনে হচ্ছে আজ মেঘের দেশে মেলা বসেছে। সাথে শীতকালীন তাপহীন সূর্যটা খাম্বার মতো নিজ স্থানে বসে রয়েছে।পলকহীন নেত্রে কিয়ৎক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো উৎস।মুখায়ব অন্যদিনের তুলনায় ভীষণ গম্ভীর।কেমন গম্ভীর স্বরেই আওড়ালো,‘‘ আজকের আকাশটা ভীষণ সুন্দর।’’
পাশে বসে থাকা শাওন ফিরে তাকালো উৎসর দিকে । উৎস এখনও আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে। শাওন কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত ঘটলো অষ্টাদশী এক মেয়ের। নির্জন এই জায়গাটাই দুজন পুরুষের মাঝে নিজের উপস্থিতি নিয়ে কিঞ্চিৎ ভরকালো মেয়েটা। দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিচু স্বরেই বললো,‘‘ আপনাদের খাওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে মামি।’’
শাওন তাকালো মেয়েটার দিকে।গ্রামের মানুষের মুখে শুদ্ধ বাংলা শুনতে পেলে,যে ব্যক্তির মুখ হতে নিঃসৃত হয় বাক্যগুলো সেই ব্যক্তি কিছুটা হলেও আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হবে সবার মাঝে। শাওন মেয়েটিকে ভালোভাবে দেখা শুরু করলো মেয়েটিরই অগোচরে। চিকন পাতলা গায়ে সুতির থ্রি-পিস পড়া, ওড়নাটা খুব শালীনভাবে জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে।আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মেয়ের মতোই মেয়েটা।তবে শ্যামলা মুখশ্রীর আননে মায়া মায়া একটা ভাব পরিলক্ষিত।নামটা তৎক্ষনাৎ মনে পড়লো না শাওনের। নির্জনের মামাতো বোন এই মেয়ে। মেয়েটার বাবা মা নাকি মারা গেছে অনেক বছর আগে। এরপর থেকে মামা বাড়িতেই থাকে। উৎস নিরুত্তর থাকলেও শাওন মেয়েটার দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো,‘‘ তুমি যাও আমরা আসছি।’’
মেয়েটা মাথা নিচু করেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো । যেন খুব অস্বস্তিবোধ করছিলো।শাওন পুনরায় উৎসর দিকে তাকালো,‘‘ খেতে চল।নাকি এখানেই আজ ধ্যানে বসবি?’’
‘‘ তুই যা আমি আসছি।’’
এতক্ষণ বাড়ির পেছন দিকে কাঠের বেঞ্চিতে বসে ছিলো দুজন।বেঞ্চ থেকে শাওন উঠে দাঁড়ালো। উৎসকেও টেনে দাঁড় করালো।উৎস বিরক্ত হলো বটে তবে নিজেও শাওনের পিছু পিছু গেলো।বাড়িটা পাকা নয় বরং টিনের তৈরি ছোট বাড়ি। ভেতরে দুইটি রুম। রুম দুটোর পাশেই ছোট্ট রান্নাঘরটা। আর বাড়ির বাম পাশে কয়েক কদম হেটে গিয়ে একটা টয়লেট। উঠোনের পাশে ফুলের গাছ আর সবজির গাছ লাগানো হয়েছে।উঠোনের মাঝ বরাবর রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে গেলে এই বাড়িটা বেষ্টিত করে রাখা বেড়া যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে বাঁশ দিয়ে একটি ছোট্ট গেইট।আর সামনেই রাস্তা।এই বাড়িটার আশেপাশে বাড়িঘর নেই।সব বাড়িঘর দূরে দূরে।এই ভিটে জমি নিয়ে নাকি গ্রামের চেয়ারম্যানের পরিবারের সাথে অনেক ঝামেলা হয়েছিলো নির্জনদের।এখন অবশ্য ঝামেলা মিটে গেছে তবুও নির্জনের ফ্যামিলি খুব সাবধানেই চলাফেরা করে।
বাড়ির ভেতরে আসতেই নিহাল, নির্জন, বিশাল আর নির্জনের বাবাকে বসে থাকতে দেখা গেলো।নির্জনের বাবার নাম নাজিব। বৃদ্ধ হলেও এখনও যে অনেক কর্মঠ সেটা উনার টানটান শরীর দেখলেও বোঝা যায়। উৎসদের আসতে দেখেই ফোকলা দাত বের করে হাসলেন আর সুন্দরভাবে বললেন,‘‘ আসো বাপ আসো।গরিবের ঘরে দুমুঠো ভাত খাও আইজ। বেশিকিছু আয়োজন করবার পারি নাই বাবা।গরিব মানুষ আমরা কষ্ট করে কয়েকটা দিন থাইকো।’’
উৎস হেসে বললো,‘‘ এভাবে বলবেন না চাচা। গ্রামের টাটকা টাটকা সব খাবার দাবার আর পরিবেশ। আমরা তো এতেই অনেক খুশি।আপনাদের সাথে কিছুদিন থাকতে পারলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।।’’
