স্মরণের ভয় হচ্ছে শীতল আর ওই মেয়েটাকে। এরা করছে–টা কি? এই বাসায় তার থাকা হবে না ভেবেও মাথা ঘুরে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক বলছে ভিন্ন কথা আর মন সাফাই গাইছে শীতলের জন্য। দুই মনোভাবের টানাপোড়নে এবার স্মরণ শীতলকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল,“ মেয়েটা কে? আর কখন এলো? কেন এলো সেটাও বলো!’’
একসাথে তিনটে প্রশ্ন। শীতল হতবিহ্বল হলো না। বিলম্বব্যতীত প্রত্যুত্তর করলো,“ ও বীথি। ভোর ছয়টার দিকে এসেছে এখানে। কারণ আজকে ওর বিয়ে।’’
থতমত খেয়ে গেলো স্মরণ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে নিজেই গালি দিলো একটা। আজ মেয়েটার বিয়ে আর সে স্মরণের বাসায় এসে ঘুমাচ্ছে! এমনও কি হয় নাকি?
শীতল স্মরণের মুখে এক্সপ্রেশন দেখে মনোভাব কিছুটা হলেও আন্দাজ করলো। বীথির দিকে তাকিয়ে থেকেই পুনরায় বলা আরম্ভ করলো,“আসলে, বীথি অভ্র ভাইকে ভালোবাসে। বিয়েতে ওর মত নেই। তাই বীথির মা ওকে একপ্রকার বাড়িতেই বন্দি করে রেখেছিলো মাস কয়েক যাবৎ। আজ ওকে পালাতে সাহায্য করেছে ওর বড় চাচী।’’
বলেই কিছুটা ব্যথিত দেখা গেলো শীতলকে। তারপর কিছু একটা মনে করেই বলে উঠলো,“তোমাকে তো প্রায় সবকিছুই বলে দিলাম। তুমি আবার কাউকে বলতে যেও না।’’
স্মরণ তখন ভাবছিলো এই ‘অভ্র’টা কে? আর এই বীথিটাই বা কে? শীতলের পরের কথাটা শুনে রাগ লাগলেও নিজেকে শান্ত রাখলো। মুখ ধোয়ার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যত যাই বলুক শীতল এদেরকে তার অনেক বেশি সন্দেহ হচ্ছে। বন্ধুদের বলতে হবে এই বাসায় সে বেশিদিন থাকতে পারবে না। আবার এই বাসা ছাড়লে যাবেও বা কোথায়? স্মরণ চলন থামালো। মাথার চুল ধরে টানলো একবার। তারপর ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে গেলো।
অভ্র বীথিকে কিছুদিনের জন্য স্মরণদের ফ্লাটে রাখার জন্য অনুরোধ করেছে শীতলকে। শীতল না করতে পারে নি। মেয়েটা তাদেরই সমবয়সী। তবে কোনো ঝামেলা হলে মাঝখান থেকে আবার স্মরণ ফেঁসে যাবে এই নিয়েও চিন্তায় ছিলো। অবশ্য অভ্রই চিন্তা করতে নিষেধ করেছে। বাহারাজ দেখবে সব। এদিকে শীতল স্মরণকে তো আর বলতে পারবে না বীথি কে? বীথি যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাসনা আমানের মেয়ে আর সাবেক এমপির নাতি জানলে পরে না আবার বের করে দেয় বীথিকে। কে চাইবে এমন বড়লোকী কারবারে নিজেকে জড়াতে। পরে না আবার তাকেই কেইসে ফেঁসে যেতে হয়! তারওপর আবার যদি বাহারাজের বোন এটা জানলে তো আরও বেশি…। আর ভাবতে পারলো না শীতল। এই ভয়ে পরিচয় গোপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে শীতল। ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো শীতল। নিজেদের বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছে। তবে শীতলের মা শান্তা বেগম অনেক বকাঝকা করবেন। তারওপর নোমান সাহেবই বলেছেন স্মরণের রুমে কিছুদিন থাকার জন্য বীথিকে। তাই শীতলও আর না করতে পারে নি। এদিকে স্মরণের থেকে অনুমতি না নিয়ে স্মরণের রুমে আনতেও কেমন যেন লাগছিলো তবে স্মরণের প্রতি বিশ্বাস ছিলো।
___________________
স্মরণ ললিপপ খাচ্ছে। ললিপপ মুখে রাখাতে বাম দিকের গালটা ফুলে আছে। দেখতে ভীষণ কিউট লাগছে। সকালে শীতল বীথিকে নিয়ে নিজের বাসায় গেছে। স্মরণ বাসায় গেলে তারপর আবারও স্মরণের বাসায় যাবে। স্মরণ থাকতে বলেছিলো। তার রুমে কিছু নেই চুরি হওয়ার মতো। আর স্মরণের এমন মনোভাবও নেই। মেয়েটাকে দেখলে বোঝা যায় যথেষ্ট ভালো ফ্যামিলির।
“ কি ভাবছিস? আমাদেরও বল। আমরাও বসে বসে ভাবি।’’
তুষারের কথায় স্মরণ ললিপপটা মুখ থেকে বের করলো আর বললো,“ তেমন কিছু না। ভাবছি কিভাবে তোর মাথার চুল ছিড়ে দেবো?’’
