রোদের কঠিন তেজ মেঘের আড়ালে মিইয়ে যাচ্ছে। কালো মেঘগুলো জোট বেঁধে প্রখর হর্তালে নামছে। উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসছে সেগুলো।
মৃদুমন্দ বাতাসে এলোমেলো ভাবে উড়ছে তুষারের চুলগুলো। কপাল কুঁচকানো। নাক ফুলিয়ে চোখে মুখে মারাত্ত্বক রাগ ফুটিয়ে রেখেছে সে। শাহাদাত আঙুল দিয়ে বারবার কপাল ঘঁষছে। হৈমন্তী হতাশ নয়নে তুষারের কার্যকলাপ দেখল কিছুক্ষণ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ছেলেটা মাঝে মাঝে এত রেগে যায়! হৈমন্তী নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পার্কের আশেপাশে একবার নজর বুলায়। ব্যস্ত মানুষগুলো ব্যস্ত হয়ে জগিং করছে, হাঁটছে, ফোনে কথা বলছে! কেউবা বেঞ্চে বসে গল্পগুজব করছে। আর কেউ কেউ তাদেরই মতো নিশ্চিন্তে ঘাসের ওপর বসে আছে। হৈমন্তী নজর ফেরালো। স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “আর কতক্ষণ তুষার?”
— “আমি রাগ কমাতে পারছি না, হৈমন্তীকা। অপেক্ষা করুন।”
— “আকাশ কালো হয়ে আসছে তুষার। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে।”
গম্ভীর স্বরে তার একরোখা উত্তর, “নামুক।”
হৈমন্তীর উদাসীনতা বাড়লো। সেই সঙ্গে পায়ের চিনচিনে ব্যথাটাও ক্ষীণ বেড়ে গেল যেন! সেসময় বাস থেকে টেনে আনার সময় কি যেন পায়ে বারি খেয়েছিল তার। ফলসরূপ বাম পায়ের গোড়ালি গভীর ভাবে কেটে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করে নিলো হৈমন্তী। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বললো,
— “পানি খেয়ে রাগ কমান তুষার। দেড়ি হচ্ছে আমার। এতক্ষণ বসে থাকতে পারব না আমি।”
তুষার বাধ্য ছেলের মতো পানিটা নিলো। ন্যায়নীতি বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি পান করলো। বললো,
— “বোতলটা আপনাকে আর ফেরত দিচ্ছি না হৈমন্তীকা। এটা আমি আমার কাছে রেখে দেব।”
বলে হাসলো তুষার। হৈমন্তী চেয়ে রইলো। শান্ত, শীতল দৃষ্টিতে। আনমনেই হাত বাড়িয়ে তুষারের এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিলো। বিস্ময় যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তুষারকে। মৃদু কেঁপে উঠল তার নেত্রজোড়া। হৈমন্তী হাত সরাতে নিলেই বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় তা ধরে ফেলল সে। সরল গলায় অনুরোধ করলো,
— “হাত সরাচ্ছেন কেন হৈমন্তীকা? আমার ভালো লাগছে। আবার করুন।”
হৈমন্তী শুনলো না। জোড় করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,
— “আপনাকে বারবার বোঝানোর পরও আপনি বুঝতে চাইছেন না তুষার। আমার ওপর একটু বেশিই আশা করে আছেন। কেন এমন করছেন? কেন বুঝতে চাইছেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনার আর আমার মাঝে কোনো ধরণের বৈবাহিক কিংবা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। আপনার বাবা, পরিবারও আমাদের কখনো মেনে নেবে না। না মেনে নেবে আমার বাবা। তবুও কেন আমাকে নিজের এতটা কাছে টেনে আনছেন? হুটহাট হাত ধরছেন, যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাচ্ছেন! এসব বন্ধ করুন তুষার। নিজের অধিকার খাটানো বন্ধ করুন।”
তুষার চুপচাপ শুনলো হৈমন্তীর পুরো কথা। গাম্ভীর্য নিয়ে চেয়ে রইলো তার মুখপানে। সরল গলায় আওড়ালো,
— “সম্ভব না হৈমন্তীকা। দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার পিছু নেবো। তীর্থের মতো অপেক্ষা করবো। তবুও আপনাকে কখনো ছাড়বো না। আপনাকে কাছে টেনে নেবো, হুটাহাট হাত ধরবো, অধিকার খাটাবো। কেননা আপনি আমার। আপনাকে ভালোবাসা অধিকারও আমার।”
অদৃশ্য কষ্টের কাঁটাযুক্ত আঘাতে ভেতরটা নিদারুণ কেঁপে কেঁপে উঠলো। নেত্রকোণে বিন্দু জলের আভাস টের পেল হৈমন্তী। সঙ্গে সঙ্গে তা নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করলো। আড়চোখে একবার দেখলো তুষারকে। যতবার সে তুষারের মায়াময় চেহারাটি দেখে, কান্না যেন উপচে আসতে চায় ওর। নিয়তির ওপর বড্ড অভিমান হয়। পরপরই আফসোস হয় ভীষণ। এত বোঝানোর পরও তুষার কেন বুঝতে চায় না? এত পাগলামি কেন করে?
ভাবনার অকূলপাথারেই তুষার হঠাৎ ব্যগ্র গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,
— “আপনার পায়ে কি হয়েছে হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী নিজের পায়ের দিকে তাকালো। গোড়ালি থেকে পায়ের তালু অব্দি আধতাজা রক্তের সূক্ষ্ণ রেখা দৃশ্যমান। তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বোতলের পানিটুকু পায়ে ঢেলে দিলো তুষার। প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে আঘাত প্রাপ্ত স্থানে বেঁধে দিলো। আবারও প্রশ্ন করে উঠলো,
— “ব্যথা কিভাবে পেয়েছেন?”
— “বাস থেকে নামার সময় কিভাবে যেন কেটে গেছে।” হৈমন্তীর নির্বিকার উত্তর।
তুষার রুমালের ওপরই আলতো হাত বোলালো। লহু স্বরে বললো,
— “দুঃখীত হৈমন্তীকা। আমি খেয়াল করিনি।”
— “সমস্যা নেই। এতক্ষণে আপনার রাগ কমেছে নিশ্চই? এবার আমাকে যেতে দিন।”
তুষার দিরক্তি করে বললো,
— “উহু! আপনি আমার রাগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।”
অথচ তুষারের কণ্ঠস্বর একদম স্বাভাবিক, শান্ত!
_____
তুষারদের এলাকার পাশেই একটা বিল্ডিংয়ে ফ্যামিলি বাসার টুলেট লাগানো। নাওয়াজ আর আসরাফ সাহেব বাসাটা দেখে এসেছেন। বলা যায়, মোটামোটি কথাও পাকা করে এসেছেন তারা। যদিও এ বাসা থেকে নতুন বাসাটি একটু বেশিই ছোট। তবুও দিরক্তি করেন নি আসরাফ সাহেব। পরে নাহয় নতুন বাসা খুঁজবেন। কিন্তু এখন আর এক মুহুর্তও এ বাসায় থাকবেন না।
গোধুলি বেলায় তৈমুর ভবনে এসে পৌঁছায় হৈমন্তী। বাহিরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সমাগম। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে ধরণী। হৈমন্তী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। পেছন থেকে তুষার খানিক উঁচু গলায় বললো,
— “আস্তে হাঁটুন হৈমন্তীকা। আপনার পায়ে ব্যথা।”
স্বভাবসুলভ, আস্তে হাঁটলো না হৈমন্তী। পায়ের গতি বাড়ানোর আগে আগেই হঠাৎ নাওয়াজের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, “হৈমন্তী?”
হৈমন্তী চমকালো। উপরে তাকাতেই দেখল, নাওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে প্রথম তলার সিঁড়ির কাছে। সে নেমে হৈমন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তুষারকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— “আজকে এত দেড়ি করে আসলে যে হৈমন্তী? তোমার সাথের ছেলেটা কে?”
হৈমন্তী ভীষণ অপ্রস্তুত হলো। একবার তুষারের দিকে তাকিয়ে আবারও নাওয়াহের দিকে তাকালো। মৃদু স্বরে বললো,
— “আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে।”
— “এটা কি ওই ছেলেটা?”
একটু চুপ থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠল নাওয়াজ। হৈমন্তীর অপ্রস্তুত ভাব বাড়লো। কি বলবে ভেবে পেল না। তুষার তখনো ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে আছে। বিরক্ত লাগছে তার। সরব বলে উঠল,
— “চলুন হৈমন্তীকা। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে হৈমন্তীকে নিয়ে ওপরে চলে গেল সে। নাওয়াজ আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে গিয়ে আবার থেমে গেল।
দ্বিতীয় তলায় আসতেই হৈমন্তীর হাত ছেড়ে দিল তুষার। স্বাভাবিক স্বরে বললো, “ছেলেদের থেকে দূরে থাকবেন হৈমন্তীকা। আমি আমার রাগ সামলাতে পারি না। হিংসে তো আরও না।”
চলবে,…