তৃপ্তির হাসি হাসলেন নাজিব সাহেব।উৎসর কথাটা মনে ধরলো খুব।তখনই নির্জনের মা কয়েকটা স্টিলের প্লেট নিয়ে হাজির হলেন।একে একে বিভিন্ন তরকারির বাতি নিয়ে হাজির হলেন উনারা।ছেলে আসবে শুনেই সকালে বাজার করতে গিয়েছিলেন। আজ বাজারের দিন না হওয়ায় বেশিকিছু না পেলেও যা পেয়েছেন তাই এনেছেন।বাড়িতে আসতেই স্ত্রীকে আদেশ দিয়েছেন সবকিছু খুব সুন্দর করে রান্নাবান্না করার।বাড়িতে যে আজ বড় বড় মানুষ আসবে।
উৎস আলাদা করে এলেও বাড়িতে এসেছে সবাই একসাথে মিলেই।উৎসর জন্যই শাওন,নিহাল, নির্জন অপেক্ষারত ছিলো একটি জায়গায়। পরে উৎস তাদের সাথে যোগ দিয়ে একসাথে সকালের নাস্তা সেড়েই নির্জনদের বাড়িতে এসেছে।
কচু পাতা ভর্তা,আলু ভর্তা,বেগুন ভাজা, লাউ দিয়ে চিংড়ি মাছের তরকারি, তেলাপিয়া মাছ ভাজা আর গরম গরম সাদা চিকন চাউলের ভাত।নাজিব সাহেব ছেলেদের কথা চিন্তা করেই বাজার থেকে চিকন চাউল কয়েক কেজি কিনে এনেছেন আজ।অবশ্য নির্জনই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলো। এই কয় পদই রান্না করেছেন নির্জনের মা। মুচকি হেসে শুধালেন,‘‘ বেশি কিছু রান্না করবার পারি নাই বাপ। তোমরা এইগুলা দিয়াই আইজকা খাও।’’
এবার নিহাল বললো,‘‘ চাচী আপনারা এতো ব্যতিব্যস্ত হবেন না। যেগুলো করেছেন এসবই আমাদের জন্য অনেক।’’
নির্জনও বললো মা–কে,‘‘ হ্যা মা।তোমরা এতো চিন্তা করো না। তুমিও খেতে বসো আমাদের সাথে।’’
অন্তরার দিকে তাকিয়ে বললো,‘‘ এই অন্তরা, তুইও খেতে বোস।’’
নির্জনের মাও বললো,‘‘ হ্যা রে মা তুইও খাইতে ব।সকাল থাইকা তো কিচ্ছু খাস নাই।’’
শাওন আবারও একবার তাকালো অন্তরার দিকে। অন্তরা! মেয়েটার নাম অন্তরা এই মুহুর্তে এসে মনে পড়লো।এদিকে উৎসর পাশে বসা বিশালের জিবে জল চলে আসলো।পাতে ভাত পড়তেই হাত ধুয়ে নিজে থেকেই বেগুন ভাজা নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। বিশালের এহেন কাজে উৎস গম্ভীর দৃষ্ট ফেললো বিশালের দিকে।বিশাল দাত কেলিয়ে হাসলো। সবাই খেতে বসলো।আর খাওয়ার মাঝেই খাবার নিয়ে নানা মন্তব্য করলো সুস্বাদু হওয়ার জন্য। শুধু চুপচাপ খেয়ে গেলো উৎস।সে কিছু একটা বিষয়ে চিন্তিত থাকায় এতো কিছুতে ধ্যান নেই একমনেই খেয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে।তখনই ঝংকার তুলে নিহালের ফোনে কল আসলো।খাওয়ার মাঝে নিহাল বিরক্ত হলো কিছুটা।প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো রূপক কল করছে।কল রিসিভ করতেই রূপক ঝাড়লো নিহালকে,‘‘ উৎস কই?’’
‘‘ খায়।’’
‘‘ কি বা*ল খাইতাছে যে ফোন দিলে পাওয়া যায় না?’’
নিহাল এক লোকমা মুখে পুরেই জবাব দিলো,‘‘ তুই- ই জিজ্ঞাসা কর কি বা*ল খাইতাছে।’’
ওর এমন কথায় মুহুর্তেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।উৎস কপাল কুঁচকে তাকাতেই নিহাল বললো,‘‘ রূপক কল করেছে, তোকে খুঁজছে।’’
নিহাল ফোনটা বাড়িয়ে দিতেই উৎস কানে ধরে রূপককে ‘লাইনে থাক’ বলে সকলের মাঝে কথা বলাটা আর ঠিক হবে না ভেবে বাকি ভাত মুখে পুড়ে কোনোরকম উঠে বেরিয়ে গেলো।বাইরে গিয়ে টিউবওয়েল এর হাতলে চাপ দিয়ে পানি গড়িয়ে হাতটা ধুয়ে নিলো।মাথা দিয়ে কাঁধে চেপে রাখা ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,‘‘ এখন বল।’’
‘‘ শিমু কোথায়?’’
‘‘ জানি না।’’
‘‘ দেখ উৎস আ’ম সিরিয়াস।’’
‘‘ আমিও সিরিয়াস।’’
দীর্ঘশ্বাস ফেললো রূপক।কথা ঘুরিয়ে বললো,‘‘ উচ্ছ বাড়িতে গেছে।আর এদিকে আমি কুমিল্লার রাস্তায়।’’
কথাটা শুনে রেগে গেলো উৎস।একজন এসপি অফিসার হয়েও কিভাবে কাঁচা বুদ্ধি নিয়ে চলে এই ছেলে।বাড়ির লোকদের কিভাবে একা রেখে আসলো ওই সাইকোপ্যাথের সাথে?ধমকে বললো,‘‘ কোন আক্কেলে তুই কুমিল্লা আসছিস? তাও আবার শেয়ালের কাছে মুরগি পাহারা দিয়ে?’’
‘‘ আহা টেনশন নিস না তৌশিককে রেখে এসেছি। ও প্রটেক্ট করবে। এখন এটা বল ট্র্যাকার আর ওই ডিভাইসটা কি নিয়ে গেছে ?’’
‘‘ তোর ওই হাদারাম কি বা*লের প্রটেক্টটাই না করতে পারবে? তুই না এসপি অফিসার এতো কাঁচা ব্রেইন নিয়ে চলিস কিভাবে?রাখ ফোন।’’
বলেই কল কেটে দিলো উৎস।এদিকে বিশাল হাত ধুতে ধুতে বললো,‘‘ কি হইছে? এত ধমকা ধমকি করিস কেন?রূপক এসপি অফিসার সম্মান দে শালা।’’
উৎস গুরুত্ব দিলো না।প্যান্টের পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে কাউকে কল করলো।বিশাল লুঙ্গি পড়ে ছিলো। শুধুই বিশাল না বাকিরাও লুঙ্গি পড়েছে উৎস বাদে।বিশাল তোয়ালে হাত মুছতে মুছতে বললো,‘‘ উৎস মশাই একদিন লুঙ্গি পড়লে আপনার জাত যাবে না।ভেতরে একটা ছেড়া লুঙ্গি আছে দেখলাম।একদম মেইন জায়গায় ছেড়া, ওটা পড়ে নে হেব্বি মানাবে।’’
উৎস ফোন কানে ধরে দাঁড়িয়ে বিশালের সব কথাই শুনলো।নিহালের ফোনটা ছুড়ে মারলো বিশালের দিকে। বিশাল দারুণ ক্যাচ ধরলো। দাত কেলিয়ে হেসে বললো,‘‘ আমি অনায়াসেই একজন দারুণ বোলার হতে পারি।তবে প্রফেশন হিসেবে আমার চলমান প্রফেশন নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’’
বলেই ভেতরে চলে গেলো।এখানে থাকলে এই উৎস নির্ঘাত কিছু করে বসবে ওকে। উৎস লাগাতার কাউকে ফোন দিতে থাকে।তৃতীয় বারে অপরপ্রান্ত হতে ফোন রিসিভ করতেই গম্ভীর স্বরে বলে,‘‘ কি এমন কাজ করছিলে? যে ফোন রিসিভ করতে এতো সময় লাগলো?’’
অপরপ্রান্ত হতে উত্তর এলো,‘‘ সরি স্যার।ফোন ভাইব্রেট ছিলো।’’
‘‘ তালুকদার বাড়ি যাও ইমিডিয়েটলি।’’
‘‘ ওকে স্যার।’’
উৎস ফোন পকেটে ঢুকিয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো। নিহাল হাত ধুচ্ছিলো।হাত ধুয়ে টিস্যুতে হাত মুছে মুখ মুছে উৎসর সামনে এসে দাড়ালো,‘‘ কি অবস্থা?’’
উৎস কপাল কুঁচকালো।বুকে দুহাত গুজে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো পেছনে নিম্নে ঠোঁট উঁচিয়ে ফু দিয়ে সড়িয়ে দিলো আর ঢিমে আওয়াজে উত্তর দিলো,‘‘ অবস্থা খুব একটা বেগতিক কিংবা শোচনীয় না হলেও ভীষণ ইন্টারেস্টিং পার্টে আছে।’’
‘‘ মাথায় কিছু চলছে নাকি?’’
‘‘ চলে তো সবসময়ই।আফটার অল আমার প্রফেশনটাই তো এমন।মাথায় সবসময়ই নতুন নতুন কিছু উদ্ভট আইডিয়া আসবে এটাই স্বাভাবিক।’’
নিহাল ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়লো।উৎসর কাঁধে হাত রেখে বলে,‘‘ দেখ ভাই শিমু যে পরিমাণ চালাক তাতে মনে হয় না ও তোকে চিনতে পারে নি।’’
উৎস হেসে উঠলো,‘‘ কে বলেছে ও আমাকে চেনে না।আমার সাথে দেখা হওয়ার দিনই তো চিনে গেছে। এত বোকা শিমু নয়।’’
তখনই তিন চারজন মেয়েকে গেইট খুলে ভেতরে আসতে দেখা গেলো।খুব হাসি-রঙ্গে, হাত নাচিয়ে কথা বলে বলে আসছে।উৎসদের দেখে মেয়েগুলো একটু থেমে যায়।এবার কেমন ফুসুর ফুসুর করে কথা বলা শুরু করলো আর মুচকি মুচকি হাসছে। উৎস সেসব পাত্তা না দিয়ে আবারও বাড়ির পেছনে চলে গেলো।নিহাল মেয়েগুলোকে একবার দেখে নিজেও চলে গেলো।মেয়েগুলো বাইরে থেকেই অন্তরাকে ডাকা শুরু করলো।
‘‘ অন্তরা, এই অন্তরা।কই গেলি রে?আয় তো নদীর পাড়ে যায় একটু।তোর লগে কথা আছে আমগোর।’’ সবার সামনে বেশ দামী পোশাক পরিহিত সেই মেয়েটি ডাকলো অন্তরাকে।শাওন খাওয়া শেষে বের হয়ে হাত ধোয়ার জন্য বের হচ্ছিলো পেছন পেছন অন্তরাও আসলো।শাওন দেখলো অন্তরাকে।আর উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েগুলোকেও দেখলো। শাওন টিউবওয়েলের সামনে যেতেই শুনতে পেলো মেয়েগুলো ফুসুরফুসুর করে অন্তরাকে বলছে,‘‘পুলা গুলা কত্ত হ্যান্ডসাম।আমি তো ক্রাশ খাইয়া ফালাইছি।অন্তরা ওইযে হাত ধুইতাছে ওই পুলার নাম কি রে?’’
পাশে দাঁড়ানো আরেকজন বললো,‘‘ এইডার থেইকা ওইযে প্যান্ট পড়া আছিলো ওই পুলায় বেশি সুন্দর।ওইডার নাম কি?আমগোর লগে সেটিং করায় দে অন্তরা।তোর থেইকা আজকা আমার পাওনা টাকা নিবার আইছিলাম, তাইলে হেই টাকা আর দেওন লাগবো না।’’
স্পষ্ট শুনতে পেলো শাওন।এদিকে অন্তরাও বুঝলো শাওন হয়তোবা শুনেছে।লজ্জায় মাথা নিচু করলো। আরিফা এই গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে।এক কলেজেই পড়ে সবাই।কলেজের পরীক্ষার ফি তিনশো টাকা হারিয়ে ফেলছিলো অন্তরা বাড়িতে জানাতে ভয় পাওয়ায় আরিফাই নিজের টাকায় ফি জমা দিয়ে দেয়। বলেছিলো পরে ফেরত দিতে।এইদিকে অন্তরা টাকা জমাচ্ছিলো আরিফাকে ফেরত দেওয়ার জন্য।কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ টাকাটা জমা হয় নি।তাইতো মাঝে মাঝেই এভাবে বলে আরিফা সবার সামনে।এতে লজ্জায় পড়ে যায় অন্তরা। শাওন হাত ধুয়ে এসে দাঁড়ালো অন্তরার পাশে।মেয়েগুলো তো মহাখুশি।চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে এমন ভাব।অন্তরা বুঝলো পাশে এসে কেউ দাড়িয়েছে।চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো শাওনকে। শাওন তারই দিকে তাকিয়ে ছিলো।এই লোকটাকে দেখলে অন্তরার কেমন যেন একটা অনুভুতি হয়। লোকটা শ্যামবর্ণের হলেও কি ভীষণ মায়াবী মুখের আদল।তীক্ষ্ণ গম্ভীর চোখ,সোজা খারা নাক, খয়েরি ঠোঁটজোড়া, প্রশস্ত বুক, টানটান লম্বাটে দেহ। দেখলেই আলাদা শিহরণে শরীরটা সেই সকাল থেকেই ঝিম মেরে রয়েছে।
এত চঞ্চল শাওন অন্তরাকে দেখলেই কেমন চুপচাপ হয়ে যায়।এইযে সকাল থেকেই বন্ধুদের সাথে একটা মজাও করে নি।মেয়েটার প্রতি একটা আলাদা মায়া কাজ করে তার।শাওন এবার সামনে তাকালো। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে বললো,‘‘ অন্তরার থেকে কত টাকা পাও তুমি?’’
অন্তরা লজ্জা পেলো ভীষণ।এসব কথা জিজ্ঞাসা করার কোনো মানে হয়?অচেনা একজন যুবক কিনা তার বান্ধবীর কাছে এসব কথা জিজ্ঞাসা করছে। লজ্জায় মাথাটা আরও নুচে নামালে থুতনি গলার নিচে স্পর্শ করলো।এদিকে আরিফা তো অনেক খুশি। নিজেকে ধনী পরিবারের বোঝাতে হেসে বললো,‘‘ তিনশো টাকা পায়।আমি মাঝেমধ্যেই গরীব দুঃখীদের এভাবে টাকা দিয়ে থাকি।’’
‘‘ দিয়ে পরে আবার ঠিকই ফেরত নাও।’’
থতমত খেয়ে গেলো আরিফা।অন্তরাও বিস্মিত চোখে শাওনের দিকে তাকালো।কোমড়ের বাম পাশে লুঙ্গির সাথে গুজে রাখা ওয়ালেটটা বের করে চকচকে তিনটে একশো টাকার নোট বের করে আরিফার মুখের সামনে ধরলো আর বললো,‘‘ এই নাও তোমার পাওনা টাকা।এবার তোমরা যেতে পারো মেয়ে।’’
এটা দেখে অন্তরা চমকে গেলো।এটা কি করছেন এই লোক।বিরোধিতা করে বলে উঠলো,‘‘ এসব কি করছেন আপনি? আমিই দিয়ে দেব টাকাটা।আপনি অতিথি…’’
শাওন নিজের ঠোঁটে তর্জনী চেপে ধরে বললো,‘‘ হুশ কোনো কথা নয়।’’ সামনের দিকে আরিফাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললো,‘‘ নাও টাকাটা নাও আর এখান থেকে বিদায় হও।’’
আরিফাও নির্লজ্জের মতো টাকাটা নিয়ে বান্ধবীদের নিয়ে ঝামটা মেরে মুখ ভেংচে চলে গেলো।শাওন বাড়ির পেছনে চলে যেতে নিলেই অন্তরা বললো,‘‘ এটা কি করেছেন আপনি? আমিই দিয়ে দিতাম। দরদ দেখালেন নাকি?’’
শাওন পেছনে ঘুরে তাকালো।এইটুকু মেয়ের এমন কথা বেশ মজা লাগলো তার।দুহাত পেছনে পিঠের কাছে মুষ্ঠিবদ্ধ করে অন্তরার আরও কাছে এসে বললো,‘‘ ধরে নাও তাই।’’
অন্তরা পিছিয়ে গেলো আর মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে গম্ভীরভাবে বললো,‘‘ আগামীকালকেই আপনার টাকা ফেরত দিয়ে দেব আমি।আর এমন দরদ না দেখানোই উত্তম।’’
শাওন হাসলো আরেকটু এগিয়ে গিয়ে অন্তরার দিকে ঝুকে বললো,‘‘ মানুষটা যদি তুমি হও তাহলে আমি বার বার দরদ দেখাবো।’’
বলেই অন্তরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেলো।তখনই আবার বিশাল, নির্জন বেরিয়ে এলো। অন্তরাকে মুখ ফুলিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নির্জন বললো,‘‘ এই অন্তরা তুই ওখানে কি করছিস?মা তোকে ডাকছে। ’’
অন্তরা ধুপধাপ পায়ে তাদের পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেলো।বিশাল সেদিকে তাকিয়ে নির্জনকে বললো,‘‘ এ তো দ্বিতীয় আশিন।’’
নির্জন জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ আশিন কে?’’
‘‘ ওইযে ডাক্তার আপা, আর উৎসর ভালোবাসা।’’
কথাটা বলে দুজনেই হাসলো।তারাও বাড়ির পেছনের দিকে আসলো।উৎস হেলান দিয়ে বসে ছিলো।নিহাল ফোনে কথা বলছে আর শাওন আম গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।বিশাল গিয়ে ধপ করে উৎসর পাশে বসে পড়লো উৎসর কাঁধে চাপড় মেরে টিপ্পনী কেটে বললো,‘‘ মামা তোমার আশিনরে মনে পড়তেছে না?’’
শাওনও এবার নিজের রূপে ফিরে এলো আর রসিকতা করে বললো,‘‘ বুকটা চিরে দেখো উৎস মশাইয়ের বুকে কতো হাহাকার।’’
নির্জন, বিশাল হো হো করে হেসে উঠলো।নিহাল কথা বলার সময় শাওনের কথা শুনে নিজেও হেসে উঠলো।উৎস কাঁধ থেকে বিশালের হাতটা সড়িয়ে দিয়ে রাগত স্বরে বললো,‘‘ বাজে বকা বন্ধ কর তোরা।কাজের কথা বল।’’
‘‘ কাজের কথাতেও যে ড. আশিনই থাকে।’’
বলে আবারও হাসলো সবাই।উৎস প্রচন্ড বিরক্ত এই ছেলেগুলোকে নিয়ে।এত বড় বড় দামড়া যুবক আর এতো ক্রিটিকাল একটা সময়ে নাকি তারা মজা করছে।উৎস দাতে দাত চেপে বলে,‘‘ তোদের সবগুলারে জেলে ঢুকাবো আমি।’’
_____________________________
তন্নি জানতো না তাকে উচ্ছ দেখে ফেলেছে।সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে রূপকের নাম্বারে কল লাগায়। রূপকও কল রিসিভ করে।তন্নি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,‘‘ রূপ ভাই,তুই কোথায়? উচ্ছ ভাই উনার স্ত্রী রেহানাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছে।আমি খুব ভয় পাচ্ছি ভাই।ভাই তুই কিছু কর না।ও ভাই কই তুই?’’
রূপক বোনের এমন উৎকণ্ঠিত আওয়াজ আর হাঁপানোর শব্দ শুনে চিন্তিত হয়েছিলো তবে এটা ভয়ে রূপ নিলো যখন তন্নির পুরো কথাটা শুনলো।কি বলবে বুঝতে পারছে না।কিছুক্ষণ ভেবে বললো,‘‘ তুই কি দেখেছিস উচ্ছকে?বা বলতে শুনেছিস?’’
‘‘ হ্যা ভাই।ও বাগানের ওদিকে কথা বলছিলো।আমি শুনেই চলে এসেছি।’’
রূপক চিন্তিত হলো।তন্নিকে আবার দেখে ফেলে নি তো?চিন্তিত আওয়াজে জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ তোকে দেখতে পেয়েছে?’’
‘‘ না আমায় দেখে নি।’’
‘‘ এক কাজ কর, মায়ের কাছে যা।’’
‘‘ ভাই মা বাড়িতে নেই।বাড়িতে কেউ নেই।শুধু আমি, রেহানা আর দাদী আছি।’’
রেগে গেলো রূপক।বাবা মায়ের ওপর রাগ উঠলো অনেক,‘‘ কোথায় গেছে মা?তোকে এভাবে একা রেখে?তৌশিক কোথায়?ওকে দেখিস নি?’’
‘‘ মা বাবার দোকানে গিয়েছে।আর বড় বাবা,ছোট বাবাও পার্টি অফিসে গেছে।আর তৌশিক উনাকেও তো দেখলাম না।’’
রূপক খুব চিন্তিত হয়ে পড়লো,‘‘ আচ্ছা তুই তোর নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে থাক।দরজা একদম খুলবি না।আমি কিছু একটা করছি।’’ বলে কল কেটে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে কল লাগালো তৌশিকের নাম্বারে। তৌশিকের ওপর রাগ হচ্ছে প্রচুর।ওকে বাড়িতে থাকতে বলেছিলো রূপক।কিন্তু এই ছেলে গেছেটা কোথায়?তৌশিক হোটেলে এসেছে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য।ফোনে কল আসতেই রূপকের নাম্বার দেখে তৎক্ষনাৎ রিসিভ করে বললো,‘‘ হ্যালো স্যার আপনি ঠিকমতো পৌঁছেছেন তো?’’
‘‘ হাদারাম একটা।তোমায় বাড়িতে থাকতে বলেছিলাম এখন কোথায় তুমি?’’
তৌশিক খেতে খেতেই জবাব দিলো,‘‘ স্যার দুপুরের খাবার খেতে এসেছি।’’
‘‘ এই মুহুর্তে বাড়ি যাও তৌশিক।বাড়িতে গিয়ে খাও। উচ্ছকে চোখে চোখে রাখতে বলেছিলাম তোমায়।কাজে হেরফের করলে জানে মেরে ফেলবো।’’
‘‘ সরি স্যার।আর জীবনেও দুপুরে খাব না।আমি এখনই যাচ্ছি।’’
রূপক কল কেটে দিলো।তবুও ভীষণ চিন্তিত থাকলো।উৎসর নাম্বারে কল দিলো।কল রিসিভ হতেই উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,‘‘ উচ্ছ নাকি রেহানাকে মারার প্ল্যান করছে।তন্নি শুনে ফেলছে কথাটা।এখন আমার খুব চিন্তা হচ্ছে বাড়ির মানুষদের জন্য।’’
উৎস বেঞ্চিতে বসেই চুপ করে বড় একটা শ্বাস নিলো।চিন্তিত মুখশ্রীতে আরও চিন্তা ভর করলো। ধমকে বললো,‘‘ তোকে বলেছিলাম তুই বাড়িতেই থাক।বা*ল পাকনামীর জায়গা পাও না।কারোর যদি কিছু হয় রূপক, খোদার কসম তোকে ট্রিগার পয়েন্টে রেখে শ্যুট করবো।’’
রূপক সেসব গুরুত্ব দিলো না।বরং বেক্কলের মতো জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ উচ্ছ কি আসলেই আমাদের ভাই?’’
এমন ফালতু রকমের কথা শুনে মুহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো উৎসর।কল কেটে দিলো।এইটা কি মশকরা করার সময় নাকি?যেখানে বাড়ির মানুষ জানের সংশয়ে আছে।মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুজে বসে থাকলো উৎস।নিহাল পাশে বসে বললো,‘‘ আমাদের সবার এখানে আসা উচিত হয়নি। একজনের অন্তত বাড়িতে থাকা উচিত ছিলো।’’
উৎস জবাব দিলো না।নির্জন জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ শিমু আবার ক্ষতি করবে না তো তোমার বাড়ির লোকদের?’’
বিশাল জবাবে বললো,‘‘ এ তো নিজেই লোক লাগিয়ে মারার চেষ্টা করে আবার নিজেই বাঁচাতে আসে।’’
উৎস কাঠ কাঠ স্বরে বললো,‘‘ বাঁচাতে নয় শালা তার জিনিস নিতেই এসেছিলো।’’
___________________________
‘‘ উৎসকে মারতে পারলি না? এসব বলার জন্য ফোন দিয়েছিস আমাকে? কোন আক্কেলে এসব বলার জন্য ফোন দিয়েছিস আমায় বল?’’
অপরপ্রান্ত হতে উত্তর এলো,‘‘ স্যার ওখানে শি…’’
‘‘ আমাকে না জানিয়েই কাউকে মারার প্ল্যান করা হয়?নট ব্যাড।সবাই তোমার কথা শুনবে এটা ভাবলে কি করে?’’
মেয়েলি কণ্ঠস্বরে দমে গেলো কাব্য।জানালা থেকে নিজের দৃষ্টি সড়িয়ে ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকালো। ছুরি হাতে আশিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বোকা বোকা হাসলো।আজ আর তার রক্ষা নেই ভেবে হাসফাস করতে লাগল।মৃত্যুর আগে সবকিছু না নিরব লাগে সেটা একদম খাপে খাপ মিলে গেলো।কাব্য বলার চেষ্টা করলো,‘‘ ড. আশিন আসলে আমি…’’
আশিন বলতে দিলো না ছুরিটা বুকের বাম পাশ বরাবর এত জোরে ছুড়ে মারলো যে এপ্রোন শার্ট ছিড়ে বুকে অর্ধেক বিধলো তারপর নিচে পড়ে গেলো।আর্তনাদ করে উঠলো কাব্য।সাদা এপ্রোন মুহুর্তেই রক্তে লাল হয়ে গেলো। বুকে হাত দিয়ে কাব্য মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়লো।বুকে হাত চেপে রাখলেও হাতের ফাক গলিয়ে রক্তের স্রোত তখনও বহমান।আশিন সোফায় গিয়ে বসলো।পরপর দুজন লোক আসলো সেখানে হাতে তাদের বিভিন্ন রকমের অস্ত্র।ভীত হলো কাব্যর চোখ।ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে অনুনয় করে বললো,‘‘ আশিন আমি ইচ্ছে করে করি নি আমাকে দিয়ে করানো হয়েছে কাজটা।’’
আশিন সোজাসাপটা ভাবে বললো,‘‘ সে নাহয় করতে বলেছে তাই বলে কি তুইও করবি? তুই কার পোষা কুকুর এটা বল আগে?’’
কাব্য বুকে হাত চেপে চোখ বুজে দেয়ালে হেলান দিয়ে সামনে দু পা ছড়িয়ে দিলো।মুখ দিয়ে শব্দও বের হচ্ছে না।কোনোভাবে ধীরে ধীরে বললো,‘‘আপনার।’’
‘‘ তাহলে এমন ভুল করলি কেন?’’
