এক সমুদ্র প্রেম [পর্ব-২১]

পিউ একটু পরপর হাসছে। ঠোঁট ফাঁকা করে যতবার সাদা দাঁত বেরিয়ে আসছে,ঠিক বোঁকার মত দেখাচ্ছে তাকে। আবার একটু পরপর মাথা চুল্কাচ্ছে। এই মুহুর্তে সে ভীষণ রকম চাইছে মারিয়ার সঙ্গে ভাব করতে। কিন্তু কীভাবে,কোত্থেকে, কী করবে,কী বলবে! সেই প্রথম দিন থেকে মনে মনে দূর-ছাই করা মেয়েটি হলো মারিয়া। পিউ নিজে জানে,ভেতর ভেতর ওর চৌদ্দ গোষ্ঠি গা*লি দিয়ে উড়িয়েছে সে। একটা কথা জিজ্ঞেস করলেও ভালো করে উত্তর করেনি। এখন তার সাথে হুট করে কীভাবে মিলমিশ করা যায়?

সে আস্তেধীরে পাটিতে বসল। গোলচক্রের এক কোনে, ঠিক মারিয়ার পাশে। বাবু হয়ে বসে,কোলের ওপর রাখা হাত কঁচলালো। পুষ্প,মারিয়া,বর্ষা, মৈত্রী সবকটা মিলে গল্প জুড়েছে। হা করে শুনছে শান্তা,সুপ্তি। পিউ কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা এই গল্পে সে প্রবেশ করবে কী করে। কোন দিক দিয়ে ঢুকবে? কথা বলার ফাঁকে মারিয়া একবার তাকাল। পিউ আগামাথা না ভেবেই দাঁত বার করে হাসল। উত্তরে মারিয়াও মৃদূ হাসে। ফের গল্পে বসে। অনেকক্ষন পর পিউয়ের মোটা মাথায় বুদ্ধির আবির্ভাব ঘটে। দারুণ ফঁন্দি আবিষ্কার করল সে। আগ বাড়িয়ে টান দিয়ে মারিয়ার হাতখানা আনল। চোখের সামনে ধরে বলল,

‘ একই! আপু আপনি মেহেদী পড়েননি? এ বাবা হাতটা কেমন খালি খালি লাগছে।’

মারিয়া অবাক হলো। রীতিমতো কুঁচকে আসে ভ্রুঁ। পিউতো ওকে দুচোক্ষে দেখতে পারেনা। হঠাৎ এত আলাপ? মারিয়ার বিস্মিত চেহারার দিক চেয়ে পিউয়ের অস্বস্তি হয়। বানানো কথা গুলিয়ে যায়। ধরে রাখা হাতটা ছাড়বে ছাড়বে করতেই মারিয়া গাল ভরে হাসল। পিউয়ের হাতটা শক্ত করে আগলে বলল,

‘ না গো,সবে তো এলাম। তাই পড়িনি। তুমি পড়েছ? দেখি।’

তারপর রাঙা হাতখানা উল্টেপাল্টে দেখে বলল

‘বাহ! ভীষণ সুন্দর তো! কে দিয়ে দিয়েছে?”

পিউ সহজ হলো। মারিয়ার মিশুকে ভাব তার অপ্রস্তুতা উড়িয়ে দিলো। ফটাফট বলল,

‘ মৈত্রী আপু। প্রফেশনাল আর্টিস্ট একদম।’

মৈত্রী লজ্জ্বা পেয়ে বলল ‘ কী যে বলো না! ছাতার মাথা আঁকি…”

মারিয়া বলল,

‘ না না সত্যিই ভালো হয়েছে। সবাইকেই তুমি পরিয়ে দিয়েছ তাইনা? আমাকেও দেবে?’

‘ এখনই দেবে?’

‘ তুমি চাইলে দিতাম।’

শান্তা বলল ‘ কিন্তু মেহেদী তো সব শেষ। এতগুলো হাত,ওই কটায় হয়? ‘

বর্ষা বলল,

‘ শেষ তো কী? আনাব আবার।’

‘ কে যাবে এতরাতে?’

‘ বাড়িতে ছেলের অভাব আছে? বেলাল কে একটা ডাক দে তো সুপ্তি। ‘

সুপ্তি উঠে গেল। এইসব ছোট ছোট ডাকাডাকির কাজ সবসময় তার ঘাড়ে পরে। পুষ্প দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বলল,

‘ বেলাল যাবে এখন? ওতো দিনেই ঘর থেকে দোকানে যায়না। এই রাতে….’

‘ কষে এক ধম*ক দিলে যাবে। তাছাড়া মারিয়ার কাজ না? শুনলে ড্যাংড্যাং করে আগাবে দেখিস। ছোট বেলায় ওকে বিয়ে করতে চাইত তো! ভাব একবার,পড়ত ক্লাস টুতে,সে বিয়ে করবে তার বড় বোনের বান্ধবীকে।’

মারিয়া হেসে ফেলল। হাসল বাকীরাও। মেয়েদের খিলখিল হাসিতে ভরে উঠল কামড়া। এর মধ্যে ঘরে ঢুকল বেলাল। শান্তা আর সে একই ক্লাসে। পড়নে রঙিন পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা। মাথায় ছোটখাটো একটা টুপিও চড়িয়েছে বাবার দেখাদেখি। এসেই কর্ক*শ কণ্ঠে বর্ষাকে বলল,

‘ এই তুই না বউ?এমন জোরে জোরে হাসছিস কেন? লজ্জ্বা শরম নেই?’

বর্ষা হাসিটা চট করে মুছে যায়। পরমুহূর্তে জ্বলেপুড়ে বলল,’ না নেই। তোর কোনও সমস্যা?’

‘ আমার কী সমস্যা? যখন আম্মু এসে বলবে,বুঝবি। যাক গে,প্রচুর ব্যস্ত,ডেকেছিস কেন? ‘

বর্ষা মুখ বেঁকিয়ে বলল,

‘ ইশ! কী আমার ব্যস্ত পাব্লিক। ভাবখানা এমন যেন সব কাজ ও একাই করছে!’

বেলাল দুই ভ্রুঁ কপালে উঠিয়ে বলল,

‘ করছি মানে? করছিইত। তোর মত শাড়ি চুড়ি আর পাউডার মেখে বসে আছি না কী? একটা কাজও করেছিস? কাল থেকে খেঁটে মরছি আমি। ‘

সুপ্তি পেছন থেকে বলল,

‘ ভাইয়া তুমি মিথ্যে বলোনা,তুমি একটা কাজও করোনি। আমি দেখেছি পেছনের উঠোনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলে। ‘

বেলাল পেছন ঘুরে ধম*ক দিয়ে বলল ‘ চুপ থাক। কেন ডেকেছিস তাই বল,আমার অনেক কাজ।’

‘ কয়েকটা মেহেদী এনে দে,ফুরিয়ে গেছে।’

বেলাল কপাল কুঁচকে বলল,

‘ কেন? তোর বর দেবেনা? আর কত আব্বুর টাকা ধ্বং*স করবি!’

‘ এক চ*ড় মারব। ওরা আসতে আসতে অনেক রাত হবে। এনে দে এখন। খলিল কাকার দোকান থেকে আনবি,ওনার গুলো ভালো হয়।’

বেলাল আপত্তি জানিয়ে বলল ‘ পারব না। নিজের টা নিজে আন গিয়ে।’

বর্ষা চেঁ*তে গেল,

‘ পারবিনা?’

‘ না।’

‘ আম্মুকে বলব?’

‘ বল।’

বর্ষা হা করতে নিলেই মারিয়া ইশারায় থামিয়ে দিলো। কাছে গিয়ে নরম স্বরে বলল,

‘ এনে দাওনা ভাইয়া। এই দ্যাখো, সবাই হাতে মেহেদী দিয়েছে,আমারটা বাকি। তুমি না আনলে কে আনবে বলোতো!’

বেলাল উদ্বোলিত হয়ে বলল,

‘ ও তুমি পরবে? আগে বলবেনা আপু? দাঁড়াও,কটা লাগবে?

বর্ষা হাহা*কার করে বলল,

” এই, তুই কি আমার ভাই? আমি বললাম মুখের ওপর মানা করল,আর যেই মারিয়া বলেছে ওমনি রাজি?’

‘ তবে? তুই আর মারিয়াপু এক হলো না কী? তুই সারাক্ষন আমাকে যে মা*র গুলো দিস,আপু একটাও দেয়?’

‘ আর তুই যে ওইদিন খা*মচে আমার মাংস তুলে ফেললি? তার আগের দিন যে ঘু*ষি মেরে হাতটা ব্যথা বানালি তার বেলা?’

‘ তুই মা*রতে এসেছিস,তাই মা*র খেয়েছিস। শক্তিতে পারিসনা, আমার কী দোষ? শ্বশুর বাড়ি গিয়ে একটু বেশি বেশি খাবি,নাহলে ভাইয়ার সাথে মা*রামা*রি তে জিতবি কী করে?’

বর্ষা নাকে কেঁ*দে বলল,

‘ দেখেছিস তোরা দেখেছিস? কীরকম করছে আমার সাথে! আজ বাদে কাল চলে যাব তখন বুঝবি…’

বেলাল কাঁধ উচিয়ে বলল,

‘ কী বুঝব? উলটে আমি আরো সময় গুনছি,কখন তুই যাবি আর আমি টুপ করে তোর ঘরটা দখল করব।’

বর্ষা আবার কিছু বলতে গেলে মারিয়া দুহাত জড়ো করে বলল, ‘ ভাই তোরা ঝ*গড়া থামা। আমাদের মাথা ঘুরছে।’

‘ আমি ঝগ*ড়া করিনা। আমি গুড বয়। আচ্ছা এখনই যাচ্ছি তবে,এই আর কারো কিছু লাগবে? আমার শ্রদ্ধেয় বড় আপুগণ, কারো কিছু দরকার হলে বলবেন।’

কথাটা মৈত্রী, পিউ আর পুষ্পর দিকে চেয়ে চেয়ে বলল বেলাল। শান্তা চোখ গুটিয়ে বলল,

‘ আমাকে তো জিজ্ঞেস করলিনা বেলাল।’

বেলাল অনীহ কণ্ঠে বলল,

‘ তোকে জিগেস করব কেন? তুইত আরেকটা শাঁকচূন্নি। যা সর।’

‘ দেখেছো আপু,কীভাবে বলল!’

‘ বলবেনা, শয়*তান তো একটা! ‘

বেলাল বোনের কথা কানে তোলেনা। হেলেদুলে বেরিয়ে যায়। পিউ-পুষ্প পুরোদস্তুর উপভোগ করেছে ওদের ঝগ*ড়া। নানা বাড়ি এলেই এটা মনোরঞ্জনের বিষয়। বেলাল বড় হতে না হতেই কোন্দল শুরু। দিনে ছত্রিশ বার বাঁধবে তাদের বিতর্ক। অথচ দুজনের বয়সের গ্যাপ কিন্তু অনেক।

বেলালের প্রস্থান দেখে মারিয়ার চোখ ভরে ওঠে। রওনাকের কথা মনে পড়ল। আজ কতগুলো মাস ভাইটাকে ভাই বলে ডাকেনা,এরকম ঝগ*ড়া করেনা,খুনশুঁটি নেই। ভাইয়াত আসতে যেতে তার মাথায় চাঁটি মা*রত। নিজের খাবার খেয়েও হা*মলে পরতো ওরটার ওপর। আর আসবেনা সেই দিন। আর না!

চোখের জল কোটর ছড়াতেই মোছার চেষ্টা করল মারিয়া। হলোনা, উলটে গাল ভিজে যায়। বর্ষা তখনি ডাকে,

‘ দাঁড়িয়ে কেন, আয় বোস।’

মারিয়া পেছন ঘোরেনা। সবাই জল দেখে ফেললে? ওদিকে কোটর উপচে আসছে। সে কান্নাটুকু আড়াল করতে ঘর ছাড়ল।ছোট করে বলল ‘ আসছি একটু।’

‘ আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, কতবার বলব? আপনাদের, একটা ডকুমেন্টস হারিয়েছে বলে ছুটির মধ্যেও আমাকে ফোন করছেন? আমিত আসার আগে সব বুঝিয়ে দিয়ে এসছি। দ্বায় তো এখন আমার নয়।’

‘ না স্যার,আসলে এমডি স্যার বললেন….’

