বাতাসে বাতাসে জানান দিচ্ছে আজ একজন প্রেমিক পুরুষ তার শখের নারী কে অবশেষে নিজের করে পেল,কত শত অপেক্ষা শেষে ভালোবাসার পূর্ণতা লাভ করেছে।
বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিফাত,তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আরুহী,পড়নে তার লাল বেনারসি।ভয়ে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে, কোনো একসময় যে তার জীবনেও এমন কিছু ঘটবে কস্মিন কালেও কল্পনা করেনি সে।
ওদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল ও মাহমুদ,ওদের তো থাকতেই হবে না হলে নিজের বিয়ের বাজনা বাজাবে কে?
রুমের দরজা খুলে দিতেই অবাক হন আসিফা রহমান, আফতাব রহমান আর আনোয়ার রহমান টেবিলে বসে চা খাচ্ছিলেন তার মধ্যে সিফাত কে বিবাহিত অবস্থায় দেখে চমকে যান।
হিমেল ভেতরে আসে ওদের কে নিয়ে ভেতরে আসেন, সিফাত আরুহী কে ইশারায় বলে সবাই কে সালাম করতে।আরুহী একে একে সবাই কে সালাম জানায়।
‘ সিফাত তুই বিয়ে করে ফেলেছিস?’
আসিফার প্রশ্ন শুনে গলা শুকিয়ে যায় আরুহীর, এখন সিফাত কী বলবে?
সিফাত শান্ত কন্ঠে বলে।
‘ হ্যা মা,তোমরা তো আর আমার বিয়ে দিচ্ছ না?তাই নিজেই করে নিলাম।’
ছেলের এমন কথা শুনে ভ্রু কুঁ’চকে ফেলেন আফতাব, এগিয়ে এসে বলেন।
‘ তোর কী মনে হয় আমরা তোর বিয়ে দিতাম না?’
‘ কী করে বলব বলো? তোমরা সেদিন একটুও না বোঝার চেষ্টা করে চলে এলে তাহলে আমার আর কী করার আছে?’
আসিফা রহমান সিফাতের কান মলে বলেন।
‘ অস’ভ্য ছেলে একটা,তুই জানিস আমরা তো ভাবছিলাম কয়েক দিনের মধ্যেই ওদের বাড়িতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে যাবো।’
ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে আরুহী সিফাত একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে।
সিফাত তড়িগড়ি করে জিগ্যেস করে।
‘ সত্যি মা?’
আফতাব রহমান কিছুটা গম্ভীর্য মুখে নিয়ে বলেন।
‘ দেখো আসিফা দেখো,ছেলে বড় হয়েছে। নিজের মনমতো যা ইচ্ছে করছে।’
সিফাত গলার মালা খুলে দৌড়ে বাবার কাছে যায়।
‘ বাবা বাবা রাগ করো না সত্যি আমি জানতাম না, ইশ্ আমার বিয়েটা ধুমধাম করে হবে আগে জানলে এমনি ভাবে বিয়ে করতাম না।’
উপস্থিত সবাই ওর কথা শুনে হাসে। শান্তা রহমান রান্নাঘর থেকে মিষ্টি নিয়ে এসে, সিফাতের গাল টেনে দিয়ে বলে।
‘ ভাইয়া এটাই ভালো এক সঙ্গে দুটো খুশীর খবর পেলে।’
সিফাত জিজ্ঞেস করে।
‘দুটো খুশীর খবর?’
শান্তা রহমান হেসে বলে।
‘ জ্বি, এদিকে তোমার বিয়ে ওদিকে তোমার বড় ভাবী মা হতে চলছে।’
নিহা মা হতে চলেছে শুনে মুখ কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেল সিফাতের।
‘ সত্যি সত্যি?’
আসিফা রহমান বলেন।
‘ হ্যা রে হ্যা, যাই হোক ঘরের ছোট বউও চলে এলো।’
আসিফা রহমান আরুহীর কাছে গিয়ে বলেন।
‘ ওকে তো আমার সেদিনই পছন্দ হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম কিন্তু পরে বাড়িতে এসে তোর বাবা আর আমি আলোচনা করি।যে মেয়ে সবার সামনে সত্যি স্বীকার করে নেয় তার থেকে ভালো মেয়ে ছেলের জন্য খুঁজে পেত না।’
আরুহী পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আসিফার দিকে। হিমেল উপরের রুমে যায়, জানালার পাশে বসে আছে সে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তুফা।
‘ চড়ুই পাখি শুনো।’
চড়ুই ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখে হিমেল,ওকে দেখে ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি।তুফা মুখ টিপে হাসে, হিমেল এগিয়ে গিয়ে জট করে কোলে তুলে নেয় চৈতি কে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে, হিমেল তুফা কে উদ্দেশ্য করে বলে।
‘ তুফু চেয়ার নিয়ে নিচে আয়।’
‘ আচ্ছা ভাইয়া।’
‘ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
চৈতি প্রশ্ন করতেই শান্ত দৃষ্টি নিক্ষে’প করে হিমেল।যে কেউ দেখে বলবে কতশত কাজ করে এসেছে ছেলেটা,ঘেমে একাকার অবস্থা কিন্তু তবুও মুখে প্রশান্তির হাসি।
চৈতি আবারও হিমেল কে শুধায়।
‘ কী হলো বলছেন না যে?’
‘ তোমার জন্য কেউ একজন এসেছে গিয়ে দেখো।’
‘ কে এসেছে?’
‘ নিজেই দেখো।’
নিশা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে আরুহী কে,ফাইনালি সিফাত ভাইয়ের বিয়ে হলো এখন চৈতি আর ওর বিয়ে হবে।ভেবেই খুশীতে লাফ দিতে ইচ্ছে করেছে তার।আসিফা রহমান গিয়ে আরুহী কে ফ্রেশ করিয়ে হলুদ রঙের একটা সুতির শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে আসে। গুটিসুটি মে’রে বসে আছে সোফায়, এখনও তার হাত পা থর থর করে কাঁপছে। শান্তা রহমান নিহা কে রেস্ট করতে বলেছে রুমে,তাই সে আসতে পারছে না।আরিফ বাড়িতে নেই অফিসে গেছে বর্তমানে একটা ডিল ক্রেক করতে হবে তাদের না হলে দশ লাখ টাকার ক্ষ’তি হয়েছে তা কোনো ভাবেই সামা’ল দেওয়া যাবে না।
আরুহী কে দেখে চৈতির মুচকি হাসি চওড়া হয়ে যায়, অবশেষে সিফাত নিজের ভালোবাসার মানুষ কে আপন করে পেয়েছে। হিমেল এসে সিফাতের পাশে চেয়ার বসায় আর সাথে চৈতিকেও বসিয়ে দেয়,ওর পাশে বসে হিমেল।
শান্তা রহমান সবার জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করে।
‘ তাহলে আসিফা আমার মনে হয় আমাদের একটা রিসেপশন পার্টি রাখা উচিত যাতে সবাই জানতে পারে ওদের বিয়ের কথা।’
পার্টির কথা শুনে বেশ সবাই খুশি হয়। সিফাত আড় চোখে তাকায় আরুহীর দিকে।
ওদিকে চৈতি মন খারাপ করে ফেলে, পার্টিতে সবাই কত মজা করবে আর সে?তাকে তো সারাদিন বসে থাকতে হয়।ওর কাছের কাছে হিমেল ফিস ফিস করে বলে।
‘ চিন্তা করো না চড়ুই পাখি তুইও মজা করবি, আমি আছি তো।’
চৈতি হিমেলের কথা শুনে মুচকি হাসে।
____________
‘ জ্বি হ্যা, ওদের তো বিয়ে হয়ে গেলো এখন,,,।’
‘ কী এখন?’
সাঝঁ বেলা,আকাশ জুড়ে সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে আছে, সাথে হিমশীতল আবহাওয়া। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে নিশা কথা বলছে ইশানের সাথে।ইশান মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে,ব্যাগ রেখে শার্ট খুলতে খুলতে কথা বলছে নিশার সাথে।
‘ ও মা কী আপনি জানেন না?’
ইশান স্মিত হেসে বলে।
‘ না তো জানি না, আপনিই বলে দিন।’
‘ ইশ্, লজ্জা করে।’
‘ এত লজ্জা পেলে চলবে?’
‘ আচ্ছা আপু কোথাও?’
‘ ভাবী তো রান্না করছে।’
‘ ও আর রিতু?’
‘ রিতু পরিজা আন্টির সাথে ওদের বাড়িতে গিয়েছে।’
‘ আচ্ছা কাল তো বাড়িতে ওদের বিয়ে উপলক্ষে রিসেপশন পার্টি রেখেছে, আপনি আসবেন তো?’
‘ যদি ওখান থেকে বলা হয় তাহলে অবশ্যই আসবো।’
‘ হুম, আম্মু একটু পরেই আপু কে ফোন দিয়ে বলবে।’
‘ আচ্ছা তাহলে থাকুন ম্যাডাম ফ্রেশ হয়ে আসি।’
‘ ঠিক আছে যান, সময় মত খেয়ে নিবেন।’
‘ আপনি এসে খাইয়ে দিন।’
‘ শখ কত?’
‘ ও বাবা আমার এক মাত্র বউ আমাকে খাইয়ে দেবে না?’
‘ জানি না।’
‘ আচ্ছা থাকো গেলাম,আর তুমিও নিজের যত্ন নিও।’
‘ আল্লাহ হাফেজ।
‘ আল্লাহ হাফেজ ম্যাডাম।’
____________
তানিয়া মাত্র নিজের স্বামী তিশান এর সাথে কথা বলে ফোন রাখতে যাবে তার মধ্যে আবারও ফোন বেজে উঠে। আসিফা রহমান কল করেছে,মুখে হাসি নিয়ে ফোন রিসিভ করে তানিয়া।
‘ হ্যলো মা বলো।’
‘ হুম, তুই তো জানিস আরুহী আর সিফাতের বিয়ে হয়ে গেছে?’
‘ হ্যা মা জানি,নিহা ফোন করে বলল। কিন্তু মা তোমার ছেলে যে হঠাৎ এমন করে বিয়ে করবে ভাবিনি।’
‘ আচ্ছা যাই হয়েছে বাদ দে,কাল বাড়িতে ওদের জন্য রিসেপশন পার্টি রেখেছে তোর বাবা। এখন তোদের আসতে বলেছে।’
‘ ওহো, আচ্ছা আচ্ছা কিন্তু কখন আসবো?’
‘ তোর কী অতিথি হয়ে আসতে হবে? না তো, তুই আজকে রাতেই চলে আসবি।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘ আর শুন,সাথে ইশানকেও নিয়ে আসিস।’
‘ আচ্ছা মা ঠিক আছে ঠিক আছে, সবাই আসবো।’
_________________
রুমে বসে আছে আরুহী, জানালা দিয়ে হুঁ হুঁ করে বাতাস ঢুকছে। স্পর্শ করছে তার সমস্ত দেহ,হাত পা কাঁপছে।রুমে প্রবেশ করে সিফাত, আবছা আলোয় তার মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে আছে আরুহী। মনে মনে নানা ভ’য় কাজ করছে,বার বার ফিহাদের করা আচরণ গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।
হাতে থাকা জিনিস গুলো রেখে আলমারি রেখে, ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় সিফাত। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসে সে, কাছে এসে বসে আরুহীর।আরুহী একটু সরে গিয়ে বসে,স্মিত হাসে সিফাত। বৃদ্ধা আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয় তার ডান গালে, কেঁপে উঠে আরুহী।
সিফাত শান্ত কন্ঠে বলে।
‘ সরি।’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে।
‘ ব্যথা দিয়েছিলাম যে?’
চুপ করে থাকে আরুহী, সিফাত শক্ত করে ধরে তার হাত দুটো।
‘ ভালোবাসি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না কখনও,তাই এভাবে বিয়ে করেছি। এখন যদি তুমি চাও আমার কাছে আসবে না তাহলে আমি তোমার ইচ্ছে কে সম্মান করি, হয়ত কখনও ভালোবাসবে।তখন নিজ থেকেই আমার কাছে আসবে।’
আরুহী কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে ভাবে, এরপর আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে সিফাত কে। শান্তির শ্বাস নেয় সিফাত, তাহলে সে কোনো ভুল করেনি। এখন ছুঁয়ে দেখতে পারবে না তো কী হয়েছে? ভালোবাসার মানুষটি এখন থেকে তার কাছে থাকবে তাতেই তো পরম সুখ পাওয়া যায়।
নিহা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিজের ভাবনায় মগ্ন ,রুমে কারো আগমন টের পেয়ে পিছন ঘুরে তাকায় নিহা। আরিফ খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তপ্ত শ্বাস ফেলে নিহা।আরিফ টেবিলের উপর খাবার রেখে,নিহার হাত ধরে সোফায় বসায়।
‘ খাবার খাওনি কেন?’
আরিফের কথার কোনো উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখায় না নিহা। আরিফ আবার জিজ্ঞেস করে।
‘ আমার উপর রাগ আছে ঠিক আছে, আমার কাছে আসতে চাও না, এটাও ঠিক আছে কিন্তু নিজের খেয়াল রাখতে হবে।’
‘ আমার খেয়াল রাখার কথা মনে পড়ল?’
আরিফ রুটির টুকরো মাখিয়ে নিহার সামনে ধরে বলে।
‘ মনে ছিল কিন্তু মাঝে বিভ্রান্তি হয়েছিল তাই তার ব্যাতিক্রম হলো,হা করো।’
নিহা হা করে,আরিফ সযত্নে মুখে তুলে খাইয়ে দেয় নিহা কে।আর না আগে যা হয়েছে হয়েছে, এখন নিহা কে নিজে সবটা দিয়ে ভালোবেসে আগলে নেবে। এখন তো আর নিহা একা নয় তার ছোট্ট বেবিও আসছে দু’জন কে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে রাখবে।
চলবে…..