‘‘ আ…’’
কথা বলতে দিলো না আশিন।বাম পাশে থাকা একজনের হাত থেকে একটা শক্তপোক্ত কুড়াল নিয়ে ছুড়ে মারলো কাব্যর মাথা বরাবর।এমনভাবে আর এতই জোরে ছুড়েছে যে সোজা একদম মাথার মাঝখান বরাবর গিয়ে বিধলো, আর সাথে সাথেই ছটফট করতে করতে জীবনের মায়া ত্যাগ করলো কাব্য।প্রাণ চলে যাওয়ার সময় দেহটা কাতরাচ্ছিলো আর সেটা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো আশিন। কোনো অনুশোচনা নেই আর না আক্ষেপ, ভয়ভীতি।কাব্যের রক্তে রঞ্জিত হলো সাদা ফ্লোর। পাশে থাকা দুজন লোকের হাত কাঁপতে লাগলো।
এদিকে মৃত কাব্যর চোখদুটো খোলা থাকায় আশিন বিরক্তিসূচক ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে পাশে তাকাতেই পাশের একজন লোক দৌঁড়ে গিয়ে মৃত কাব্যের চোখে হাত রেখে বন্ধ করে দিলো।আশিন উঠে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে পড়ে থাকা প্রাণহীন কাব্যর মাথা থেকে কুড়ালটা বের করে হাতে নিয়ে রক্তটা ধরলো।একপলক তাকালো কাব্যর মাথাটার দিকে।কেমন ফাঁক হয়ে রয়েছে।রক্ত তখনও ঝড়ঝড়িয়ে বের হচ্ছে।রক্ততে চোখ বুলিয়ে ঘাড় হেলিয়ে কাব্যর চোখ বন্ধ করে দেওয়া লোকটার দিকে তাকালো আর একটা মিষ্টি হাসি দিলো। লোকটার রূহ কেঁপে উঠলো।এই মেয়ের মিষ্টি হাসিটাও কেমন ভয়ানক সেটা শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিই জানে যে এই ড. আশিনের হিংস্র রূপটা দেখেছে। এসব ভাবনার মাঝেই কুড়ালটা সেই লোকের একদম বুকের মাঝখানে গেঁথে দিলো আশিন।ভয়ানকভাবে চিৎকার করে উঠলো লোকটা।কাতরাতে কাতরাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।শোনা গেলো শুধু গোঙানির শব্দ।রুমের সেই পাশ জুড়ে রক্তের বন্যা বয়ে গেলো মনে হলো।পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার হাত-পা, হাঁটুসহ পুরো শরীরই কেঁপে উঠলো এমনকি তখনও থরথর করে কাঁপছে।মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না।এই শীতের মাঝেও ঘাম ঝড়ছে অনবরত। আকস্মাৎ এই ঘটনায় চোখগুলো তখনও বৃহদাকৃতির হয়ে রয়েছে।কান্না পেলো খুব।কোন পাপের জন্য এই জীবনে এসেছে সে, সেই হিসেবটাই এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে করতে লাগলো।আশিন হাতে থাকা রক্ত পাশের টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে পরিষ্কার করতে করতে চোখ গেলো সামনে থরথর করে কাঁপতে থাকা লোকটার দিকে।
ফোনটা হাতে নিয়ে লোকটার পাশ কাটিয়ে রুম থেকে বেরোতে নিয়েও আবার থেমে গেলো। লোকটা সবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছিলো আশিনের থেমে যাওয়াতে আবারও পলক ফেলে সামনে তাকাতে লাগলো আর জীবনের যত দোয়া দরুদ আছে তা পড়তে লাগলো।আশিন উল্টো হেঁটে পিছিয়ে লোকটার পাশে এসে দাঁড়ালো।হাতে থাকা ছুড়িটা ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,‘‘ একটু আগে এখানে কি ঘটেছে?’’
কণ্ঠনালী কেঁপে উঠলো লোকটার।ঘাম ঝড়ছে অবিরত।ঠোঁট কাঁপছে,কাঁপছে পা।আশিন বিরক্ত হলো।ধমকে জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ আ’ম অ্যাসকিং, হোয়াট হ্যাপেনড হেয়ার এ লিটল হোয়াইল এগো?’’
চমকে উঠলো লোকটা।কান্না করে দেবে এমন অবস্থা।কাঁপাকাঁপা গলায় উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলো,‘‘ আ..আ..মি কি..কিছু দেখি নি।’’
শেষদুটো শব্দ খুব তাড়াতাড়িই বললো।উত্তর পেয়ে আশিন ছুরিটা দিয়ে নিজের কপাল চুলকালো। ছুরি হাতেই লোকটার কাঁধে হাত রেখে ঢিমে আওয়াজে বললো,‘‘ কি করবো বল? আমার না করেও সত্ত্বেও তোদের প্রিয় কাব্য উৎসর পিছু লেগেই ছিলো।তাই তাকে মেরে দিতেই হলো।আর ওই নির্দোষ লোকটা সে অপবিত্র ওই কাব্যকে ছুঁয়েছে। তাই তার বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না।’’
দুই ঠোঁট উঁচিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লো আশিন। আফসোসের সুর তুলে বললো,‘‘ কখন কার মরণ আসে এটা আসলেই কেউ জানে না।ইশশ খারাপ লাগছে ওদের জন্য।’’
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে শুনছে আশিনের কথাগুলো। কাঁধে আশিনের হাতটা রেখেছে যে, ভয়ের চোটে মনে হচ্ছে কত ভারী কিছু কাঁধে রাখা হয়েছে।
আশিন এবার শান্ত হলো।সটান হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ থেকে নিজের হাত সড়িয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলে উঠলো,‘‘ কে মরেছে, আর কে মেরেছে? এসব কিছু মস্তিষ্কের একদম হোল স্টোরেজ থেকে ডিলেট করে দাও।নয়তো আশিনের দেওয়া ভয়াবহ মৃত্যুর স্বাদ তোকে গ্রহণ করাতে পিছপা হবো না।হও তুমি নির্দোষ কিংবা কোনো পাপী।’’
বলেই চলে গেলো।লোকটি হাটু গেড়ে মাটিতেই বসে পড়লো।লোকটার আজ মনে হচ্ছে তার জীবন অভিশপ্ত, এদের সংস্পর্শে এসে।
আশিন হাসপাতালের কড়িডোর দিয়ে হাঁটার সময় সামনে থেকে নেহা হন্তদন্ত পায়ে তার দিকেই এগিয়ে এলো।আশিন থেমে গেলো।এক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,‘‘ কি?’’
