পুরো বাড়িতে অতিথিদের যাওয়া আসা লেগেই আছে, সকাল থেকে রিসেপশনে পুরো দায়িত্ব নিয়েছিল হিমেল ও মাহমুদ। অবশেষে তাদের কঠোর পরিশ্রমের পর সব কিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিয়েছে।
হালকা বেগুনি রঙের মধ্যে কাঁচ করা শাড়ি পড়েছে আরুহী,নিহা আর তানিয়া মিলে ওকে তৈরি করে দিচ্ছে। ওদের পাশে বসে আছে চৈতি,হাসি মজার মাধ্যমে সবাইকে তৈরি হচ্ছে।চৈতি কে আগেই রেডি করে দিয়েছে আসিফা রহমান।
‘ ভাবী তোমাকে কিন্তু বেশ সুন্দর লাগছে।’
চৈতির কথায় কিছুটা লজ্জার আভা দেখা যায় আরুহীর গালে,হালকা সাজে অপরূপা সুন্দরী লাগছে তাকে।
চুলের খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজে দিল ইশান।নিশা মুচকি হাসে,ইশান ফিসফিস করে বলে।
‘ গোলাপের কাঁ’টায় কাঁ’টায় লিখে দেব তোমার নাম
তবে হ্যাঁ র’ক্তক্ষরণ যেন তোমার হৃদয় হয়।
ভালোবেসে সাজাবো তোমায়!
আগলে নিও তুমি আমায়।
‘ প্রেমিক পুরুষ এখন কবি হয়ে গেছে।’
‘ জ্বি জ্বি, আপনার জন্য সব হতে রাজী।’
‘ এভাবে বললে সারাজীবন খা’টতে হবে কিন্তু।’
‘ যো হুকুম মেরী জান।’
‘কী হয়েছে মন খারাপ?’
মাহমুদের কথায় আড় চোখে তাকায় তুফা, সত্যি তার মন খারাপ কিন্তু তার কোনো কারণ নেই।
তুফা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে।
‘ হুম কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই।’
‘ হয় হয় মাঝে মাঝে এমনও হয় । চিন্তা করো না সব ঠিক হবে, আচ্ছা এই নাও।’
মাহমুদ তুফার দিকে প্যাকেট এগিয়ে দেয়।
‘ কী এটা?’
‘ তুমি দেখো,আর হ্যা এটা পড়ো ভালো লাগবে।’
রুমে চলে গেল তুফা, মাহমুদ স্মিত হেসে হিমেলের কাছে চলে যায়।তুফা রুমে গিয়ে ব্যাগ খুলতেই দেখে একটা সাদা রঙের গাউন সাথে ম্যাচিং করা জুয়েলারি, ভীষণ খুশী হয় সে।
মনে মনে ঠিক করে নেয় আজ এটাই পড়বে, পার্টি অলরেডি শুরু হয়ে গেছে তাই আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সে।
পার্টি শুরু হয়, সবাই আরুহী আর সিফাত কে দেখতে আসে। হিমেল চৈতির কাছে দাঁড়িয়ে আছে, সারাক্ষণ ওর সাথে গল্প করছে,যাতে ওর খারাপ না লাগে। কিছুক্ষণ পর পর চৈতি কে একটা কথাই বলছে।
‘ চড়ুই পাখি শুন না।’
‘ হুম বলুন।’
‘ ওদের দেখে এখন আমার বিয়ে বিয়ে মন চাচ্ছে।’
চৈতি ভ্রুকুটি করে ফেলে।
‘ কী সব বলছেন?’
‘ সত্যি সত্যি গায়ে হলুদ বিয়ে এরপর তোর আর আমার বাসর, ইশ্ প্রেম প্লাস বিয়ে পাচ্ছে।’
চৈতি হিমেলের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা।
‘ হায় হায় আপনি এত নির্ল’জ্জ।’
‘ তুই আমার ফিলিংস বুঝলি না।’
চৈতি মুখ বাঁ’কিয়ে বলে।
‘ বুঝতে চাই না।’
‘ আই লাভ ইউ।’
‘ আমি ভালোবাসি নট।’
‘ আহা চড়ুই পাখি আমার উম্মাহ্।’
নাচ গানের মাধ্যমে পার্টি শেষ হয়, আনন্দ আড্ডায় হই হই করে সবাই সুন্দর একটি রাত উপভো’গ করে।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আরুহী আর সিফাত, নিজের বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় আরুহীর নরম তুলতুলে হাত ধরে রেখেছে, জোৎস্না স্নাত রাত। আকাশে চাঁদ ঝল ঝল করছে,তার চারিপাশ জুড়ে তারার মেলা।
‘ দেখো আরু আকাশ জুড়ে তারার মেলা জমেছে, হয়ত আকাশও আজ চাঁদ কে পরিপূর্ণ রূপে দেখে খুশি।’
‘ হুম।’
সিফাত আরুহীর দিকে তাকিয়ে আবার বলে।
‘ আকাশের বুকে ঠাই পেয়েছে চাঁদ, তুমি কী আমার বুকে আশ্রয় লাভ করতে চাও? আমি কী তোমাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারি?’
