বাহারি_স্বপ্ন [পর্ব-২.৩]

আশিন একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি টিনের তৈরি। টিনে জং ধরেছে। দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে অনেক বছরের পুরোনো। আশিন ভাবলো এই লোক কি আসলেই সেই গ্রামেরই লোক ছিলো তো? নাকি ভুল তথ্য দিয়ে আবার ভুল লোককে মারার জন্য পাঠিয়েছে তার চাচা। এমন যদি হয় তবে চাচার খুলি উঁড়িয়ে দিতেও আশিন ভাববে না। তবুও যেন আশিন খুব একটা ঘাটলো না। কাঠের দরজাটায় একটি তালা ঝোলানো। আশিন ডান ভ্রু উঁচালো। ভাবলো বুড়ো আর বুড়ি কি কোথাও ঘুরতে গেছে নাকি? এর ছেলেমেয়ে কোথায়? এতবছর পরও কিভাবে বেঁচে আছে? আশিনের বুঝে আসলো না। যেখানে কিনা রবিন সাহেবই এতো তাড়াতাড়ি মরে গেলো। রবিন সাহেব আশিনদের খুব কাজের একজন কর্মচারী ছিলো। লোকটা বেচারা মরেই গেলো অবশেষে। আশিন মেকি হতাশার শ্বাস ফেললো। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশান্তকে জিজ্ঞাসা করলো,“ তোমার এই বাড়িটা কেমন লাগছে?’’

প্রশান্ত ছোট্ট এই বাড়িটার দিকে চোখ দিলো। আকর্ষণীয় তেমন কিছুই নেই। টিনের তৈরি একটি ছোট বাড়ি। তাও টিনগুলো কেমন পুরোনো হয়ে গেছে।কপাল কুঁচকে বললো,“ এই বাড়ি তো মান্ধাতার আমলের বাড়ি।’’

‘‘এই বাড়িটা বানানো হয়েছে কয়েক বছর আগে।’’

প্রশান্ত চুপ করে রইল। আশিন এগিয়ে গিয়ে মাথার চুল থেকে ছোট্ট একটি ক্লিপ হাতে নিয়ে তা দিয়ে কৌশলে তালাটা খুললো। ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে জিনিস বলতেও তেমন কিছু নেই। ছোট্ট একটা চৌকি আর একটা আলনা। এই বুড়োরা থাকে কিভাবে? সব টাকা কি এদের মাস্টারই খেয়ে দিয়েছিলো নাকি? এরা কি টাকা পয়সা পায় নি? আশিন দেখলো কোণায় একটি চেয়ার পাতানো। প্রশান্তকে ডেকে বললো,“ তুমি তালাটা দিয়ে বাইরে যাও আমাকে এখানে থাকতে দাও।’’

কথাটা বলে প্রশান্তর পেছনে চোখ যেতেই দেখলো নিহাদকে। এই ছেলে আবার এখানে কি করছে? এখন কি শান্তিমতো প্রতিশোধও নিতে পারবে না নাকি আশিন? আশিন প্রশান্তকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো নিহাদের দিকে। নিহাদ গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো। ভেবেছে আশিন তাকে দেখতে পায় নি। তবে তার ধারণা একদমই ভুল করে দিয়ে আশিন তার কাছে আসলো। নিহাদ চোখ বড় বড় করলো। আশিন মাথাটা ঈষৎ বাম দিকে এলিয়ে বললো,“ মাথায় এতো কাঁচা বুদ্ধি কেন তোর?’’

আশিনের মুখে সরাসরি তুই ডাক শুনে তব্দা খেয়ে গেলো নিহাদ। গম্ভীর স্বরে বললো,“ আপনার সাহস তো কম না।’’

আশিন বুকে দুহাত গুজলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,“ তাহলে আমার পিছু নিচ্ছিস কেনো?’’

নিহাদ দাতে দাত চেপে বললো,“ আমার যা ইচ্ছা করবো। আপনার কি?’’

“ হ্যা তাই তো আমার কি?’’

তারপর নিহাদের দিকে ঝুকে বললো,“ তোকে কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে।’’

নিহাদ শান্ত থাকলো। ধরা পড়লে চলবে না। অথচ সে বুঝতেই পারছে না যে আশিন অলরেডিই তার পরিচয় জেনে গেছে। মূর্খের মতো বললো,“ আমি সাধারণ মানুষ।’’

আশিন মুচকি হাসলো। ছোট্ট করে বললো,“ ওহ তাই!’’

বলেই নিহাদের কিছু বুঝে ওঠার আগেই আশিন ত্বরিত বেগে নিহাদের শার্টের নিচে প্যান্টের পকেট থেকে নিহাদের পিস্তলটা বের করে নিহাদের মুখের সামনে ধরলো। নিহাদ হতবম্ভ হয়ে গেলো যখন দেখলো আশিন ত্বরিত বেগে বাম হাত দিয়ে পিস্তলের রিকোয়েল স্প্রিংটার মাধ্যমে স্লাইডার মুভ করে ট্রিগারে ডান হাতের তর্জনীটা রাখলো।

নিহাদের হতবম্ভ ভাব দেখে আশিনের চক্ষু হাসলো। একবার পিস্তলের গায়ে তাকালো। বাঁকা হেসে বললো,“ GLOCK 17 Gen 4. ২২ আউন্স এর ওজনের আর ফুল লোডেড ম্যাগাজিনের এমন দামী পিস্তল নিশ্চয় কোনো সাধারণ একটা যুবকের নিকট লাইসেন্সসহ থাকার কথা নয়।’’

থামলো আশিন। ভ্রু যুগলের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বললো,“ তোর মতো একজন ইন্সপেক্টর এমন পুরোনো মডেল ইউজ করে এটা আসলেই মানানসই নয়। টাকা লাগলে আমায় বলিস, আমিই নতুন একটা 9mm এর পিস্তল কিনে দেবো তোকে।’’

নিহাদ রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশিন নিহাদের মাথায় পিস্তলটা ঠেকিয়ে নিহাদকে পেছনে নিয়ে যেতে যেতে গাছের সাথে ঠ্যাকালো। আর দাতে দাত চেপে বললো,“ আমাকে আমার কাজ করতে দে। নয়তো ম্যাগাজিনে একটা গুলিও অবশিষ্ট থাকবে না। সব তোর মাথায় ঢুকিয়ে দেব।’’

নিহাদ ভয় পেলো না। শুধু আশিনের এই ভয়ানক রূপ দেখছে।

“ ওর মাথায় নাহয় সব গুলিই ঢুকিয়ে দেবে। তবে তুমি ঠিক কতটা স্বাভাবিক থাকবে সেটা আমি ভাবছি মিস. শিমু।’’

আশিন কানে হাত দিয়ে পেছনের দিকে না তাকিয়েই বললো,“ ইন্সপেক্টর মিলি! আপনি কি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন?’’

মিলি নিজের পিস্তলটা আশিনের মাথায় ঠেকালো। আর হেসে বললো,“ ভয় নয়, সচেতন করছি।’’

দিনে দুপুরে তাদের এমন রূপে কেউ দেখলো না। কারণ জায়গাটা জনমানবহীন। শুধুমাত্র এই ভয়ানক সচেতনতার দৃশ্যের সাক্ষী রইলো প্রকৃতি।

ড. ইভানকে গ্রেফতার করা হলো আজ দুপুরে। কারণ তার বাড়ি থেকে বিভিন্ন মাদক ম্যাজিক মাশরুম, মরফিন, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথিডিনসহ দেশি মদ, চোলাই মদ পাওয়া গিয়েছে। একজন ড. এর কাছে এসব মাদকদ্রব্য কেন থাকবে? এই দণ্ডনীয় অপরাধের জন্য হলেও ছেলেটাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এছাড়া বাড়িটার একটি রুমে একটি ছোট্ট কাঁচের বিকারে ‘হোবো স্পাইডার’ এর বিষাক্ত বিষ পাওয়া গিয়েছে। এই মাকড়সা সাধারণত উত্তর আমেরিকায় পাওয়া যায়। তবে ড. ইভানের মতো সাধারণ ড. এর কাছে এটা কিভাবে আসলো? সেজন্যই তাকে চালান করে দেওয়া হয়েছে একেবারে শহরে। তার বাড়ি তল্লাশি করার জন্য রূপক নিজে গিয়েছে। ইভান রূপককে হুমকি দিলেও রূপক সেসবে খুব একটা পাত্তা দেয় নি। ইভানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেটা শুধুই হেসেছে। কারণ তাকে গ্রেফতার করেও যে কোনো লাভ নেই।

তবে চেয়ারম্যান অশোক তালুকদারের মাতা আশিয়া তালুকদারকে খুনের অপরাধে জেল খাটলে খাটতেও পারে। আশিয়া তালুকদাকে ভয়ানক জৈব সায়ানাইডের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়েছে। সায়ানাইড ভীষণ ভয়ানক এক জৈব যা মানবদেহের কোষের মৃত্যু ঘটায়। আর এটাই নাকি আবার ড. ইভানের বাড়িতেই পাওয়া গিয়েছে। অশোক তালুকদার ইভানকে মারতে গিয়েছিলো পুলিশ স্টেশনে তবে রূপক খুব কষ্টে থামিয়েছে উনাকে।

উচ্ছ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে সেই সকাল থেকে। অশোক তালুকদারের মাতৃশোকে আহাজারি সবকিছুতে বিরক্ত হলেও মুখে সেসব প্রকাশ করলো না মোটেও। মানুষ মরবেই, এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এতে এতো রংধং এর কি আছে?

তার মনে পড়লো মিসেস উষাকে মারার কথা। মিসেস উষাকে মারা হয়েছে ‘ডেথ এডার’ নামে অস্ট্রেলিয়ান একটি সাপের বিষের মাধ্যমে। এই সাপের বিষ ছয়ঘণ্টা পর কার্যকর হয়। আর এই বিষটা আশিনই মিশিয়েছিলো মিসেস উষার পানীয়তে। উচ্ছও এই প্ল্যানে সামিল ছিলো। নিজেকে ধন্য মনে করেছে উচ্ছ। এমন মাস্টারপ্ল্যানে নিজেকে অন্যতম একজন ব্যাক্তি হিসেবে রাখতে পেরে।

রূপক উচ্ছর দিকে বারকয়েক তাকালো। উচ্ছ অশোক তালুকদারের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এদিকে অশোক তালুকদার মায়ের মৃত্যুসহ, চেনা পরিচিত তার বয়সী সেই বৃদ্ধদের মৃত্যু নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। বার বার পুরোনো স্মৃতি চোখের সামনেই ভাসছে উনার। ভাসছে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর ঘটনা। মিসেস উষা কেন মারা গিয়েছে এ সম্পর্কেও তিনি অবগত। এছাড়া সবচেয়ে বড় কথা সে কিভাবে এখনও বেঁচে আছে? আর এত বছর পরই বা কিভাবে ওই ঘটনার সামিল সবাই এভাবে মারা যাচ্ছে এ নিয়েও উনি নিজেই ভীষণ সন্দিহান। সবই মাটিচাপা দিয়েছে অশোক তালুকদার। আর সহায়তা করেছে যে ব্যক্তি সেই বা চুপ কেন? সে ছাড়া তো এই ঘটনা সম্পর্কে আর কেউ জানতোই না। কিভাবে কি হচ্ছে এ নিয়ে অশোক তালুকদার ভীষণ চিন্তিত।

চলবে,…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *