হৈমন্তীকা [পর্ব-২৩]

জড়োসড়ো হয়ে চুপচাপ বসে আছে হৈমন্তী। দৃষ্টি মেঝের দিকে সীমাবদ্ধ। বেশিক্ষণ এক জায়গায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ কেমন জ্বালা করছে তার। ঘোলা হয়ে আসছে। হৈমন্তী নিজের দৃষ্টি ফেরালো। দু’চেয়ার দূরত্বে নিশ্চিন্তে বসে থাকা তুষারকে পরখ করে নিলো একবার। মন বলছে, তুষার সত্য বলছে। আবার মস্তিষ্ক বলছে, তুষার মিথ্যে বলছে। তুষার এমন করতেই পারে না। হৈমন্তী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। নিজ মস্তিষ্কের ধারণা সত্য প্রমাণের ক্ষীণ প্রচেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলো,

— “আপনি… আপনি মজা করছেন, তাই না তুষার?”

তুষার নির্বিকার স্বরে ছোট্ট জবাব দিলো, “না।”

চোখের জ্বালা ভাবটা যেন দ্বিগুণ বাড়লো তার। তুষারের দিকে এগিয়ে তার শার্টের কলার শক্ত করে টেনে ধরল হৈমন্তী। ক্ষীপ্ত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,

— “আপনি ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করেছেন আমায়। মানি না আমি এই বিয়ে! মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ!”

তুষার খুব শান্ত নজরে চারপাশটা একবার দেখল। কলারে থাকা হৈমন্তীর হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

— “কলার ছাড়ুন হৈমন্তীকা। নার্সগুলো দেখছে।”

— “দেখুক!”

— “আঙ্কেল জেগে যাবেন।”

— “জেগে যাক! আপনি আমাকে রেজিট্রি পেপারটা দিন। আমি এক্ষুণি ছিঁড়ে ফেলব ওটা।”

তুষার দিলো না। অল্প শক্তিতে কলার থেকে হৈমন্তীর হাত ছাড়িয়ে নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিলো। চোখের নিচটায় বৃদ্ধা আঙুল বুলিয়ে পানির অদৃশ্য অস্বস্তিটুকুও বিলীন করে দিলো যেন। কোমলস্বরে আওড়ালো,

— “আপনাকে বেঁধে রাখার একমাত্র মাধ্যম ওই কাগজ, হৈমন্তীকা। ছিঁড়ে ফেলতে দেই কিভাবে?”

জবাবে হৈমন্তী তখন অধৈর্য হয়ে বললো, “আপনি বদ্ধ উম্মাদ হয়ে গেছেন তুষার। কি করেছেন এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি। এখনো সময় আছে, ভুল সুধরে নিন!”

ওপাশ থেকে তার একরোখা উত্তর, “ইচ্ছাকৃত ভুলগুলো কখনো শুধরানো যায় না হৈমন্তীকা।”

হৈমন্তী হাল ছেড়ে দিলো। যে বুঝতে চায় না তাকে বোঝানো মূর্খতা বৈ কিছুই না। হতাশ মনে তুষারের পাশ ছেড়ে উঠে কেবিনের দিকে এগোলো সে। পর্দার ফাঁকে আসরাফ সাহেবের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। কেমন নির্জীব হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। ফ্যাকাশে ঠোঁটখানার চামড়াগুলো কেমন ভেসে ভেসে আছে। হৈমন্তী উদাস মনে সেদিকে তাকিয়ে রইলো প্রায় অনেক্ষণ। থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বহুবার।

রাবেয়া হৈমন্তীকে দরজার কাছে দেখে ধীর-স্থির পায়ে এগিয়ে এলেন। সেবারের মতো এবারও তুষারকে নিয়ে একটি প্রশ্নও করলেন না। শুধু আলতো ভাবে গালে হাত বুলিয়ে দিলেন একটু। শাড়ির আঁচল থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,

— “রাত হচ্ছে। তোকে কেবিনে দেখলে তোর বাবা বকবেন। বেশি অভিমান করেছেন তো! বাইরে থাকাটাও নিরাপদ না। তুই বাসায় চলে যা। কাল সকালে নাহয় আবার চলে আসবি।”

কষ্ট হলেও হৈমন্তী মেনে নিলো মায়ের কথা। জিজ্ঞেস করলো,

— “হেমন্ত যাবে না?”

— “না। ও থাকুক।”

জবাবে হৈমন্তী মাথা দুলালো মাত্র। সেখান থেকে সরে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। দৃষ্টি ফেললো আঁধারে ঢাকা খোলা নভস্থলে। জ্বলজ্বল করতে থাকা চাঁদটির দিকে। তুষারও হৈমন্তীর পাশে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তবে সে আকাশের চাঁদটির পানে একবার চোখ তুলে চাইলো না পর্যন্ত! বক্ষস্থলে দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে গুঁজে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল তার চাঁদটিকে! তার হৈমন্তীকাকে!

রাত এগারোটা বেজে দুই মিনিট.

হৈমন্তীদের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতেই হৈমন্তীর জন্যে আনা বিরিয়ানির প্যাকেট দু’টো ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখল তুষার। হৈমন্তী ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। হাসফাস করছে সে। তুষার ঘুরে দাঁড়াতেই ভীতুগ্রস্ত কণ্ঠে আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো,

— “আপনি কি আজ এখানেই থাকবেন?”

শুনে দূর্বোধ্য হাসলো তুষার,

— “আইনত এখন আপনি আমার স্ত্রী, হৈমন্তীকা। ধর্মীয় ভাবে নন। বিয়েটা সুষ্টুভাবে হোক! জামাই আদর পেতে অবশ্যই থাকব।”

তুষার থামলো। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলো, “এই বিল্ডিয়ের দু’বিল্ডিং পরের বাড়িটা আমার বন্ধুর। আমি আজ রাত ওখানেই থাকব। আপনি বিরিয়ানিটুকু খেয়ে নেবেন। দরজা, জানালা ভালো করে আটকে রাখবেন। রাতে যদি কেউ দরজায় নক করে ভুলেও খুলবেন না। আমাকে কল করবেন। আমি এলে আপনাকে মেসেজ করে তারপর আসবো।”

হৈমন্তী সম্মতি দিয়ে বললো “আচ্ছা।”

তুষার হুট করে কাছে এসে হৈমন্তীর ললাটে অধরযুগল ছুইয়ে দিলো। পিঠ অব্দি এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো, “কেঁদেকেটে রাতের ঘুম নষ্ট করবেন না হৈমন্তীকা। কিছু লাগলে ফোন দেবেন। আমি কাল সকাল সকাল চলে আসবো।”

তুষার চলে যাওয়ার অনেক্ষণ হয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে অন্ধকার রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে হৈমন্তী। কেমন ভয়, ভয় লাগছে তার। পুরো ফ্ল্যাটে সে একা! ভাবতেই ভয় যেন আরও দ্বিগুণ বাড়লো। চটজলদি উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলো সে। চারিদিক আলোকিত হতেই ভয়টা যেন একটু কমলো। তবে জানালার পর্দা সরাতে গিয়ে হঠাৎ-ই নজরে এলো, কয়েকজন লোক বাইক নিয়ে তাদের বিল্ডিংয়ের সামনেই আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন হৈমন্তীর ফ্ল্যাট বরাবর আঙুল দিয়ে ইশারা করে কি যেন বলছে অন্যদের। হৈমন্তীর কেমন যেন লাগলো ব্যাপারটা। ভেতরটা আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে বদ্ধ রুমগুলো দেখে বড্ড একা একা লাগছে নিজেকে। এই নির্জন স্থানটা কোনো জ্বিন-ভূতের আস্তানা বৈ কিছুই মনে হচ্ছে তার। হৈমন্তী অশান্ত মনে বিছানায় গিয়ে বসলো। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে কল করলো তুষারকে। রিং হলো। সেকেন্ডের মাঝেই রিসিভ করলো সে। পুরুষালী গলার শান্ত আওয়াজে বললো, “কি হয়েছে হৈমন্তীকা? ঘুম আসছে না?”

হৈমন্তী আমতা আমতা করলো, “আসছে।”

— “তাহলে?”

হৈমন্তী জবাবহীন। তুষার আবার প্রশ্ন করলো,

— “ভয় লাগছে?”

সে আস্তে করে জবাব দিলো, “হু।”

ওপাশ থেকে নিঃশব্দে হাসলো তুষার। কয়েক সেকেন্ড কিছুই বললো না। এরপর কণ্ঠ মিইয়ে, অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে আওড়ালো, “ভয় নেই হৈমন্তীকা। আমি আছি। আপনি ফোন কানে রেখে শুয়ে পড়ুন। আমি কথা বলবো, আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করবেন। ঠিকাছে?”

চলবে,..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *