বারান্দার কোণায় পাতা দুটো কাঠের চেয়ার। একটিতে বসে আছেন কোহিনূর। অন্যটিতে জাওয়াদ।
একজন পরিচারিকা ধীরে ধীরে এসে সামনের ছোট টেবিলে রাখল একটা কাঁচা মাটির পাত্র। তার মধ্যে জমাট বাঁধা শীতল দধি, যার উপরিতলে ঝিকিমিকি জলবিন্দু খেলা করছে। এই দধি কোহিনূরের প্রাণপ্রিয়। প্রতিদিন সূর্য আবির্ভাবের সমকালে খালি পেটে এই দধি খাওয়ার বদ্ধমূল অভ্যাস তার। শারীরিক কারণে নয় বরং মনের শান্তির জন্য।
তিনি একটা চামচ তুলে নিলেন। ঠোঁটে ছোঁয়াতেই চোখ আপনা থেকেই একটু বুজে এলো। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জাওয়াদ তখনো নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। কোহিনূর চামচটা পাত্রে রেখে কথা শুরু করলেন।
‘আমি তোকে এসব বিষয় চিঠির মাধ্যমেই জানাতাম।’ বলে থেমে গেলেন। জাওয়াদ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।
কোহিনূর বললেন, ‘একজন নারীর জীবন স্বামীর আঙিনায় পা না রাখা পর্যন্ত অসম্পূর্ণতার কারাগারে বন্দি থাকে। সংসার হলো তার পূর্ণতার আকাশ, আর জীবনসঙ্গী তার শিকর। একজন নারীকে হাজার রত্নালঙ্কারে সাজাও, অফুরন্ত মুক্তির আকাশ দাও, সেই শিকড় ছাড়া সে শুধু ঝড়ের হাতে ভাসা পাতার মতো দিশেহারা।’
জাওয়াদের দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে এলো।
কোহিনূরের কণ্ঠস্বর মৃদুতায় ভিজে উঠল, ‘তুই গুলনূরের দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়েছিলি, বিশ্বাস করেছিলি। আমি আমার অন্তদৃষ্টি দিয়ে ওর ভালোর পথ খুঁজেছি। সেই পথেই ওর ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছি। আমি ওর বিয়ে ঠিক করেছি। শুক্রবার বিয়ে৷ পাত্র ভালো… আমার চোখের সামনে বড় হয়েছে। চরিত্রে অটল, কাজে নিষ্ঠাবান।’
জাওয়াদের চোখদুটি যেন হঠাৎ দাবানলে জ্বলে উঠল। পাল্টে গেল মুহূর্তে। চেয়ারে খাড়া হয়ে বসল। কণ্ঠে যেন মরুভূমির তপ্ত বালিঝড়, ‘গুলনূর কি বিয়েতে রাজি?’
প্রশ্নটি উচ্চারিত হতে না হতেই তার গলা বেসুরো কম্পনে ফেটে পড়ল। সে আর এক নিমেষও স্থির থাকতে পারল না।
ঘুরে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।
‘জাওয়াদ! দাঁড়া! আমার কথা এখনো শেষ হয়নি!’ কোহিনূর উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলেন। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না। দরজা খোলার শব্দ, তারপর নিস্তব্ধতা।
কোহিনূরের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন ভরা দইয়ের পাত্রটার দিকে তাকিয়ে।
জাওয়াদের পায়ের বুটের ভারী শব্দে প্রতিটি দাসীর কাঁধ থেমে যায়, আঙুলের মুঠো থেকে খসে পড়ে পিঁয়াজ কাটা ছুরি, জ্বলে ওঠা চুলায় ফুটন্ত হাঁড়ি দুলে ওঠে। রান্নাঘরের দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়েই সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরো রান্নাঘরটাকে দেখে নেয়।
গুলনূর তখন পাতিলে মশলা দিচ্ছিল মনোযোগ দিয়ে। তার অবাক চোখে আশ্চর্যের ঢেউ খেলতে শুরু করে যখন জাওয়াদ হঠাৎ করেই তার বাহু জাপটে ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আনে। ধরা পড়া পাখির মতো সে থমকে যায়, চোখে অপ্রস্তুত জিজ্ঞাসা।
‘তুমি জানো তোমার যে বিয়ে?’ তার কণ্ঠস্বর রুক্ষ নয়, তবে অস্থিরতায় টলমল করছে।
দাসীরা সবাই স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। কারও লাউয়ে হাত, কারও তক্তায় ছুরি, কেউ নড়ছে না। শুধু গুলনূরের চোখে বিস্ময়ের জলরেখা, আর জাওয়াদের গলায় দাবানল, ‘তোমার অনুমতি নেয়া হয়েছে?’
তার গলা কিছুটা কাঁপে, ‘তুমি বিয়েতে রাজি?’
গুলনূর আড়চোখে দাসীদের দেখল এক পলক।
জাওয়াদ গুলনূরের বাহু ঝাঁকিয়ে উচ্চস্বরে বলল, ‘উত্তর দাও। তুমি রাজি?’
গুলনূর থেমে থেমে মাথা ঝাঁকায়। সে রাজি…
জাওয়াদ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় যেন থেমে যায় তার চারপাশে। বুকের ভিতরে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে চেনা সুখের সব টুকরো। মনে হচ্ছে, কেউ যেন নিঃশব্দে তার হৃদয়ে ছুরি বসিয়েছে৷ একটি নয়, প্রতিবার নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ঢুকে পড়ছে নতুন করে।
এই মেয়েটা…এই তো সেই গুলনূর, যার উপস্থিতি একদিন তার নির্জন ঘর আলো করে তুলেছিল। যার হাতের রান্নায় মুগ্ধ হয়ে বাসার ফিরত ভাতের গন্ধে, যার ঠোঁটের নিঃশ্বাসে বসন্ত আসত বারান্দায়, যে অসুখে মাথায় হাত রাখত, আর চোখে রাখত নিঃশর্ত মমতা। সে এখন অন্য কারো ঘর সাজাবে? অন্য কারো অপেক্ষায় জানালার দিকে তাকিয়ে থাকবে? তার জন্য নয়, অন্য কারো জন্য?
না।
এমন কল্পনাও তার সহ্য হয় না। তার মনের ক্যানভাসে যেই ছবি আঁকা হয়েছে যত্ন করে, সেই ছবি কেউ আচমকা অ্যাসিড ঢেলে ঝলসে দিতে পারে না। তাই আরও একবার, আরও জোরে, আরও স্থির হয়ে সে বলল, ‘তুমি রাজি না। এ সম্মতি তোমার নয়। এটা আদায় করা হয়েছে।’
গুলনূর এবার ঠোঁট কাঁপিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। বোবা কণ্ঠে হাত নেড়ে বোঝাতে চায় কিছু। কিন্তু জাওয়াদ শোনে না। শুনতে চায় না। সে শুধু চায় একটা কথা শুনতে, ‘না, আমি চাইনি। আমাকে বাধ্য করা হয়েছে। আমি শুধু আপনাকেই চেয়েছি।’
এই বাক্যই তার মুক্তি। এই বাক্যই তার অবলম্বন। এই কয়দিন তার সমস্ত অস্তিত্বের জুড়ে ছিল গুলনূর। বালিশে, আয়নায়, চায়ের কাপের পাশে, জানালার ফাঁকে, প্রতিটি ফাঁকে ছিল গুলনূরের অনুপস্থিতি। ঘুম ভেঙে সে পাশের ঘরে গিয়েছে গুলনূরের খোঁজে, কিন্তু সেখানে ছিল শুধু শূন্যতা। সকাল হয়েছে, কিন্তু তার জীবনে আলো আসেনি।
সে এমন একটা গাছ, যে গাছে কেবল একটিমাত্র গোলাপ ফুটেছে। আর এখন কেউ সেই গোলাপটা ছিঁড়ে নিতে চাইছে।
সে পাগলের মতো বলতে থাকে, ‘তুমি রাজি না। বলো, তোমাকে বাধ্য করা হয়েছে। কাউকে না জেনে তুমি কিভাবে বিয়ে করতে পারো? আমার অনুমতি নিয়েছ?’
গুলনূর আবার বোঝানোর চেষ্টা করে সে নিজেই সম্মতি দিয়েছে। তার চোখে দ্বিধাহীন সত্য, তবুও সেই সত্য জাওয়াদের হৃদয়ে পৌছায় না।
জাওয়াদ ধারালো দৃষ্টি নিয়ে তাকাল রান্নাঘরের দাসীদের দিকে। ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে চোখ নত করে ফেলল।
জাওয়াদ গুলনূরের হাতের কবজি চেপে ধরে নিয়ে যায় দ্বিতীয় তলার বারান্দায়। উদাসীন হাওয়া বইছে সেখানে। মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে দূরের আকাশে। জাওয়াদ গুলনূরকে নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার একটাই দাবি, গুলনূর স্বীকার করুক, সে রাজি নয়। তাকে জোর করা হয়েছে। সে এই বিয়ে ভেঙে দিতে চায়।
যতক্ষণ স্বীকার না করবে ততক্ষণ সে এখানেই থাকবে। গুলনূরকেও কোথাও যেতে দিবে না।
বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। বাড়ির এক কোণে এক পাগল প্রেমিক বসে আছে তার বোবা ভালোবাসার সামনে। আর ভালোবাসা… সে তো নিশ্চুপ।
কোহিনূর জাওয়াদের এই জেদের খবর শুনে ভীষণ অসহায়বোধ করেন। জাওয়াদ প্রেমে পড়েছে, খুব গভীরভাবে। সেদিনের কথাবার্তায় আশা করেছিলেন, হয়তো জমিদারি রক্তের টান তাকে ফিরিয়ে আনবে, দায়িত্বের বোধে সে বাঁধা পড়বে। কিন্তু না, তার হৃদয় তো গুলনূরের নামে লেখা হয়ে গেছে। তার অঙ্গভঙ্গি, চোখের ভাষা সব ঘোষণা করছে, সে কাউকে তার ভাগ্যলিপি নির্ধারণের অধিকার দেবে না। নিজেই নিজের ভাগ্য লেখার কলম হাতে তুলে নিয়েছে।
চিরকালই জাওয়াদ এমনই ছিল। তাদের বংশধারার সর্বাধিক বিপ্লবী, অগ্নিস্বভাব, আবেগতাড়িত সিদ্ধান্তগ্রাহী তরুণ। ঠাণ্ডা মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যখন যে আবেগ প্রাণে জাগে তাই। তার হৃদয়ের আগুনে এখন বংশের মর্যাদা, সামাজিক অবস্থান সব গলে যাচ্ছে। অবশ্য সে কখনোই মর্যাদা বা সামাজিক অবস্থান নিয়ে ভাবেনি। ‘একে আমি কী করে বাবার যোগ্য উত্তরাধিকারী করে তুলব!’
দুশ্চিন্তায় কোহিনূর দুই হাতে কপাল চেপে ধরলেন।
জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। জাওয়াদ এখন পাগলা ঘোড়ার মতো, তাকে জোর করে থামানো যাবে না। ওকে বুঝতে হবে ওর নিজের ছন্দে, ওর ভাষায়। দরকার হলে ওর রাগ, জেদ সবকিছুর মুখোমুখি হতে হবে
এখন সময়কেই নিজের মতো করে কথা বলতে দিতে হবে। এই সংঘাত, এই জেদ কোথায় গিয়ে থামে তিনি শুধু দেখবেন একজন নীরব দর্শকের মতো। তারপরই সিদ্ধান্ত নেবেন, কী করা উচিত, কোনটা ভালো হবে জাওয়াদের জন্য, এই জমিদারির জন্য, এই বংশের সম্মানের জন্য। সবশেষে, একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এক চামচ দই তুলে নিলেন মুখে।
জাওয়াদের ফিরে আসার সংবাদ কানে যেতেই কেবল ঘুম থেকে জেগে উঠা ললিতার শিরা উপশিরায় রক্ত হিম-কণার মতো জমাট বাঁধল। চুল আঁচড়ানোর কোনো তোয়াক্কা না করেই, আঁচলের আস্তিত্ব সম্পর্কে বেখেয়াল থেকে, তিনি দৌড়ে গেলেন বারান্দার দিকে। কিন্তু কাছাকাছি আসতেই তার পা থমকে দাঁড়াল।
সেই অবিরাম যন্ত্রণা, সেই পুড়িয়ে দেওয়া সন্দেহ, তান্ত্রিকের উচ্চারিত বাক্যগুচ্ছ এখনও তার বুকের মাঝখানে নিভু নিভু আগুনের মতো ধিকি ধিকি জ্বলছে। কী হবে যদি জাওয়াদ সমস্ত সত্য জেনে ফেলে? নাকি জেনে গেছে?
যদি চোখে চোখ রেখে হঠাৎ বলে ওঠে , ‘তুমি আমার মা নও, তুমি কেবল একজন প্রতারক মহিলা!’
কী করে সহ্য করবেন?
এই আতঙ্ক… এই দোলায়মান অনিশ্চয়তা তাকে অদৃশ্য করে ফেলে। দেয়ালের ওপাশে লুকিয়ে পড়েন তিনি, মৌনতার শিকল পরে, নিষ্প্রভ চাহনিতে। মাতৃত্ব আর অপরাধবোধের দোলাচলে দুলতে থাকেন। তার দৃষ্টি না সামনে তাকাতে পারে, না বিমুখ হতে সাহস পায়।
পুত্রের প্রতি তার মমতার টান, তার বিগলিত প্রার্থনা সবই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শুধু একটি আশার সুতো আঁকড়ে ধরে আছেন, তিনি যাই হোন না কেন, মা তো ছিলেন, আছেন, থাকবেন চিরকাল। পুত্রকে জন্ম দিয়েছেন তিনি, বুকের দুধে লালন করেছেন। তার মাতৃত্ব কখনোই মিথ্যে হতে পারে না।
তবুও… ঘৃণার সেই সম্ভাব্য তীরবিদ্ধ চাহনি তাকে অন্তরে অন্তরে ছিন্নভিন্ন করে। যদিও নিশ্চিত নয়, কিন্তু যে ভীতি, যে তীব্র শঙ্কা, যে অবিরাম সন্দেহ বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে বসেছে, সেই শিলীভূত অনুভূতি বারবার কল্পনার আয়নায় ফুটিয়ে তোলে, তার পুত্র গর্জন করে বলছে, ‘তুমি বিশ্বাসঘাতিনী মা!’
এই প্রতিধ্বনি শোনার সাহস নেই ললিতার। তিনি আড়াল থেকে ছেলেকে দেখেন। লম্বা দেহ, পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে মাথা নুইয়ে বসে আছে গুলনূর। জাওয়াদের দৃষ্টি গুলনূরের দিকে। সে শুধু শুনতে চায়, গুলনূর বিয়েতে রাজি না।
স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সেই দুপুরবেলার ছবি, বহু বছর পূর্বে, জাওয়াদের বয়স তখন নয় কি দশ। তখন সে ছিল ছোট্ট, গালদুটো ফুলে ওঠা, চোখে দুষ্টু চমক। একদিন ললিতার জন্মতিথির সকালে হঠাৎ জেদ ধরল, ‘আমি মাকে নিজের হাতে বেলি ফুলের মালা বানিয়ে উপহার দেব। এটা অন্য কেউ ছুঁতে পারবে না!’
মালীরা মুচকি হাসে। দাসীরা বোঝাতে চায়, ‘আঙ্গুলে সূচ ফুটবে।’
কিন্তু সে একবার আবদারে অনড় হলে তা কোনো যুক্তিতর্কের কাছে নতিস্বীকার করে না।
ছোট্ট হাতে সূচ নিয়ে বসল। ফুল বাছল খুব যত্ন করে। একটি একটি করে গাঁথতে গিয়ে আঙুলে সূচ বিদ্ধ হলো। রক্তকণা ঝরে পড়ল বিন্দু বিন্দু। তবুও অবিচল রইল সে। মায়ের পছন্দের ফুলের মালা সে বানাবেই। চোখে জল নিয়ে শুধু একটাই কথা বলে গেল, ‘মাকে দেব, নিজে বানিয়ে দেব।’
সেই মালাটা যখন মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল, ললিতার মনে হয়েছিল, জীবনে আর কিছু না পেলেও চলবে।
আজ সেই পুত্র…তার চোখে আর নেই সেই কোমলতা। আজ সে মাকে নয়, অন্য এক রমণীকে হৃদয় সমর্পণ করে নিজের সমগ্র অস্তিত্ব বিসর্জন দিতে উন্মুখ। ললিতার চোখ দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। দুটি অশ্রুবিন্দু নীরবে গড়িয়ে পড়ে গালে।
আড়ালে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু ভাবেন, ছেলেটা কি আবার একদিন সেই বেলি ফুলের মালা হাতে ফিরে আসবে?
সেই মালা দিয়ে বলবে, ‘মা, এই নাও বেলি ফুলের মালা। কাউকে কিন্তু দিও না।’
তিনি কাউকে দেননি। যতবার পুত্র বেলি ফুলের মালা এনেছে, ততবারই বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছেন। শুকিয়ে যাওয়া বেলিগুলি এখনো সিন্দুকে স্নেহ-যতনে সোনার মতো আগলে রাখা।
দুপুরের আলস্য গড়িয়ে যখন বিকেলের বিষণ্ণ আলো উঠোনের মেঝেতে ঝরে পড়ছিল, জাওয়াদ তখনো তার জেদের আগুনে পুড়ছিল। গুলনূর বসে আছে স্থির পাথরের মতো, তার মধ্যে নেই কোনো প্রতিরোধ। সত্যকে সে তো আর অস্বীকার করতে পারে না। দিনভর দুজন পানি তো দূরের কথা, একফোঁটা জলও স্পর্শ করেনি। এমনকি রান্নাঘরের উনুনও ঠান্ডা হয়ে গেছে।
সুফিয়ান বিষয়টা জেনে আক্রোশে থরথর কেঁপে উঠেছিলেন, শুধু কোহিনূরের কথায় নিজেকে সংযত করেন। একটি শব্দও উচ্চারণ না করে মনিরকে সঙ্গে নিয়ে কোনো তাগিদপূর্ণ কাজে বেরিয়ে গেলেন।
অপরদিকে, জাওয়াদের প্রচণ্ড মনস্তাপের আতঙ্কে উপরতলায় কোনো দাসীই আসতে সাহস পাচ্ছে না। সকল কর্মকাণ্ড স্থবির। ললিতার আদেশে বিকেলে ভয়ে ভয়ে সিদ্দিক খাবারের থালা নিয়ে উপরে উঠে এলো।
সেই মুহূর্তেও জাওয়াদ ধমকের সুরে গুলনূরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, ‘তুমি স্বীকার করবে, নাকি চুপ থাকবে?’
গুলনূরের গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা ঝরছে। এই দৃশ্য জাওয়াদের হৃদয়ে বেদনার ছুরিকাঘাত করলেও সে পিছু হটছে না। গুলনূর যদি কোনো প্রতিবাদ না করে, তবে সে কীভাবে সুফিয়ান বা কোহিনূরের বিপক্ষে দাঁড়াবে?
সিদ্দিক সিঁড়ির নিকট দাঁড়িয়ে থাকে, এগোতে সাহস পায় না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে মাথা নত করে মৃদুস্বরে বলল, ‘হুজুর্’
জাওয়াদ তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। সেই চাহনি ছুরিকার মতো তীক্ষ্ণ কিন্তু বরফের মতো শীতল। সে প্রথমেই প্রশ্ন করল, ‘গুলনূরের বিয়েটা কার সাথে পাকাপাকি হয়েছে?’
সিদ্দিক কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আসাদ…’
‘ও এখন কোথায়?’
‘বাজারে যায়, হুজুর।’
জাওয়াদ বারান্দা থেকে ঝুঁকে দেখল, সত্যিই আসাদ একটা ব্যাগ হাতে বাজারের পথে হেঁটে যাচ্ছে। সে আর বিলম্ব করল না। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। আসাদ তখন দৃষ্টিপথের বাইরে। জাওয়াদ পিছিয়ে না থেকে বেরিয়ে পড়ল। তখন ঝোড়ো বাতাস বইছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝড় নেমে আসবে।
বাজারে আজ হাটবার। কোলাহল, চিৎকার-চেঁচামেচি, ঝড়ের আভাস পেয়ে সবাই তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছাচ্ছে। জনসমুদ্র ঠেলে সে আসাদকে খুঁজতে লাগল। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে তার নজর আটকে গেল দুই অপরিচিত অথচ চেনা চেহারায়।
রাজ্জাক এবং অরিজিত। নাম জানা নেই, তবে চেহারা স্মৃতিপটে খোদাই করে রাখা। রাজধানীর সেই দুর্ঘটনার পর যখন সে চেতনাহীন ছিল, সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে হাসপাতালে প্রথম এদেরই দেখতে পেয়েছিল।
এই দুজন এখানে কেন? তারা কি তাকে অনুসরণ করছে? সন্দেহ কুহেলিকার মতো ঘনীভূত হতে লাগল। দেহের ভেতর দিয়ে একটা হিমেল শলাকা যেন ভেদ করে গেল।
নিঃশব্দে সে তাদের পেছন নেয়। অনুসরণ করতে করতে চাঁদেরকুটি নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে এসে পৌঁছল। সন্ধ্যার ম্লান আলোর সঙ্গে হঠাৎ ঝড় নামল, হাওয়ায় গাছ দুলছে, আকাশে মেঘের গর্জন।
পথের পাশে, একটি পুরনো পথঘাটের ধারে, আধা-বদ্ধ বাড়িতে আশ্রয় নেয় সবাই। সেখানে আছে রাজ্জাক, অরিজিত এবং আরও কয়েকজন। জাওয়াদ নিজেকে আড়ালে রেখে রাজ্জাক ও অরিজিতকে লক্ষ্য করতে লাগল।
—
নোট: নবোঢ়ায় নির্দিষ্ট নায়ক-নায়িকা নেই। নবোঢ়ার নায়ক-নায়িকা হচ্ছে এর গল্প৷ যেহেতু এই গল্পে অনেক প্রধান চরিত্র তাই সব চরিত্র প্রতি পর্বে থাকবে না।