নেহা মাথা নিচু করে বললো,‘‘ রবিন সাহেব আর নেই এই পৃথিবীতে।হি ইজ নো মোর।’’
আশিনের বিঘড়ে থাকা মেজাজ কিছুটা হলেও শান্ত হলো এবার।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শান্তভাবেই বললো,‘‘ শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান যেন জাকজমকপূর্ণ হওয়া চায়।যত টাকা লাগবে আমি দেব।এর সমস্ত ব্যবস্থা ইউরিকে করতে বলো।’’
কথাটা বলেই গটগট পায়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো।পার্কিং লটে গিয়ে নিজের কালো গাড়িটাই চড়ে বসলো।গাড়িটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ দামী।গাড়ি ফুল স্পিডে চালিয়ে এবার কোথাও একটা রওনা হলো আশিন। হাইওয়েতে আসতেই সামনে কিছু পুলিশ আশিনের গাড়ি থামিয়ে দিলো।আশিন এতটাই বিরক্ত হলো যে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে পুলিশকে ধমকে বললো,‘‘ কি চাই?’’
আশিনের এমন ধমকে রেগে গেলো পুলিশ অফিসার।আশিনকে গালি দিতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে একজন বলে উঠলো,‘‘ ম্যামকে যেতে দে।’’
সেই পুলিশটিও আর কিছু বলতে পারলো না।তার সিনিয়রের হুকুমে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেড়ে দিতে হলো। নয়তো আজ এই মেয়েটার শেষ দেখেই ছাড়তো। আশিন আধঘণ্টার ভেতরে শহরের বাইরে পিচঢালা রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলের ভেতরের দিকে যাওয়া কাঁচা একটি রাস্তার পথ ধরলো।আর কিয়ৎক্ষণ বাদেই পৌঁছে গেলো আলিশান এক বাংলোর ধারে। বাংলোটা এতোটাই সুন্দর যে দেখে মনে হচ্ছে কোনো রাজপ্রাসাদ।তবে এই জঙ্গলের ভেতরে এমন বাড়ি থাকবে এটা কারোরই কল্পনায়ও থাকবে না।গাড়ি থেকে নেমে হাটা ধরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।বাড়ির আশেপাশে কালো পোশাক পরিহিত অনেকজন বডিগার্ড দাঁড়ানো।আশিনকে দেখতেই সবাই সালাম দিতে লাগলো একে একে।আশিন বাড়ির ভেতর ঢুকতেই একটি ছেলে এগিয়ে এলো।
‘‘ ম্যাম আপনি সুরক্ষিত আছেন তো? আপনার জন্য চিন্তা হচ্ছিলো।যদি কিছু হয়ে যায়?’’
ছেলেটির মাথায় গাট্টা মেরে আশিন বলে,‘‘ রিল্যাক্স প্রশান্ত। আমি আশিন। আশিন তো আশিনই।’’
প্রশান্ত ছেলেটা বললো,‘‘ ওই উকিল আপনার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে নি তো?’’
‘‘ উৎস আমার আর কি করবে? মারার জন্য হাত-পা নিশপিশ করলেও মারতে পারবে না আমায়।’’
সিড়ি বেয়ে একজন মধ্যবয়স্ক লোক নামতে নামতে আশিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘‘ ও এডভোকেট উৎস তালুকদার।তুখোড় মেধাবী আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন একজন উকিল উৎস তালুকদার।শত্রুদের কিভাবে শায়েস্তা আর পরাজিত করতে হয় সেই বুদ্ধি শরীরের শিরায় উপশিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। নিজের এই প্রফেশন সকলের অগোচরে রেখেছে শুধুমাত্র শত্রুদের সাথে গেইমের ওপর গেইম খেলার জন্য।তাকে খুব সামান্য একটা মাছের ছোট কাঁটা ভাবা তোর অনেক বড় ভুল হবে শিমু।’’
থেমে যায় লোকটি।আশিনের একদম সামনে চলে আসলো।আশিন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। লোকটি আবারও বলে,‘‘ উৎস যতই তোকে ভালোবাসি বলুক না এটা নিছকই ছলনা আত্র। আর যদিও বা ভালোবেসেও থাকে , তবুও নিজের সৎ ব্যক্তিত্বের খাতিরে তোকে মারতে একবারও হাত কাঁপবে না তার।
তাই শিমু আবারও বলছি, সাবধান।সমস্তকিছু শেষ হওয়ার পর আমরাও নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।’’
(প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি।)