সুফিয়ান বিস্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নাভেদ, তুমি এখানে! সারাদিন কোথায় ছিলে?’
তার কণ্ঠ শুনে জুলফার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিহরণে কেঁপে ওঠে। আতঙ্কের শীতল ছায় ঘনীভূত হয় দেহজুড়ে। সে অসহায়ভাবে আরও সরে আসে নাভেদের পিঠের আড়ালে। সুফিয়ানের দৃষ্টি থেকে সেই কৌশল লুকিয়ে রইল না। অচেনা নারীটির উপস্থিতি মনে প্রশ্ন জাগালেও, অভিজাত শিষ্টাচারে তিনি মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। নাভেদের ব্যক্তিগত জীবনের সীমানায় প্রবেশের অধিকার তিনি নিজেকে দেননি।
নাভেদ ততক্ষণে স্বাভাবিকত্ব ফিরে পেয়েছে। কণ্ঠে সাহসের অনুরণন তুলে, ঝড়ের উন্মত্ত গর্জনকে ছাপিয়ে বলল, ‘একটু জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়েছিলাম, চাচাজান। আসুন, এদিকে দাঁড়ান। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে।’
আবহাওয়ার ভয়াবহতায় স্কুলে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো তৎক্ষণাৎ সরে গিয়ে পথ করে দিল। সুফিয়ান ভূঁইয়া ধীরগতিতে এগিয়ে এসে বারান্দার মধ্যবর্তী স্থানে নিশ্চল হয়ে দাঁড়ালেন।
বাইরে তখন প্রকৃতি তার ভীষণতম রূপ ধারণ করেছে। স্কুলের আশপাশের বিশালাকার গাছগুলো উন্মত্তের মতো দুলছে, ভাঙা ডালপালা ছিটকে পড়ছে চারদিকে। আকাশজুড়ে বজ্রের বিকট শব্দ। ভীতিবিহ্বল মানুষগুলো সমবেত হয়ে বারংবার উচ্চারণ করছে – ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা, ইন্নি কুনতু মিনাজ্জোয়ালিমীন।’
ঝড়ের প্রকোপ কিছুটা কমে এলে সুফিয়ান পেছনে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। নিকাব ও বোরকায় আবৃত অপরিচিত নারীটি নত মাথায় দাঁড়িয়ে আছে নাভেদের ঠিক পিছনে। চোখে ক্ষণিকের জন্য প্রশ্নবোধক রেখা ফুটে উঠলেও, মুখে কোনো মন্তব্য করলেন না। কেবল নাভেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন বাড়ি ফিরবে, নাকি কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন আছে?’
নাভেদ ধীরে মাথা নাড়িয়ে জানাল, ‘আপনাকে আগে পৌঁছে দিয়ে তারপর একটু অন্যদিকে যাব।’
‘তার প্রয়োজন নেই। তুমি যে কাজে ব্যস্ত ছিলে, সেটি শেষ করো। আমি মনিরকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে চলে যাব।’
বলেই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। গ্রামের দুজন তরুণ সাথে এগিয়ে গেল। এমন দুর্যোগময় পরিবেশে প্রবীণ জমিদারকে একাকী ছেড়ে দিতে কারও অন্তরাত্মা অনুমতি দিচ্ছিল না।
সুফিয়ান দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করতেই জুলফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। নিম্নস্বরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘খুব ভয় পেয়েছিলাম।’
কথাটি কানে যেতেই নাভেদ কৌতুকভরে বলল, ‘আপনি না ভয় পান না?’
জুলফা কোনো প্রত্যুত্তর দিল না। মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার অন্তরে সেই ঝঞ্ঝাবাত আবার ফিরে আসে, নাভেদ সবকিছু জানে! তার হৃদয়লোকের প্রতিটি কোণ সম্পর্কে জানে! যে চাঁদ পূজনীয় ছিল, তা যেন পৃথিবীতে নেমে এসেছে। যে বিস্ময়বোধ সুফিয়ানকে দেখে আতঙ্কে ম্লান হয়ে গিয়েছিল, এখন সেটি পুনরায় উদিত হয়েছে বুকজুড়ে।
দুজন বন অতিক্রম করে খাসমহলের সুরঙ্গের সামনে চলে আসে। এবার বিদায় নেওয়ার মুহূর্ত। জুলফা নিকাব তুলে নাভেদের দিকে তাকাতেই নাভেদ বলল, ‘পৃথিবীর সেরা গল্পগুলো দেরিতেই শুরু হয়, জুলফা।’
জুলফা বিদায়সূচক কোনো শব্দ উচ্চারণ করল না। দ্রুতগতিতে অদৃশ্য হয়ে গেল সুরঙ্গের অন্ধকারে।
ঘরে পা দিয়েই জুলফা হুড়মুড় করে ছুটে গেল গোসলখানার দিকে। জলের ধারার নিচে দাঁড়িয়ে সে ভাবলো, হয়তো এই জল ধুয়ে মুছে দেবে তার মনের সেই অনামী আকুলতা। কিন্তু জল তো শুধু শরীরের ময়লাই ধোয়, মনের জটিলতা কি তাতে মেটে?
