বন্ধ দরজা [পর্ব-১২]

-” ডেকেছো আম্মা?”

-” হুম, দরজাটা আটকে দিয়ে আয়।”

সুহায়লার মনে আতংক ছড়াচ্ছে। সাবা মায়ের পাশে বসে আছে। ওর কাছে কেনো যেনো মনে হচ্ছে সাবা মাকে এসব কথা বলে দিয়েছে। দরজাটা আটকে এসে মায়ের পাশে বসলো সুহায়লা

-” কি হয়েছে আম্মা?”

-” তানভীর কেমন? সব ঠিকঠাক চলছে তো?”

সুহায়লা কি বলবে বুঝে উঠত পারছে না। সাবা যদি সব কথা বলে থেকে থাকে তাহলে তো মিথ্যা বললে আরো বিপাকে পড়বে সে। সাবার মুখের দিকে তাকালো সুহায়লা। সাবা বুঝতে পারছিলো সুহায়লার মনে কি চলছে। সে চোখ দিয়ে ইশারা দিলো মাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সুহায়লা। ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে মাকে বললো,

-” একদম নিশ্চিন্তে থাকো আম্মা। তানভীর যথেষ্ট ভালো মানুষ। হ্যাঁ ও একটু গম্ভীর স্বভাবের। একটু না অনেকটাই গম্ভীর ও। কিন্তু ও মানুষটা খুব ভালো।”

-” সত্যি বলছিস তো?”

-” তোমার কাছে লুকাবো কেনো আম্মা? আর তুমি আমাকে চিনো না? খারাপ কিছু ঘটলে কি আমি সেখানে থাকতাম? 

-” কি যে চিন্তায় ছিলাম তোকে নিয়ে। ঐ বাড়িতে তুই চলে যাওয়ার পর থেকে হাজার চেষ্টা করেও দু চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কি যে অশান্তি লাগছিলো! উফফ…..”

-” এখন শান্তি লাগছে আম্মা?”

-” হ্যাঁ।”

-” আচ্ছা শোনো, আমি আজ দুপুরেই চলে যাবো।”

-” কেনো?”

-” তানভীর থাকতে চাচ্ছেনা।”

-” কি সমস্যা? ওর কি এখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”

-” আসলে আম্মা, তানভীর কাজ পাগলা মানুষ। অফিসে যেতেপারছেনা দুদিন ধরে। এজন্য মাথা কিছুটা খারাপ হয়ে আছে। তাছাড়া ও কারো বাসায় তেমন একটা আসা যাওয়া করে না। গেলেও রাতে কখনোই থাকেনা। বাসায় চলে আসে।”

-” কি অদ্ভুদ! আমরা কি দূরের কেউ নাকি? এটা ওর শ্বশুড়বাড়ি। জামাই শ্বশুড়বাড়িতে এসে দুদিন-তিনদিন থাকবে না এটা কেমন কথা?”

-” থাকুক না আম্মা। থাকলো তো একরাত। হুট কে একটা মানুষকে তো আমি তার এতদিনের অভ্যাস থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারবো না। এবারের মতো চলে যাই। এরপরের বার না হয় দুদিন থেকে যাবো।”

-” চলেই যাবি?”

-” না করো না আম্মা প্লিজ।”

-” আচ্ছা ঠিকাছে যাস।”

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে তিনটার দিকে সুহায়লার শ্বশুড়বাড়িতে রওয়ানা হলো ওরা। ড্রাইভার রফিক এসে সুহায়লা তানভীরকে নিয়ে গেলো আর ফাহিম নিশাত অন্য গাড়িতে চলে গেলো তাদের নিজের বাড়িতে। বাসায় ফিরেই ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে গেলো তানভীর। বাবার হাজার বারন সত্ত্বেও সে কোনো কথা শুনেনি। সে তার মতো অফিসে চলে গেলো। রাত নয়টার দিকে শ্বশুড়ের সাথে বসে গল্প করছে সুহায়লা। তার ছেলে শ্বশুড়বাড়ি যাওয়ার পর কোনো খারাপ আচরন করেছে কিনা সেুগুলো নিয়ে ব্যাপক চিন্তিতো ছিলেন তিনি। সে ব্যাপারেই সুহায়লার সাথে তিনি কথা বলছেন।”

-” তানভীর, তোমাদের বাড়ির কারো সাথে মিসবিহেভ করেনি তো?”

-” না আব্বা।”

-” তোমার বাবা ভাইয়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলেছে তো?”