তুষার স্মরণের পাশেই বসে ছিলো। ভুলবশত স্মরণের পায়ে পা লেগে গিয়েছিলো এতে করে স্মরণের পায়ে বালি লেগেছে। ভেজা বালি হওয়ায় স্মরণের রাগ উঠেছে। তুষার স্মরণের কথায় চুপসে গেলো। উঠে দাঁটালো কারণ স্মরণের ওপর বিশ্বাস নেই। মেয়েটা যেকোনো মুহুর্তে মারতে পারে। নয়ন দূরে গিয়ে ফোনে কথা বলছিল। নিশ্চয় শীতলের সাথে কথা বলছে। নকিব নয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে হতাশা-মিশ্রিত কণ্ঠে বন্ধুদের বললো,“জীবনে এমন একটা শীতল বড়ই অভাব।’’
তুষারও তাল মেলালো,“ সেইম ব্রো।’’
জিনিয়া বলে উঠলো,“ এই তুষার তোর নাম প্রেমিকা আছে? গতকাল স্টোরি দিলি!’’
“ ওটা ক্রাশকে জেলাস ফিল করানোর জন্য দিয়েছি।’’
হেসে উঠলো বাকিরা। স্মরণ হাসতে হাসতে বললো,“ শুধু কি জেলাসি ফিল করালেই হবে? পটাতেও হবে বন্ধু।’’
স্মরণের এমন উপদেশে তুষার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলো। একে একে সিমানীও বলে উঠলো,“ হ্যা তাইতো। তোর উচিত মেয়েটাকে পটিয়ে ফেলা। তুই হ্যান্ডসাম কম কিসে?’’
তুষার মুখে হাসি চেপে রাখতে পারছে না। লজ্জামিশ্রিত একটা হাসি দিয়েই ফেললো। তার এমন মুখের এক্সপ্রেশনে বাকিরা আবারও হো হো করে হেসে উঠলো। এমন সময় তাদের ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষিকা মিস. নোভা সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। স্মরণদের গাছের নিচে বসে থাকতে আর হাসতে দেখে বলে উঠলেন,“ তোমাদের ক্লাস নেই? এখানে এভাবে বসে আছো কেন?’’
নকিব নোভা ম্যামের বিরাট ফ্যান। একপ্রকার ক্রাশ বললে ভুল নয়। তাইতো উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা একটা সালাম দিয়ে দুখী দুখী ভাব করে বলে বললো,“ ক্লাস তো আছে ম্যাম, তবে ক্লাস করার মন নেই আমাদের। কিন্তু ক্লাসের টিচারটা যদি আপনি হতেন তবে মন নয় শুধু; আমার ফুসফুস, শ্বাসক্রিয়াও ক্লাস করার জন্য তৎপর হতো।’’
তার এমন কথায় বাকিরা মুখ টিপে হাসছে। এদিকে নোভা ম্যাম নকিবকে ‘বেয়াদব’ বলে চলে গেলেন। নকিব বুকে হাত দিয়ে ধীর স্বরেই বলে উঠলো,“সামনের জন যদি আপনি হোন, আমি বেয়াদবের চাইতেও বেয়াদব হতে রাজি।’’
স্মরণের নকিবের হাতে কিল মেরে বললো,“ তুই ম্যামের পিছু নেওয়া বাদ দে। এগুলো শোভা পায় না। তার ওপর ম্যাম তোর থেকে বয়সে বড়।’’
“ তুই চুপ থাক। আমি তো কুত্তার মতো পিছু লেগেই থাকবো।’’
“ হ্যা তুই তো কুত্তাই।’’
নকিব মাইন্ড করলো না। বরং মনে মনে খুশি হলো যেন। স্মরণ ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকালো। বাবা-মাকে একসঙ্গে মিস করছে। তাদের পরিবারটা কত সুন্দর একটি পরিবার হতো। যদি স্মরণের মা বেঁচে থাকতেন। দীর্ঘশ্বাসগুলো আজকাল শুধু বের হতে চায়। হতাশা আর নিঃসঙ্গতা যেন স্মরণের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবুও বন্ধুদের সাথে থাকলে এই নিঃসঙ্গতা কিছুটা কমে আসে। এরা যদি না থাকতো তবে হয়তো স্মরণ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতো সেই কবেই।
____________________
শীতের সন্ধ্যা। শীতকালে বেলা হারিয়ে যায় খুব দ্রুত। বিকেল পাঁচটা বাজলেই অন্ধকার নেমে আসে। তারওপর শৈত্যপ্রবাহ চলছে। সারাদিনই মেঘলা ছিলো। আর বিকেল হতেই অন্ধকার যেন একদম জেঁকে বসেছে। টিউশনিগুলো পড়িয়ে বাজার করতে গিয়েছিলো স্মরণ। বাসায় নতুন একজন সদস্য এসেছে। কমবেশি ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াতে পারলেও অনেক। সত্যিই বিপদে পড়েছে হয়তো। নয়তো একদম এতো সকালে কেউ বাড়ি থেকে পালায় নাকি?
স্মরণ বাসে উঠলো। বসার একটা সিট পেলো আর সেখানে গিয়ে বসে পড়লো।আরও মানুষজন উঠতে শুরু করেছে। স্মরণের সিটটা যাত্রী চলাচলের পাশে হওয়ায় স্মরণের হাতে ধাক্কা লাগতে লাগলো মানুষগুলোর। বেশিরভাগই পুরুষ। স্মরণ ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। একেকজনের সাথে ধাক্কা লাগাতে আরেকটু সড়ে বসলো। তবুও কিছু লোক ইচ্ছে করেই যেন ধাক্কা দিচ্ছে স্মরণকে। বাস থেকে নেমে গেলেও আর বাস পাবে কিনা সন্দেহ!
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কেউ এসে তার পাশে থাকা লোকদের ঠেলে সেখানে দাঁড়ালো। স্মরণ মাথা নামিয়ে ছিলো তাই বুঝলো না কে? তবে এটাও কোনো ছেলেই হবে সেটা বুঝলো। একজন লোক হঠাৎ বলে উঠলো,“ এই যে ভাই! ওখানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। এভাবে ঠেলে দেওয়ার মানে কি?’’
“ কারণ আপনি জায়গাটার সঠিক ব্যবহার করতে পারছিলেন না। আর পবিত্র কোনোকিছুর পাশে অবশ্যই অপবিত্রকে মানায় না।’’
লোকটা কোনোকিছুই বুঝতে পারলো না। তবে চোখ রাঙালো ভয়ানক ভাবে। এদিকে স্মরণ সমস্ত কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলো। প্রতিটা কথায় কেমন শ্রুতিমধুর শোনালো তার নিকট। আর কণ্ঠস্বরটা যেন খুবই চেনা। তাই তড়িৎ বেগে মাথা উঁচিয়ে তাকালো। বাহারাজকে দেখে একদমই হতবম্ভ হলো স্মরণ। বাহারাজ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলো। স্মরণ আবারও মাথা নোয়ালো। গাড়ির জানালা দিয়ে তখন ঠান্ডা হাওয়াগুলো দলা পাকিয়ে স্মরণের গা-য়ে এসে ছুয়ে দিচ্ছে। স্মরণ কাঁপলো, কেঁপে উঠলো হৃদস্পন্দনও। সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভুতির জোয়ার বয়ে গেলো। মনে হলো বক্ষস্থলে কোনো উত্তাল ঢেউ তটে এসে থেমে গেছে। বিনা বাধায় বিনা সংকোচে মনের দুয়ার খুলে গেলো আপনা-আপনি।
চলবে,…