নিস্তব্ধ রজনী, চারিধারে পোকামাকড়ের আওয়াজ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। আঁধারে ঘেরা সমগ্র জায়গায় সুনসান নিরবতায় সবারই ভয় করবে। এরই মাঝে ছোট্ট বাড়িটিতে লাইট জ্বলে উঠলো। ভেতর থেকে ভেসে এলো এক লোকের সাহায্যের আর্তনাদ। যা চারপাশের সেই আঁধারের মাঝেই হারিয়ে গেলো। না কেউ জানতে পারলো আর না কেউ খবর পেলো।
ছোট্ট এই বাড়িটা থেকে বের হলো রিয়াদসহ আরও তিন চারজন যুবক। বাহারাজ,অভ্র বা শায়ন নেই এখানে। রিয়াদের ফোনে কল আসতেই নিরবতা কিছুটা ভাঙলো। রিয়াদ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে কল রিসিভ করলো।
“ হ্যালো বল।’’
অপরপ্রান্ত হতে কেউ বললো,“ কাজ হয়েছে?’’
“ হ্যা।’’
“ বেশি যখম করেছিস নাকি আবার?’’
“ নাহ তেমন কোনোকিছুই করি নি। পেনড্রাইভটা দিচ্ছিলো না বিধায় বাম আঙুল কেটে দিয়েছি।’’
এদিকে বাহারাজের পাশে বসে থাকা স্মরণ কথাটা শুনেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। চমকিত নয়নে বাহারাজের দিকে তাকাতেই দেখলো বাহারাজ খুব সিরিয়াস মুডে কথা বলছে। একটু আগে সাউন্ড লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিলো। এখন কমিয়েছে লোকটা। কিন্তু আঙুল কেটে দিয়েছে মানে কি? এসব কি? স্মরণ ভয় পেলো। মুখে ভয়ার্ত ভাব স্পষ্ট। রীতিমতো বাহারাজকে সন্দেহ হতে লাগলো। আগে তো বীজ ছিলো এখন চাড়া উঠছে। এই লোকটা আসলেই কোনো মাফিয়াই হবে হয়তো। স্মরণের এসব অহেতুক ভাবনায় হঠাৎ উঁকি দিলো ‘বাহারাজকে কি তাকে তাড়ানোর জন্য এই কাজ করছে?’—এই কথাটা। সাথে সাথেই মুখ গম্ভীর করলো স্মরণ। তাড়ানোর মন আছে তো এতো সাহায্য কেন করলো? একে সিট–টা দেওয়াও উচিত হয় নি ভেবে আফসোস করতে লাগলো স্মরণ।
এদিকে বাহারাজ তখনও রিয়াদের সাথে কথা বলছে। রিয়াদ পাশে থাকা অফিসারদেরকে চলে যেতে বলে নিজে ভিন্ন পথ ধরলো। অফিসাররা চলে গেলো। রিয়াদ বাইকে চড়ে বসলো। গন্তব্য এখন ভিন্ন জায়গায় বিশেষ কোনো এক কাজে। সে তখনও বাহারাজের সাথেই কথা বলছিলো। এক সময় গিয়ে প্রশ্ন করে বসলো,“ স্মরণ কেমন আছে?’’
বাহারাজ আড়চোখে মুখ গম্ভীর আর চোয়াল শক্ত করে রাখা স্মরণের দিকে তাকালো। উত্তরে জানালো,“ বাসে আছি।’’
“ কিহহ? বাস? আবার তুই? কেন কেন?’’
বাহারাজ উত্তরে বললো,“ বিশেষ কিছুর প্রয়োজনে বিকল্প কিছু মাঝে মধ্যে বেছে নেওয়া যৌক্তিক বলে, আমি মনে করি। এটাও তেমন কিছু।’’
রিয়াদ হেসে উঠলো। শার্টের গায়ে লেগে থাকা রক্তটা থেকে ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসছে। শার্ট চেঞ্জ করা জরুরী। রিয়াদ বাহারাজকে বললো,
“ আমি চেঞ্জ করবো, রাখি। রাতে ডিটেইলস ইমেইল করবো।’’
কল কেটে দিলো। এখন শপিং মলে গিয়ে কেনাকাটা শোভা পাবে না। সবাই সন্দেহ করবে। তাই রাস্তায় থাকা ভ্যান থেকে একটা শার্ট কিনে নিলো। বাইকে চড়ে নির্জন একটা জায়গায় গিয়ে পাল্টে নিলো নিজের শার্ট। হাত ধোয়া জরুরি। আবারও বাইকে চড়ে বসলো। অবশ্য পকেট থেকে মাস্ক বের করতে ভুললো না।
বিশাল বড় এক বাড়ির সামনে এসে থামলো রিয়াদের বাইকটা। বাড়ির দারোয়ান বাইকের আওয়াজ পেয়ে গেইট খুলে বেরিয়ে আসলো। রিয়াদকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,“ কে আপনি?’’
“ রিয়াদ বলছি। সীমান্তর নতুন টিচার।’’
দারোয়ানের মুখের গাম্ভীর্যতা কেটে গিয়ে চলে আসলো ভদ্রতা আর মুখে এক চিলটে হাসি। রিয়াদকে সালাম জানিয়ে বললো,“ আসেন আসেন। স্যার বইলা রাখছিলো আইজকা সীমান্ত বাবার নতুন স্যার আইবো। আপনে যান। এইযে গেইট খুইলা দিলাম।’’
রিয়াদ কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বাইক নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। এবার আরও বেশি বাড়িটা সুন্দরভাবে প্রদর্শিত হলো তার সামনে। স্বয়ং বাড়িটাই যেন তাকে নিজের রূপ দেখাতে চাইছে এমন। রিয়াদ বাইকটা সাইড করে রাখলো তারপর ভেতরে ঢুকলো। বাড়ির সদর দরজা খোলা থাকায় খুব একটা কষ্ট করতে হলো না তাকে।
একজন ভদ্র মহিলা বসার রুমে বসে ছিলেন। রিয়াদ ভদ্র মহিলাকে সালাম জানালো। ভদ্র মহিলা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে রিয়াদকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। বড় বড় চক্ষুজোড়ার ওপরে মোটা ভ্রু, সুচালো নাকের নিচে খয়েরী রঙা ঠোঁট। এলোমেলো চুলগুলো কপালে পড়ে আছে। বলিষ্ঠ দেহে কালো শার্ট জড়ানো। কালো শার্টের সাথে আবার ম্যাচিং করে কালো জিন্সও পরনে। চমৎকার এই চেহারার সুপুরষতাই যেন বলে দিচ্ছে ছেলেটার ভদ্রতা।
“ দোতলায় উঠে বাম দিকে গিয়ে ডান দিকের প্রথম রুমটাই তোমার স্টুডেন্টের রুম।’’
রিয়াদ মাথা নাড়িয়ে হাঁটা ধরলো। আড়চোখে একবার বাড়িটা দেখলো। বাইরে থেকে যতোটা না সুন্দর। ভেতরে আরও বেশি সুন্দর। দোতলায় এসে প্রথমেই দেখা পেলো এক মেয়ের। মেয়েটাকে চেনা চেনা মনে হলো রিয়াদের। একটা ছেলের সাথে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ছেলেটার বয়স ষোলো সতেরো হবে।
“ সিমানী আপু, আজকে না আমার স্যারের আসার কথা ছিলো?’’
সিমানী সামনে তাকাতেই দেখলো স্মরণদের বিল্ডিংয়ের বাহারাজ নামক সেই ভাইয়ের বন্ধুটাকে। চমকে গেলো সিমানী। এ এখানে করছে–টা কি? সিমানীর মস্তিষ্ক বলে উঠলো ‘এই আবার সীমান্তর হোম টিউটর নয়তো?’
রিয়াদ তখন সামনে এগিয়ে এসে ছেলেটাকে বললো,“ আমিই তোমার হোম টিউটর।’’
সিমানীর সন্দেহ সঠিক হলো। সীমান্ত হেসে সালাম জানালো। রিয়াদ সালামের উত্তর দিয়ে বললো,“ চলো তাহলে যাওয়া যাক।’’
সীমান্ত মাথা নাড়িয়ে রিয়াদকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। বোনের কথা তার মনে নেই। নতুন টিচারকে পেয়ে সে এখন গল্প জুড়ে দেবে এই ভাবনা। এদিকে সিমানী তখনও অবাক ছিলো। ওদের যাওয়ার সময় পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখলো ছেলেটার হাতে লাল কিছু। সিমানী বুঝতে পারলো না কি ওটা। তবে সন্দেহ হলো তার। সিমানী মনে মনে ঠিক করলো বন্ধুদেরকে এখনই জানাতে হবে এই ছেলেটার ব্যাপারে।
______________________
বাস থেকে নেমে যখন সামনের দিকে হাঁটা ধরলো স্মরণ তখন পেছন থেকে বাহারাজের ডাক এলো,“ এই মেয়ে দাঁড়াও।’’
‘এই মেয়ে’ ডাকটা শুনে মেজাজ কিছুটা চটে গেলো। কেন স্মরণ নামটা কি ব্যাটা জানে না নাকি? এতো দেমাগ? স্মরণ তো পেছনে তাকাবেই না। এই লোকটা ভয়ানক অনেক। যেই ভাবা সেই কাজ উলটো হাঁটা শুরু করলো স্মরণ। তখনই আবার পেছন থেকে বাহারাজ বলে উঠলো,“ বধির তুমি? কানে শুনতে পাও নি কি বলেছি?’’
স্মরণ পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বললো,“ শুনতে পেয়েছি তবে উত্তর দেওয়ার মানসিকতা জাগে নি।’’
“ এই টুকু মেয়ের আবার মানসিকতা?’’
ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালো স্মরণ,“ আপনি কি বলতে চাইছেন? আপনার বাজে কথা শোনার জন্য আমি মোটেও রাজি নই।’’
“ বাজে বকা বন্ধ করো। এটা নিয়ে যাও।’’
একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো স্মরণের দিকে। স্মরণ বুঝলো না এটা কি? জিজ্ঞাসা করতে চাইলে এর আগে বাহারাজ বললো,“ তোমার জন্য নয় এটা শীতলের জন্য। ওকে সরাসরি দিতে পারবো না তাই তোমার অবলম্বনে..’’
বাকি কথাটা শুনলো স্মরণ। শুধু শুনলো এটা শীতলের জন্য। স্মরণের সন্দেহ আরও বেশি প্রখর হলো। এই শীতলের সাথে বাহারাজের কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? শীতল আবার নয়নকে চিট করছে না তো?
“ ওমন বাজে চিন্তাধারা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কারণ অলরেডিই বাহারাজের নজরে একজন পড়ে গেছে। সেখানে শীতল ভাবা বড্ড বেমানান।’’
চলবে,…