চাঁদেরকুটিতে কাটানো শেষ মুহূর্তগুলো যত মনে পড়ছে ততই তার অজান্তে এক নিষিদ্ধ কামনার আগুন ধীরে ধীরে দাবানলে রূপ নিচ্ছে বুকের ভেতর।
নাভেদের বলা ‘সেরা গল্পগুলো দেরিতে শুরু হয়’- কথাটা কানে বাজছে অবিরাম। কি ইঙ্গিত সেখানে লুকিয়ে আছে? নাভেদ কি তাদের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের আভাস দিচ্ছিল? আজকের ওই দৃষ্টিপাত, ওই স্পর্শের উষ্ণতা, কথার মাঝে লুকানো সূক্ষ্ম ভালোবাসা এসব কি বন্ধুত্বের সীমারেখা অতিক্রম করেনি?
জুলফা ভেজা চুলে কোমল শরীর নিয়ে বিবশ হয়ে বসে থাকে নিঃশব্দে। তার দৃষ্টি দূরাগত, মন ভাসমান। বাইরে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের মধ্যে হঠাৎ করে ভেসে আসে শব্দরের কণ্ঠস্বর।
চমক ভেঙে জুলফা উঠে দাঁড়াল। শাড়ি পরিবর্তন করে বেরিয়ে এলো বাইরে।
গোসলের পর নারীদেহ নতুন মাধুর্যে সজ্জিত হয়ে ওঠে। ত্বকের দীপ্তি বেড়ে যায়, চোখে জাগে উজ্জ্বলতা, আর ভেজা চুলের জলকণা মুক্তার মালার মতো ঝলমল করে। জুলফাকে দেখে শব্দর হতবাক হয়ে রইল কিছুক্ষণ। সে এগিয়ে এসে জুলফার কাঁধে গড়িয়ে পড়া জলবিন্দুগুলো আলতো আঙুলে মুছে দিল। তারপর কোমল আবেগে জড়িয়ে ধরল তার কোমর।
জুলফার অন্তরে দাবানল জ্বলে উঠল। যে প্রতিরোধ কিছুদিন সুপ্ত ছিল তার মনে, আজ সেই প্রতিরোধ আবার জেগে উঠল নতুন বেগে। সে মৃদু ধাক্কায় নিজেকে শব্দরের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘বাইরে থেকে এলেন, গোসল সেরে নিন। আমি আপনার জন্য খাবার…’
কথা শেষ হতে না হতেই শব্দর আবারও তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঠান্ডা কাঁধে, খোলা পিঠে দিল অজস্র চুমু। হাতের বাঁধন আরও মজবুত হয়ে এলো। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এতদিনেও কি তোমার সংকোচ কাটেনি?’
জুলফার ভেতরটা হঠাৎ করেই এলোমেলো হয়ে যায়। এ স্পর্শে না আছে প্রেমের কোমলতা, না কামনার শিহরণ। এ তো একটা অভ্যাসগত অধিকার, ক্লান্তিকর এক দখলদারিত্ব। অন্যদিকে, নাভেদের ওই ছোট্ট স্পর্শ, চুল সরিয়ে দেয়া, আঙুল ছোঁয়ার মুহূর্ত ছিল প্রেমের উত্তাপে ভরা। মনে হচ্ছিল, বুকের মধ্যে হাজারো প্রজাপতি ডানা মেলছে।
তার মুখে জমে ওঠে তীব্র বিরাগ। কণ্ঠ কাঁপে অস্থিরতায়, ‘সবসময় এভাবে গায়ে পড়বেন না, ভালো লাগে না।’
শব্দর তবুও থামার নাম নেয় না। জুলফা সর্বদাই প্রতিরোধ করে, কিন্তু প্রায়শই সেই প্রতিরোধ নরম হয়ে আসে পরক্ষণেই। এমনটাই তার বিশ্বাস, এবারও নিশ্চয়ই জুলফার আপত্তি মিলিয়ে যাবে, আগের মতোই কোমল হয়ে উঠবে তার প্রতিবাদ। কিন্তু এবার জুলফা তার দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভ আর বিতৃষ্ণা একত্রিত করে শব্দরের বুকে প্রবল ধাক্কা হানল।
আকস্মিক আঘাতে ভারসাম্য হারিয়ে শব্দর পিছিয়ে পড়ল। অপমানের গ্লানি, বিস্ময়ের স্তব্ধতা আর শীতল বাতাসে পূর্ণ হয়ে উঠল চারিদিক। সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগেই তার বুকে ফিরে আসে গতকালের সেই পরিচিত যাতনা।
গত রাতটা ছিল শব্দরের জীবনে দ্বিতীয় দীর্ঘতম রাত। আসিদপুর থেকে ফেরার পথে, হঠাৎ করেই তার শরীর নিজের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ শুরু করে। প্রথমে মাথার পিছনে জমে উঠতে থাকে তীব্র, পাক খাওয়া যন্ত্রণা। যেন কেউ ভেতর থেকে তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলোকে প্যাঁচিয়ে ধরেছে। সেইসাথে কানের পাশ দিয়ে ভোঁ-ভোঁ শব্দ ক্রমশ বেড়ে উঠছিল।
বুকের গভীর গহ্বর থেকে উঠে আসে মোটা সূঁচের মতো তীক্ষ্ণ বেদনা; চাপা শ্বাসরোধকারী যন্ত্রণা, যা হাড়ের গাঁটে গাঁটে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল। আশ্রয়দাতা পরিবারের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে তড়িঘড়ি চিকিৎসক ডেকে আনে। ওষুধও দেওয়া হয়। কিন্তু ওষুধ নয়, মনে হচ্ছিল তা যেন বিষ। ঘুম নয়, সে যেন তলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকার, অতল সমুদ্রে। যেখানে শ্বাস নেই, আলো নেই, মুক্তি নেই।
সকালে যখন চোখ খুলল, চারপাশ ঢেকে ছিল দুধসাদা কুয়াশার চাদরে। সেই কুয়াশা ছিল মানসিক ও শারীরিক বিভ্রমের। শরীরটা নিজের মনে হচ্ছিল না; যেন শরীরের ভেতরে কেউ অন্য একটা দেহ বসিয়ে দিয়েছে। চোখের পাতা ভারি, বুকের ভেতর কুন্ডলী পাকানো অস্বস্তি। সেই ক্লান্তি, সেই বিষণ্ন ভার আজও গায়ে লেগে ছিল। যা জুলফার আকস্মিক ধাক্কায় হঠাৎ জেগে উঠেছে প্রবল রোষে।
কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ বিছানায় বসে পড়ে শব্দর। চোখ লাল হয়ে আসে, শিরা ছিঁড়ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
জুলফা দমবন্ধ আতঙ্কে এগিয়ে আসে। কণ্ঠে চিড় ধরা উদ্বেগ, ‘কী হলো? কী হলো আপনার? এইভাবে শ্বাস নিচ্ছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে?’
শব্দরের মুখে কোনো শব্দ নেই। তার ঠোঁট দুটি কাঁপছে। চোখের সামনে জগতটাই কুয়াশার দেয়ালে মুছে যাচ্ছে। চোখ দুটি যেই না উল্টে যেতে শুরু করে জুলফা ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
চাঁদেরকুটির কবরস্থানের নির্জন প্রান্তে বসে আছে নাভেদ। ছায়াঘেরা আকাশ থেকে নেমে আসা হালকা বৃষ্টিধারায় তার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে, কাদা-মাখা মাটির গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। চারপাশে শুধু পাতায় পাতায় জল পড়ার শব্দ।
তার সামনে থাকা পুরনো এক কবর, যার নামফলক বৃষ্টিজলে ঝাপসা হয়ে গেছে। সমাধির পাথরে মরিচা লেগেছে, ঠিক যেমন তার হৃদয়ে পাঁজরের পর পাঁজর জমেছে ক্ষোভ, কষ্ট আর প্রতিশোধের কণা।
তার ডান হাতে ধরা একটা ছোট্ট কাঁচের শিশি। ভেতরে স্বর্ণালি তরল। নিজের হাতে, নিজের রাগ, শোক আর ঘৃণার সংমিশ্রণে তৈরি করা বিষ। খুব সন্তর্পণে শিশিটি রাখে কবরের উপর। তারপর
মাটির নীচে যার দেহ পচে মিশে গেছে চিরকালের জন্য তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপা…খোদার কসম আপা, ওকে আমি তোর থেকেও বেশি যন্ত্রণা দেব। তবে জানে মারব না, ও বেঁচে থেকেও গলেপঁচে যাবে। ওর মন আর শরীর দুটোই আমি বিষে চুবিয়ে রাখব। মৃত্যু চেয়ে আকুতি জানাবে, কিন্তু সেই রহমতও আমি দেব না। শুধু…ভোগ করাব।’
‘প্রতিশোধে নাও কিন্তু অন্ধ হয়ে একজন নির্দোষকেও শূলে চড়িও না। বলো তো, অপরাধ শব্দরের? না তার স্ত্রীর?’
সাদা চুলের এক বৃদ্ধ লোক হাতে ছাতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে বৃষ্টির মধ্যে। দাঁড়িয়েছে ঠিক নাভেদের পিছনে।
নাভেদ তার কথায় কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। এরপর কণ্ঠে তীক্ষ্ণ ধার বসিয়ে বলল, ‘ও শব্দরের বউ। ভূঁইয়া বংশের সম্মান নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মাথা উঁচু করে। আমি সেই অহংকারেই কোপ মারব। চোখের বদলে চোখ, ক্ষতের বদলে ক্ষত।’