সিফাত নিজের হাত এগিয়ে দেয় আরুহী দু পা পিছিয়ে যায়, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সিফাত।আরুহী মাথা নিচু করে নেয়, সিফাত আরুহীর গালে হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে বলে।
‘ হেই,কী হয়েছে?চাও না আমি কাছে আসি?’
আরুহী ফুঁপিয়ে বলে।
‘ আমার কাছে এসে তো আপনি কিছু পাবেন না। এমন নয় যে আমি কুমারী, আমাকে অন্য একজন পুরুষ,,,,,।’
নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল আরুহীর ঠোঁটে রাখে সিফাত,একটা শব্দও বলতে দেয় না তাকে।
‘ আমার আগে যত পুরুষই তোমাকে স্পর্শ করুক আমার কিছু যায় আসে না, কিন্তু এখন আমি ব্যতিত অন্য কেউ আর তোমাকে স্পর্শ করবে না। তুমি শুধু আমার থাকবে, নতুন করে সব শুরু করব। অতীত ভুলে যাই?’
আরুহী সিফাত নামে সুঠামদেহী পুরুষ কে জড়িয়ে ধরে, সিফাত আলতোভাবে কোলে তুলে নেয় তার প্রেয়াসী কে। নতুন ভাবে শুরু করে সব কিছু, ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেয় আরুহী কে। দু’জনে নতুন রঙে রঙিন হয়ে যায়।
পায়ের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলে চৈতি, হিমেলের হাত ধরে আস্তে আস্তে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ধীরে ধীরে পা দিয়ে হাঁটতে পারছে চৈতি, হিমেল চাইবে সময় নিয়েই সে চলাফেরা করুক পরে যাতে সমস্যা না হয়।
টেবিলে বসে আছে সবাই,আসিফা রহমান, শান্তা রহমান ও আরুহী তিনজন মিলে সকালের খাবার তৈরি করছে।আসিফা রহমান আস্তে আস্তে সব কিছু দেখিয়ে দিচ্ছে আরুহী কে।কে কী খায় সকালে সব কিছু,নিহা টেবিলে বসে আছে ।কত বার বলেছে রান্না করবে কিন্তু শান্তা রহমান ও আসিফা রহমান করতে দেয়নি,এই সময়ে ওকে একটু রেস্ট নেওয়াই ঠিক হবে।
খাবার টেবিলে আফতাব রহমান আনোয়ার রহমান, হিমেল,চৈতি,নিশা ও নিহা বসে আছে।আরুহী সবার জন্য চা নিয়ে আসে, সবাই খেয়ে বেশ প্রশংসা করে তার, কিছুক্ষণ পর সিফাত ও আরিফ এসে বসে। সিফাতের হাতে আরুহীর ব্যাগ।
আরুহী ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে।
‘ ব্যাগ কেন?’
সিফাত স্মিত হেসে বলে।
‘স্কুলে যেতে হবে তো? অনেক দিন তো মিস করলে।’
আসিফা রহমান এসে আরুহী কে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বলে।
‘ তুমি তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নাও এরপর সিফাত তোমাকে স্কুলে ছেড়ে দেবে।’
‘কিন্তু আমি।’
আফতাব রহমান বলেন।
‘ উঁহু,আরুহী মা তুমি একজন শিক্ষক আর এটা আমাদের জন্যেও ভীষণ গর্বের বিষয়,তাই স্কুল মিস দিও না। তাড়াতাড়ি নাস্তা করে নাও।’
আরুহী সিফাতের দিকে আড় চোখে তাকায়, সিফাত মুচকি হেসে চোখ মা’রে।আরুহী হালকা লজ্জা পায়।
হিমেল ফিস ফিস করে চৈতি কে বলে।
‘ এই শুনো,যখন তোমার আমার বিয়ে হয়ে যাবে তখন আমি তোমাকে ভার্সিটি থেকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।’
‘ আমি তো বিয়ের পর পড়বই না।’
‘ তাহলে ঠিক আছে, সারাদিন প্রেম করব আর ভালোবাসব।’
‘ পা গ ল,এই আপনি এত লু চু কেন?’
‘ তোমার কারণে, আচ্ছা একটা জিনিস লক্ষ্য করেছো।’
‘ কী?’
‘ তুমি বললাম।’
সত্যি চৈতি এত সময় খেয়াল করেনি হিমেল তাকে তুমি করে বলছে।তা বোঝা মাত্র নাকের ডগায় সুড়সুড়ি অনুভব করছে সে।
অফিস থেকে আসার পর থেকে হাঁ’সফাঁ’স করছে ইশান,নিশা ফোন করে বলেছে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে।তা শুনার পর থেকে পা গ ল,পা গ ল অবস্থা ইশানের।ইশান কে এমন অবস্থায় দেখে চিন্তিত হয় তানিয়া।
‘ ইশান,কী হয়েছে তোমার?’
ইশান তানিয়া কে দেখে নিজের কান্না লুকাতে পারে না,বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে তানিয়া ভাবী নয় বরং মায়ের মত আচরণ করেছে ইশানের সাথে।ইশান নিজের ভাবী কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
ইশান অবাক হয়,এই ছেলে কে কখনও সে কাঁদতে দেখেনি আজ তার চোখেই পানি? কিন্তু তার কারণ কী?
‘ ইশান কি হয়েছে বলো আমাকে?’
‘ ভাবী আমার কষ্ট হচ্ছে আর সেটা তুমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না।’
‘ হ্যা হ্যা ঠিক আছে বলো আগে হয়েছে টা কী?’
‘ ভাবী আমি নিশা কে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি ওকে বিয়ে করতে চাই।’
ইশানের কথা শুনে আরেক দফা অবাক হয় তানিয়া।
‘ ইশান, তুমি নিশা কে ভালোবাসো?আর এটা আমি জানি না?’
‘ সরি ভাবী, আমি ভেবেছিলাম কিছু দিন পর বলব কিন্তু এখন।’
‘ এখন কী?কী হয়েছে?ভালোবাসো ঠিক আছে তা তো অপরাধ নয়।’
‘ ভাবী আঙ্কেল না কী ওর বিয়ে ঠিক করেছে।প্লীজ ভাবী তুমি কিছু একটা করো। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।’
তানিয়া কী বলবে বুঝতে পারছে না,ইশানের কোনো কথাই তার বোধগম্য হলো না।নিশার বিয়ে ঠিক হয়েছে আর সেটা ও জানে না এমন তো হতেই পারে না।এমন হলো অবশ্যই মা জানাতো।
‘ ভাবী,কী ভাবছো?’
‘ চিন্তা করো না তোমার বিয়ে নিশার সাথেই সবে ইনশাআল্লাহ, ভীষণ খুশি হয়েছি তাহলে এখন আমার চাচাতো বোন আমার জা হবে।’
‘ না ভাবী তুমি আজই কথা বলো, আমি টেনশন নিতে পারছি না।’
‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে বলছি আমি কথা।’
কলেজ থেকে ফিরছে তুফা চৈতি আর নিশা, কিছুদিন পরেই ওদের পরীক্ষা।আজ ভার্সিটি থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সবার ফ্রি ক্লিয়ার করার জন্য, তিনজন মিলে ঠিক করেছে গ্রুপ স্টাডি করবে তাহলে সব সাবজেক্ট সহজ হবে তাদের জন্য।
‘ এই নিশা তোর আর ইশানের কী খবর?’
চৈতির এহন প্রশ্ন শুনে ভয় পেয়ে যায় নিশা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
তুফা আর চৈতি মুখ টিপে হাসে,চৈতি মুখ বাঁ’কিয়ে বলে।
‘ ও হ্যলো তুমি কিছু না বললেও আমরা সব জানি,তাই বেশী স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করো না।’
নিশা বোকা বোকা ভাবে জিজ্ঞেস করে।
‘ তাহলে তোরা সব জানিস?’
তুফা কিছুটা ডেবিল মা’র্কা হাসি দিয়ে বলে।
‘ ইয়েস, আমি আর চৈতি সব জানি আর হ্যাঁ তুমি কোথায় কখন ঘুরতে গেছো সেটাও।’
‘ তাহলে আর কী বলব? আচ্ছা যাই হোক তোরা যখন সব জানিস তাহলে এটাও জেনে নে আমি ইশানের সাথে একটা বড় প্র্যাক করেছি।’
চৈতি তুফা দুজনেই জিজ্ঞেস করে।
‘ কী?’
নিশা হেসে বলে।
‘ আমি ইশান কে ফোন করে বলেছি বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।এটা শুনে ইশানের কী অবস্থা এখন কে জানে।’
তিনজন এসব নিয়ে হাসাহাসি করে,তার মধ্যে নিশার মুঠো ফোনটি বেজে উঠে।
‘ হ্যলো,কী?’
ফোনের ওপাশ থেকে যা শুনে তার পর নিশার হাত পা কাঁপছে।
চলবে……..