-” জ্বি আজ সকালে দেখলাম আব্বাআর সাদির সাথে বসে প্রায় আধাঘন্টার মতো কথা বলেছে। বেশ হাসিখুশিভাবেই কথা বলেছে।”

-” যাক কিছু হলেও জ্ঞান বুদ্ধি আছে ছেলের মাথায়। খুব টেনশনে ছিলাম কখন না আবার তোমার ঘরের লোকদের সাথে বেয়াদবী করে বসে।”

– ” আমি এতটাও মাথা মোটা মানুষ না বাবা। আমার এতটুকু কমন সেন্স আছে যে একটা মুরুব্বি মানুষের সাথে আমার বেয়াদবী করা সাজে না।”

কথাটা শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকলো সুহায়লা আর ফরহাদ সাহেব। 

-” কি রে তুই ঘরে ঢুকলি কেমন করে?”

-” গেট দিয়ে ঢুকেছি।”

-” গেট খোলা ছিলো?”

-” হ্যাঁ ছিলো।”

-” ওহ্, আমরা তো খেয়ালই করিনি।”

-” খেয়াল করবে কিভাবে বলো? আমাকে নিয়ে গবেষনা করেই তো কূল পাওনা। অন্যকিছু খেয়াল দেয়ার সময় কোথায় তোমাদের।”

তানভীরের কথা শুনে ফরহাদ সাহেব আর সুহায়লা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। তানভীর ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বললো,

-” হাসি চেপে রাখতে হবে না। মন খুলে হাসো আমাকে নিয়ে। আমি বাঁধা দিবো না।”

কথাটা বলতে বলতে উপরে যাচ্ছে তানভীর। সুহায়লা ফরহাদ সাহেবকে বললো,

-” আব্বা, আমি ওর কাপড় বের করে দিয়ে আসছি।”

-” হুম, হুম যাও।”

তানভীরের পিছন পিছন সুহায়লা দৌঁড়ে দোতলায় চলে এলো। আলমারি থেকে কাপড় বের করে তানভীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-” নাও ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো। আমি খাবার দিচ্ছি।”

তানভীর চুপচাপ কাপড়গুলো নিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। নিচে এসে নয়নকে সাথে নিয়ে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে সুহায়লা।তানভীর নিচে এসে খাবার টেবিলে বসলো। ফরহাদ সাহেবও বসেছেন খাওয়ার জন্য। তানভীরের পাশের চেয়ারে বসেছে সুহায়লা। তানভীরের প্লেটের মাছের টুকরার একপাশ থেকে সামান্য ভেঙে নিজের প্লেটে নিলো সুহায়লা। তানভীর বেশ অবাক হলো সুহায়লার এমন কান্ডে। 

-” কি ব্যাপার? মাছের পিস কি আর নেই?”

-” হ্যাঁ আছেতো।”

-” তাহলে আমার কাছ থেকে নিলে কেনো?”

-“ইচ্ছে হলো নিতে তাই নিলাম।”

-” কি যে কর না তুমি!”

ফরহাদ সাহেব মুচকি হাসছেন। উনিও চান সুহায়লা তার ছেলের মনে নিজের একটা শক্ত অবস্থান গড়ে তুলুক।তার তো একটা সুখি সংসারের মুখ দেখা হয়নি। তিনি চান তার ছেলে যেনো সংসারের সমস্ত সুখ পায়। খাওয়া শেষ করতে না করতেই ফোন এলো সুহায়লার মোবাইলে। সাবা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে উপরে চলে গেলো সুহায়লা। যাওয়ার আগে নয়নকে বলে গেলো টেবিলটা গুছিয়ে ফেলতে। বেডরুমের পাশের ছাদটাতে এসে রেলিংএর সাথে গা ঘেষে দাঁড়ালো সুহায়লা। 

-” হুম, উপরে চলে এসেছি। এখন বল কি জানতে চাস?”

-” দুলাভাই যে কেমন মানুষ তা তো দেখেই এসেছি। এখন তুই আমাকে বল তোর মতো মেয়ে তো এসব সহ্য করার মানুষ না। তাহলে কেনো তুই এসব সহ্য করছিস?”

-” আগে পুরো ঘটনা শোন। এরপর তুই বলিস।”

সুহায়লা সাবাকে বিয়ের রাত থেকে শুরু করে গতকাল দুপুরে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা, তানভীরের অতীত সমস্ত কিছু বললো। সব শুনে সাবাবললো,

-” ঠিকাছে মানছি, দুলাভাইয়ের পাস্ট খুব খারাপ ছিলো। কিন্তু উনি তো বিশ বছর আগের এক ঘটনা নিয়ে উনার নিজের বর্তমান নষ্ট করছে। সেই সাথে তোরটাও করছে। উনি কবে নাগাদ ঠিক হবেন সেটা তো আর তুই বলতে পারবি না। এভাবে আর কতদিন চলবি তুই।”

-” তুই কি বলতে চাচ্ছিস এখন তানভীরকে ছেড়ে দিই?”

-” না না। সেটা বলবো কেনো? আমি বুঝতে পারছি যে পরিস্থিতি উনাকে এমন করেছে। তুই উনাকে ছেড়ে দিলে উনার ভুল কখনোই ভাঙবে না। একমাত্র তুইই পারিস উনার ভুলটা ভাঙাতে। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি তোকে নিয়ে। তুই উনার এসব ব্যবহার কিভাবে সহ্য করবি? কতদিন করবি?”

-” আল্লাহ ভরসা। সব ঠিক হয়ে যাবি দেখিস। আর তানভীরের কথা আমি এক কান দিয়ে ঢুকাই অন্য কানে বের করে দেই। ওসব আমার গায়ে লাগেনা।”

-” ঘরের লোকজন যদি জানতে পারে তাহলে তো সমস্যা। কতদিন লুকাতে পারবি তুই? সাদি অথবা আব্বা যদি জানতেে পারে তোকে তো এক সেকেন্ডও ঐবাড়িতে থাকতে দিবে না।”

-” জানার সম্ভাবনা কম। কারন তানভীর মনে হয়না…….. এই সাবা, তানভীর আসছে। তোর সাথে পরে কথা বলবো।”

সুহায়লার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো তানভীর। সুহায়লার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কললিস্ট চেক করছে সে। 

-” আমার সামনে তোমার বোনের সাথে কথা বললে কি সমস্যা?”

-” কোনো সমস্যা নেই।”

-” তাহলে আমাকে দেখে ফোন রেখে দিলো কেনো?”

-” তোমাকে দেখে রাখবো কেনো? কথা বলা শেষ তাই রেখে দিয়েছে।”

-” তোমার বোনটা অনেক কথা বলে। একদম তোমার মতই।”

তানভীরের পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো সুহায়লা। 

-” হুম জানি। এখন বলো তুমি আজকে অফিস চলে গেলে কেনো। নতুন বউ ঘরে রেখে কেউ অফিসে যায়? তাও আবার কতক্ষন পর ফিরে এসেছো।”

তানভীর সুহায়লার কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো,

-” বাসায় থাকলেই তো বসে বসে কানের কাছে বকবক করবে। তোমার বকবক শোনার চেয়ে অফিসে কাজ করা ভালো।”

-” তুমি অনেক আনরোমান্টিক তানভীর। তুমি জানো নতুন বিয়ে করা কাপলরা মিনিমাম পনেরো বিশদিন নিজেদের বেডরুম থেকে বেরই হতে চায়না। আঠার মতো একটা আরেকটার সাথে লেগে থাকে। আর তুমি?”

-” ইশশ! নিজে মনে হয় কত্ত রোমান্টিক? গতকাল যে বললাম আমাকে ঠোঁটে চুমু দিতে, দিয়েছো? এখন পর্যন্ত দাওনি। বিয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত ঠোঁটে থাক দূরের কথা গালে পর্যন্ত একটা চুমু দাওনি। আর সেই তুমি বলছো আমি আনরোমান্টিক।”

-” তুমি কি চাও তোমাকে আমি চুমু দেই?”

– ” অফকোর্স চাই। আমি যদি আমার পাওনাটুকু নাইই পেলাম তাহলে বিয়ে করে লাভ কি হলো?”

তানভীরের কথাটা শেষ হতে না হতেই তানভীরের ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেলো সুহায়লা। 

-” ব্যস? এতটুকুই?”

-” তুমিই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ যাকে আমি নিজ থেকে চুমু খেলাম। আগের কোনো এক্সপেরিয়েন্স আমার নেই। থাকলে হয়তো আরেকটু ভালো করে করতে পারতাম।”

-” আসো তাহলে শিখাই।”

-” হুম শিখাও।”

-” এখানে নাকি রুমে?”

-” রুমে।”

-” পা থেকে নামো তাহলে।”

-” উহুম, নামবো না। যেভাবে আছি সেভাবেই আমাকে নিয়ে যাও।”

যেভাবে দাঁড়িয়েছিলো ঠিক সেভাবেই গুটি গুটি পায়ে সুহায়লাকে নিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তানভীর।”

চলবে,..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *