সিলিং ফ্যানের ভনভন শব্দ কাঁপিয়ে তুলছে পুরো রুম। ভ্যাপসা গরমের দরুণ শরীরে বাতাসের ছিটেফোটাও লাগছে না। রাবেয়াকে ফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিতে বললেন আসরাফ সাহেব। কপালের ঘামটুকু মুছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তুষারের দিকে। কেমন অভদ্র ছেলেটা। জড়তাহীন। ভয়, ভীতি ছাড়া কিভাবে বসে আছে উনার সামনে। তিনি গলা ঝেড়ে খুক খুক করে কাঁশলেন। গমগমে গলায় বললেন,
—“তোমাকে আমি কি জন্যে ডেকেছি সেটা নিশ্চই জানো?”
তুষার নম্র স্বরে ছোট্ট জবাব দিলো,
—“জি।”
আসরাফ সাহেব আবারও কেঁশে গলা পরিষ্কার করলেন। মেয়ের সম্পর্কে কথা বলতে কেমন জড়তা কাজ করছে উনার। চোখে মুখে তবুও কাঠিন্যতা বজায় রেখে তিনি বললেন,
—“তুমি আসলে চাচ্ছোটা কি? আমার মেয়ের পেছনে পরে আছো কেন?”
—“কারন আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি।”
নিঃসঙ্কোচ কথার জোড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আসরাফ সাহেব। তিনি হকচকালেন, ভড়কালেন, চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তুষারের দিকে চেয়ে অবাক স্বরে বললেন,
—“ভারি নির্লজ্জ ছেলে তো তুমি! নিজের চেয়ে বড় মেয়েকে এসব বলতে লজ্জা করছে না তোমার? ভয় লাগছে না আমার সামনে এসব বলতে?”
তুষারের ভাব-ভঙ্গি অস্বাভাবিক শান্ত। কণ্ঠস্বর ভীষণ শীতল,
—“ভয় পেলে তো আপনার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখতাম না আঙ্কেল।”
সাথে সাথে উত্তর দেওয়ায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন আসরাফ সাহেব। তুষারকে যথেষ্ট ঘাড়ত্যাড়া মনে হচ্ছে উনার। অন্তত তুষারের অভিব্যক্তি তো তা-ই জানান দিচ্ছে। টেবিলে থাকা মিষ্টির প্যাকেটগুলোর দিকে একবার তাকালেন আসরাফ সাহেব। কি ভেবে হাসলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন,
—“আমার সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা তোমার এমনিতেও নেই। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের হতে পারি। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষ। এভাবে বাবার টাকা উড়িয়ে খাই না। আগে নিজ উপার্জ দিয়ে কিছু করো। তারপর যোগ্যতার কথা বলবে।”
আসরাফ সাহেব ভাবলেন, তুষার হয়তো চুপসে যাবে। কিংবা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলবে। তবে তেমন কিছুই ঘটলো না। বরং তুষারকে আগের মতোই স্বাভাবিক দেখালো। গাঢ় স্বরে সে বললো,
—“মিষ্টিগুলো আমার বাবার টাকায় কেনা নয় আঙ্কেল। আমার টিউশনির জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি। নিজের উপার্জনের টাকায়।”
আসরাফ সাহেব একটু থমকালেন। তুষারের মুখপানে গভীর পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাকালেন। ছেলেটা দেখতে, শুনতে খারাপ না। সুদর্শনই বলা চলে। আত্মবিশ্বাসও প্রখর। কিন্তু তাই বলে এমন ছোট ছেলেকে প্রশ্রয় দিতে পারছেন না তিনি। বিষয়টা এখানেই ধামাচাপা দিতে চাইছেন। কোনোরুপ ভণিতা ছাড়া আসরাফ সাহেব বললেন,
—“দেখ ছেলে, আমার মেয়ের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন পর বিয়ে। ভালো হবে তুমি আমার মেয়ের পিছু ছেড়ে দাও। তোমার বয়স কম। আবেগে বশে কি করছ বুঝতে পারছ না। আমার মেয়েকে বিরক্ত করা বন্ধ করো।”
তুষারের মুখশ্রী গাম্ভীর্যে ভরে গেল। নাওয়াজের কথা মনে পরতেই মস্তিষ্ক গরম হয়ে উঠল। আসরাফ সাহেবের চোখে চোখ রাখলো সে। গম্ভীর আওয়াজে ভীষণ ভয়ংকর কথা বলে ফেলল, “হৈমন্তীকা আমার বিয়ে করা বউ আঙ্কেল। উনার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। সুতরাং আপনার কথায় উনাকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব আমার পক্ষে।”
আসরাফ সাহেবের চোখে বিস্ময় স্পষ্ট। বিমূঢ়তায় কুঁচকে গেছে ভ্রু যুগল। কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,
—“কি বলছো বুঝে শুনে বলছো তো? এমন কথা মুখে আনার সাহস কোথা থেকে পেলে তুমি?”
প্রতিউত্তরে তার একরোখা জবাব,
— “বিশ্বাস না হলে হৈমন্তীকাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
আসরাফ সাহেব মিনিট পাঁচেক কিছুই বলতে পারলেন না। থম মেরে রইলেন। কি যেন গভীর মনোযোগে ভাবলেন। চুপচাপ, নিশ্চুপ হয়ে। হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকলেন,
—“হৈমন্তী! এদিকে আয়।”
হৈমন্তী হন্তদন্ত পায়ে উপস্থিত হলো। এক পলক ভীতু নয়নে তুষারের দিকে তাকিয়ে আবারও নতজানু হলো।
আসরাফ সাহেব আক্রোশে ফেটে উঠলেন। ক্রোধে জড়জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
—“এই ছেলে কি বলছে হৈমন্তী? তুই বিয়ে করেছিস ওকে?”
হৈমন্তীর আত্মা কেঁপে উঠল যেন। পা অসাড় হতে শুরু করল। জবাবে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই বলতে পারলো না সে। আসরাফ সাহেব আরও তেঁতে উঠলেন। প্রচন্ড ঝংকার তুলে ধমক দিয়ে বললেন,
—“তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি হৈমন্তী? কথা বলছিস না কেন?”
হৈমন্তী ফুঁফিয়ে উঠল এবার। কণ্ঠ গলিয়ে একটা টু শব্দও বের করতে পারলো না। আসরাফ সাহেব পীড়াদায়ক এক দম ছাড়লেন। উঁচু কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ-ই মিলিয়ে গিয়ে একদম শান্ত শোনালো,
—“এমনটা কিভাবে করলি হৈমন্তী? বাবা মায়ের কথা একটুও ভাবলি না?”
হৈমন্তীর ফুঁফানোর শব্দ বাড়লো। চোখে যেন কেউ মরিচ ডলে দিয়েছে। খুব জ্বলছে। কাঁপা স্বরে হৈমন্তী বলতে চাইল, “বাবা আমি–!”
আসরাফ সাহেব থামিয়ে দিলেন ওকে। রাগ না দেখিয়ে ম্লান স্বরে বললেন,
—“আমার বাসা থেকে বেড়িয়ে যা হৈমন্তী। এখানে তোর আর জায়গা হবে না।”
হৈমন্তী অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো। দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো অবিরাম নোনাজল। সে ডাকলো, “বাবা।”
আসরাফ সাহেব শুনলেন না। হেঁটে চলে গেলেন রুমে। যাওয়ার আগে রাবেয়াকে বললেন,
—“তোমার মেয়েকে যেন আমি আমার বাসায় আর না দেখি রাবেয়া।”
_____
কাজী অফিসে তেমন ভীড় নেই। সাধারণ কর্মরত কিছু সহকর্মীদের আনাগোনা ছোট্ট অফিসটায়। এক কি দু’জন বিয়ে করতে এসেছে। হৈমন্তী আর তুষার এক কোণের ক্ষীণ ভাঙ্গাচোরা চেয়ারে বসে আছে। হৈমন্তীর আঙুলগুলো তুষারের আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে স্থির হয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। তার দৃষ্টি কালসিটে মেঝের পানে। হঠাৎ একটা ছেলে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। হৈমন্তীর উদ্দেশ্যে ঠোঁট ভরে বিস্তর হাসলো,
—“আসসালামু আলাইকুম ভাবী। আমি রওনক। তুষারের বন্ধু। কেমন আছেন?”
হৈমন্তী জবাব দেয় না। মাথা তুলে প্রাণহীন হাসে মাত্র। রওনকও কথা বাড়ায় না। তুষারকে বলে,
—“তোদের পালা এসেছে। কাজী ডাকছে। আয়।”
তুষার চোখে ইশারায় কি যেন বললো। ঠিক বোধগম্য হলো না হৈমন্তীর।
কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। হৈমন্তী ক্লান্ত চোখে একবার আশপাশটা দেখল। তুষারের কিছু বন্ধু-বান্ধব সাক্ষী দিতে দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের পাশটায়। হৈ-হুল্লোড় করছে। মৃদু চেঁচামেচির শব্দে মেতে উঠছে কাজী অসিফ। অথচ হৈমন্তী নির্বিকার হয়ে বসে আছে। আজ তার বিয়ে। কিন্তু তার বাবাটাই যে ডান পাশটায় দাঁড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করতে এখানে নেই। হৈমন্তীর মনে হচ্ছে, তার ভেতরটা নিদারুণ কষ্টে জ্বলছে, পুড়ে যাচ্ছে। অথচ সেটা অনুভব করতে পারছে না সে। মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে, হৈমন্তীর কষ্ট হচ্ছে, কান্না আসছে। কিন্তু কোথায়? সে তো ভাবশূণ্য হয়ে বসে আছে। কান্না আসছে না একদমই। জোড় করেও না। তবে?
কাজীর ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার। কাজী তাকে বারবার কবুল বলতে বলছেন। সবার উৎসুক দৃষ্টি তার দিকেই। হৈমন্তী পিটপিট নয়নে পাশে তাকালো। গভীর চোখের চাহনিতে আটকে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তুষার গাঢ় স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“কবুল বলবেন না হৈমন্তীকা?”
জবাবে আর সময় নিলো না হৈমন্তী। কাঁপা গলায় থেকে থেকে বললো,
—“কবুল, কবুল, কবুল।”
এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কাজী তুষারকে কবুল বলতে বললেই তুষার এক নিশ্বাসে তিনবার কবুল বলে ফেলল। মুহুর্তেই একদফা হাসাহাসি চললো সবার মাঝে। শুধু হাসলো না হৈমন্তীই। তুষার ব্যাপারটা খেয়াল করেও কিছু বললো না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাইকের কাছাকাছি এলো।
আকস্মিক হৈমন্তীর কোমড় জড়িয়ে তাকে উঁচু করে ধরল তুষার। মাটি থেকে পা দু’এক ইঞ্চি উপরে উঠে গেল হৈমন্তীর। চমকে গিয়ে তুষারের কাঁধের শার্টটুকু খামচে ধরল সে। তুষার বাইকে বসিয়ে দিলো তাকে। হুট করে অধরে অধর ছুঁয়ালো অতি অধৈর্য ভঙ্গিতে। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অনুরোধের সুরে বললো,
—“আপনি কাঁদুন হৈমন্তীকা। আমি অভিযোগ করবো না।”
চলবে,…