‘ আমি স্যারের সাথে কথা বলে নেব। রাখছি…’

সাদিফ লাইন কা*টল। তিঁতি বিরক্ত সে। চাকরি নেয়ার পর থেকে ছুটির দিন ছাড়া অফিস কামাই দিয়েছে বলে মনে পড়েনা। অথচ যেই চারটে দিনের ছুটি নিল,ওমনি তাদের ডকুমেন্টস হারায়? সব ভাঁওতাবাজি। বিড়বিড় করে ‘যত্তসব’ বলে সে ফোন পকেটে ভরতে নিলো। ওপাশ থেকে চোখ মুছতে মুছতে আসছিল মারিয়া। ব্যাস! আবার সেই ধা*ক্কা। সাদিফের বুকের সাথে বাহুর সংঘ*র্ষে

মারিয়া পরতে পরতেও দেয়াল ধরে দাঁড়াল। সাদিফ হেলে গিয়েও সোজা হলো। দুজন হতচকিত হয়ে ফিরে তাকাল। সাদিফ হতভম্ব হলো ওকে দেখে। উপচে পরা কৌতুহল নিয়ে বলল

‘ আপনি এখানে?’

মারিয়া হাত ডলতে ডলতে মুখ কোঁচকায়। ধা*ক্কা খেয়ে হকচকালেও সাদিফকে দেখে অবাক হয়নি। সেত জানত ওরা এখানে। শীতকালে একটা মশার কাম*ড়ও সাংঘাতিক। ভীষণ ব্য*থা লেগেছে হাতে। সে চেহারা গুঁ*টিয়ে রেখেই বলল,

‘ আপনি কী আসলেই চোখে কম দ্যাখেন? না কি বারবার জেনেবুঝে ধা*ক্কা দিচ্ছেন?’

সাদিফ আকাশ থেকে পরে বলল,

‘ জেনেবুঝে ধা*ক্কা দেব কেন? দেখতে পাইনি।’

‘ পাবেন কী করে? মেয়ে দেখলে তো অন্ধ হয়ে যান। শরীর সুড়সুড় করে।’

সাদিফ দাউদাউ করে জ্ব*লে উঠে বলল,

‘ বাজে কথা বলবেন না। দুনিয়ায় কী মেয়ের অভাব পরেছে যে আপনাকে দেখে ধা*ক্কা দেব?’

‘ আপনার মত ছেলেদের পরতেও পারে। ‘

সাদিফের আত্মমর্যাদায় দাগ কা*টে। চশমাটা ঠেলে পুরু কণ্ঠে বলল,

‘ শুনুন মিস,আপনি শুধুমাত্র ভাইয়ার বন্ধু বলে আমি কিছু বলছিনা। তার মানে এই নয় যে আপনি যা খুশি তাই বলবেন।’

মারিয়ার মুখস্রী ওমনি শিথিল হয়। ঠোঁট চে*পে দুদিকে চোখ ঘোরায় সে।

মনে মনে ভাবে ‘ এর মানে ছেলেটা ধূসরের ভাইয়ার ছোট?”

চটপট দুষ্টু বুদ্ধি এঁটে ফেলল সে। বুকের সাথে হাত বেঁ*ধে বলল

‘ তাই? আপনি রেসপেক্ট বোঝেন? বয়সে বড় এক মেয়ের সাথে ঝ*গড়া করছেন,মুখে মুখে তর্ক করছেন আর বলছেন কিছু বলছিনা? হাস্যকর না ?’

সাদিফ বলল না কিছু। বিরক্ত ভঙিতে চোখ নামাল। কপালে গাঢ় ভাঁজ।

মারিয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমাদের সময় আমরা বড়দের এক হাত দূরে দেখলেই সালাম দিয়েছি। বয়সে বড় ভাই,বোন, এদের চোখের দিক চেয়েও কথা বলিনি। আর আজকের জেনারেশন,সন্মান তো দূর,একটা কথা মাটিতে পরেনা এদের। সত্যিই,দুনিয়াটা রসাতলে গেল!’

সাদিফ ক*টমটিয়ে তাকাল। স্পষ্ট জবাবে বলল,

‘ সন্মান দিচ্ছিনা,কারন আপনাকে আমার সন্মানের যোগ্য মনে হচ্ছেনা। বয়স টমের মত আর সাইজ জেরির মত হলে কেই বা সন্মান দেবে বলুন? আপনি বরং এক কাজ করুন,বাড়ি ফিরে ডজন খানেক হরলিক্স কিনে খান। গ্রোথ ভালো হবে। গায়ে পায়ে বাড়লে আমি না হোক অন্য কেউ সন্মান দিতেও পারে।’

মারিয়া হতবুদ্ধি হয়ে গেল। অগোছালো পাতা ফেলে বলল,

‘ আপনি কিন্তু আমার বডি শেমিং করছেন।’

‘ করছি।’

‘ লজ্জ্বা লাগেনা,নিজের সিনিয়র একজনের সাথে এভাবে কথা বলতে?’

সাদিফ সামনে পেছনে মাথা দুলিয়ে বলল,

‘ লাগছে। যাকে আমি নিঃসন্দেহে তুলে একটা আ*ছাড় মারতে পারব,তাকে সিনিয়র ভাবতে ভীষণ লজ্জ্বা লাগছে,বিশ্বাস করুন।’

মারিয়া হা করে ফেলল। এত বড় কথা! আঙুল তুলে বলল,

‘ দেখুন!’

‘ দেখান।’

আঙুলটা ভে*ঙে এলো তার।

‘ অস*ভ্য!’

‘ সেম টু ইউ।’

‘ হুহ!’

ভেঙচি কে*টে চলে গেল মারিয়া। সাদিফ ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে বলল

‘এই আপদ এখানে এলো কী করে?’

*****

মারিয়া ঘন করে মেহেদী পরেছে হাতে। মৈত্রী প্রচুর ক্লান্ত। সারাটা বিকেল বসে বসে সবাইকে দিয়ে দেওয়ায় পিঠ, ঘাড়, হাতের কব্জি সব ব্যা*থায় একশেষ । সে বিছানায় শোয়ার জন্যে উঠতে গেলেই মারিয়া বাঁ*ধা দিল।

‘কোথায় যাচ্ছো?’

মৈত্রী ক্লান্ত কণ্ঠে জানাল ‘ একটু শোব।’

‘ আরেকটু দাঁড়াও। ‘

মারিয়া ফোন ওঠায় হাতে। ক্যামেরা খুলে ঘোষণা দেয়,

‘ সবাই সবার মেহেদী পরা হাত এভাবে সামনে মেলে দাও। আমি একটা হাতের ছবি নিই,ডে দেব।’

পিউ জামার ফুলহাতা গোঁটাল। যতটুকু মেহেদী পরেছে ততটুকু বের করে চিৎ করে সামনে বাড়িয়ে দিলো। একই ভাবে আদেশ মানল বাকীরাও। পুষ্প চ্যাটিং রেখে যোগ দেয় । আগেই গোল হয়ে বসে ছিল সবাই। হাতের চক্র তৈরী হলো এখন। মারিয়া দু হাঁটুতে ভর করে বসে,ক্যামেরা উঁচুতে ধরল।

পিউ হাসিহাসি মুখে বসে ছিল। পেতে রাখা রঙিন হাতগুলো কী সুন্দরই না লাগছে দেখতে! সবার হাতের দিক একবার একবার চোখ বোলায় সে। আচমকা দৃষ্টি গেল শান্তার হাতের তালুতে। ‘ডি’ লেখাটা দেখেই হতচেতন পিউ। বৃহৎ নেত্রে তাকাল শান্তার মুখের দিক। তার এদিকে খেয়াল নেই। উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে মারিয়ার ক্যামেরার দিক চেয়ে। পিউয়ের চোখদুটো ভীষণ ক্ষো*ভে জ্ব*লে উঠল। দাঁত পি*ষে কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। থমকে উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। কারো ধার না ধরে শব্দ করে কদম ফেলে ঘর ছাড়ল। সবার মনোযোগ বর্তাল সেদিকে। মারিয়ার ছবি তোলায় ব্যাঘাত ঘটে। পুষ্প বুঝতে না পেরে বলল,

‘ ওর আবার কী হলো?’

***

পিউ সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে চোখ মুছছে। দুহাত দিয়ে জোরে জোরে ডলছে। অল্পতেই ছিঁচকাদুনে হয়ে উঠছে আজকাল। একটুতে কেঁ*দে ফেলছে! তার কী দোষ? শান্তা ‘ডি’ দিয়ে কার নাম লিখেছে সে কি জানেনা? ওর সাতকূলে ওই অক্ষর দিয়ে কারো নাম নেই। নিশ্চয়ই ধূসরের নাম? ধূসর ভাই শুধু ওর,তাহলে ওনার নাম শান্তা কেন লিখবে? কোন সাহসে? পিউয়ের ইচ্ছে করছিল হাতটা মু*চড়ে ভা*ঙতে। ভদ্র বলে পারল না। আর এতেই যেন তরতর করে ক*ষ্ট বাড়ছে। রা*গ প্রকাশ করতে না পারার অনেক জ্বা*লা। যদি মনের আঁশ মিটিয়ে শান্তাকে কটা আছা*ড় মা*রতে পারত তবেই না শান্তি!

প্রথম দিন ঠিক বুঝেছিল তাহলে। এই শান্তা দু আঙুলের ডাইনিটা তার ধূসর ভাইকে লাইন মারছে। পিউ ডুকরে কেঁ*দে ওঠে। মিনা-আমজাদ যে ঘরে থাকছেন সে ঘর ফাঁকা এখন। সবাই কাজে । পিউ বুঝেশুনেই ঢুকল ভেতরে। পা দিয়ে দরজা ঠেলে চাপালো। কারো সাথে কথা বলবেনা,কারো চেহারা দেখবেনা। পৃথিবী তাকে চায়না।

পিউ মনঃক*ষ্ট নিয়ে বিছানায় বসে। পায়ের জুতো ছু*ড়ে মারে দূরে। উপুড় হয়ে শুয়ে পরে। বালিশ চেহারায় চে*পে কাঁ*দে। বিড়বিড় করে বলে,

‘ শান্তা,তোকে আমি খু*ন করব বেয়াদব।’

মিনা বেগম অনেকক্ষন ধরে পিউকে খেতে ডাকছেন। তাও মেয়ের আসার নাম নেই। এদিকে বিয়ে বাড়ির এত কাজ! ময়মুনার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেও বিশ্রাম পাচ্ছেন না। এর মধ্যে আলাদা করে ছেলেমেয়ের খেয়াল রাখা সম্ভব? তাও যদি হয় এমন ধেঁড়ি মেয়ে! শ্রান্ত হয়ে চুপ করে গেলেন তিনি। এখন এই মেয়েকে ডেকে ম*রে গেলেও লাভ নেই। সিকদার পরিবারের সব র*ক্তই ঘাড়ত্যাড়া। ধূসর বাড়ির সামনের উঠোনে ছিল। পুরুষরা সব সেখানেই। এদিকে রান্নাঘরেও বসেছে বিশাল আয়োজন। আদা -রসুন ছেলানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন গৃহীনিরা। রাত বাড়ছে তাই বাচ্চাদের খেতে দিলেন আগে। পরে নিজেরা খাবেন না হয়। পুষ্প ফোন টিপছিল চেয়ারে বসে। মিনা বেগম বললেন,

‘ পিউয়ের খাবারটা নিয়ে ঘরে যা,দ্যাখ হলো কী মেয়েটার!’

এর মধ্যে ধূসর বাড়িতে ঢোকে। কারো সাথে কথা না বলে, দোতলায় উঠে যায়। পুষ্প সেদিক থেকে দৃষ্টি এনে আবার ফোনে মন দেয়। মিনা বেগম উত্তর না পেয়ে বললেন,

‘ শুনেছিস কী বললাম? খালি ফোন! এই ফোনই তোকে খেল। ওর খাবারটা দিয়ে আয় যা। নাহলে আজ আর খাবেইনা। ‘

পুষ্প মুখ না তুলেই বলল,

‘ খাবে, দিয়ে আসতে হবেনা। তোমার মেয়ে একটু পরেই আসবে। ‘

মেজাজ খা*রাপ হলো ওনার। বিদ্বিষ্ট কণ্ঠে বললেন ‘তোকে বলেছে?’

‘ আমি জানি।’

‘ কী জানিস?’

পুষ্প রহস্য হেসে বলল ‘ সিক্রেট!’

পিউ বারান্দায় । মায়ের ঘর থেকে এখনও যায়নি। যাবে কী করে? তাকে তো বর্ষার ঘরে শুতে দেয়া হয়েছে। আর ওখানে এখন মানুষে ভর্তি। শান্তা চূন্নিটাও উপস্থিত। আর আজকের পর থেকে ওকে দেখলেও গা জ্ব*লবে পিউয়ের। রা*গ হবে। কখন না ছুটে গিয়ে চুল টেনে ধরে। সে নাক টে*নে গ্রিলে হাত ভরল। হেচকি উঠেছে। কত যে কেঁ*দেছে কেউ জানেনা। সবার কাছে এই কা*ন্না ন্যাকামো মনে হবে,যে শুনবে সে হাসবে। কিন্তু পিউ জানে তার ক*ষ্ট লাগছে। ভীষণ ক*ষ্ট। পিউ ভেজা চোখে একবার নিজের হাতের দিক তাকাল। মধ্যিখানটা এখনও ফাঁকা। ধূসর ভাইয়ের নাম লেখা হয়নি। অথচ শান্তা….

সেই ক্ষনে পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে ওঠে,

‘ পিউ!’

পিউ সদাজাগ্রত হয়। চট করে ঘুরে তাকায়। দাঁড়িয়ে ধূসর। ঘন ভ্রুঁর মাঝে তিনটে ছোট ছোট ভাঁজ। এই শীতেও লোকটা ঘেমে যায়। শ্যামলা রং আর গ্রিল গলে আসা হলুদ আলো, সব মিলিয়ে ধূসর ভাই তার রাজপূত্রের মতন। পিউ বে*দনা ভুলে, নির্নিমেষ চেয়ে রয়। এই লোক,এই মুখ,এই শরীর,এই কণ্ঠ,এই চাউনী,সব কিছু তাকে আকর্ষন করতে সক্ষম। এতটাই আসক্ত সে,ধূসর কখন তাকে আকৃষ্ট করে খাঁদের ধারে এনে দাঁড় করালো টেরও পায়নি। এখন যে আর ফেরার উপায় নেই। জেনেশুনে ঝাঁ*প দিতে হবে, হবেই। ধূসর ভাইয়ের প্রেমে যে ম*রণ সুনিশ্চিত।

পিউ মোহে থেকেই উঠে দাঁড়াল।

‘ খাসনি শুনলাম।’

গুরুভার কণ্ঠ তার ধ্যান ভা*ঙায়। চেতনায় আনে। ফিরে আসে পুরোনো দুঃ*খ, ক্লে*শ। সে মুখ ফিরিয়ে আরেকদিক তাকায়।

‘ খাব না।’

কন্ঠে অভিমান। ধূসর দরজা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আবছা আলোয় পিউয়ের ফর্সা মুখ জ্বলজ্বলে। সে একবার চোরা নজরে ধূসরের কোমড় অবধি দেখে নিলো। ধূসর ঠান্ডা কণ্ঠে শুধাল,

‘ কেন?’

পিউ আরেকবার নাক টানল। ছোট করে জানাল,

‘ এমনি।’

ধূসরের কণ্ঠ দ্বিগুণ ভারী হলো। বলল,

‘ খেতে আয়।’

এগোতে নিলো সে। পিউ উদ্বেগ নিয়ে বলল,

‘ বললাম তো খাব না।’

ধূসর থেমে দাঁড়ায়। ঘাড় বাঁকা করে সূচালো নেত্রে তাকায়।

জিজ্ঞেস করে,

‘ মা*র খাবি?’

পিউ কিছুক্ষন আহত চোখে চেয়ে রইল। আচমকা রক্তজবার ন্যায় ঠোঁটদুটো ভে*ঙে আসে তার । হুহু করে কেঁ*দে উঠল । হতভম্ব হয়ে গেল ধূসর। বিস্মিত সে। আজ অবধি এত বঁকলো,মা*রলোও কখনও তো কাঁ*দেনি। অবাক হয়ে দু কদম এগিয়ে, কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পিউয়ের বাহু ধরে নিজের দিকে ঘোরাল। মোলায়েম কন্ঠে শুধাল,

‘ কেউ কিছু বলেছে?’

পিউ দু-পাশে মাথা নাড়ে।

‘ তাহলে?’

পিউ ঠোঁট কাম*ড়ে ধরে। মনে পড়ছে শান্তার হাতের কথা। অন্য মেয়ের হাতে ভালোবাসার মানুষের নাম দেখলে মাথা ঠিক থাকে? তার অন্তঃপুরের কা*ন্না উগলে এলো। তোলপাড় চলল বক্ষে। আওয়াজবিহীন ক্রন্দনে গাল থেকে গলায় এসেছে অশ্রুরা।

ধূসর অধৈর্য হয়ে পরল। যথাসাধ্য স্থির থেকে বলল,

‘ হয়েছে কী বলবি?’

পিউ হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। ফিনফিনে ঠোঁট ক্রমে কাঁ*পছে। ভেজা কণ্ঠে নালিশ জানাল,

‘ শান্তা ওর হাতে আপনার নাম লিখেছে ধূসর ভাই। ও কেন লিখবে আপনার নাম? আপনার নাম শুধু আমি লিখব,আর কেউনা।’

চলবে,…

  • নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *