কোহিনূর দ্রুত পায়ে ঘরে প্রবেশ করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে দেহটা নামিয়ে বসেন পালঙ্কে। হাত থেকে লাঠিটি গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। চোখ দুটি বন্ধ করে নেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ললিতার কণ্ঠটা বজ্রের মতো প্রতিধ্বনি তুলল মনে, ‘কারও হৃদয় ভগ্ন করা, কাউকে আত্মঘাতের পথে ঠেলে দেওয়া এগুলোও কি অপরাধ নয়?’
অপরাধ… সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ। কোহিনূর নিজেকে অপরাধিনী ভাবেন। বিগত দশকগুলি ধরে অবিরাম বহন করেছেন সেই পাপবোধের অসহনীয় ভার। হৃদয়ের অতলে প্রোথিত সেই স্মৃতির শিকড় তিনি আজও উৎপাটিত করতে পারেননি। সেই মুক্তাভ হাসির অধিকারী তরুণ…তার চরণে নিবেদিত করেছিল নিজের সমস্ত আস্থা, স্বপ্ন এবং অনুরাগ। পরিবর্তে তিনি তাকে কী দিয়েছিলেন? শূন্যতা; কেবল একটুকরো অবসাদ, প্রতীক্ষার বিষাক্ত দংশন…এবং সবশেষে মৃত্যু।
এখনো মনে পড়ে সেই গোধূলি বেলার স্মৃতি, যখন স্বামীর বাড়িতে বসে মাতুলালয় থেকে আসা চিঠিটি কী উল্লাস নিয়ে খুলেছিলেন। কিন্তু তাতে লেখা ছিল, আলীর আত্মসংঘাতের সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি।
দিন গড়িয়েছে, মাস কেটেছে, বছর পেরিয়েছে। কিন্তু নেভেনি বুকের আগুন। কত রাত তিনি ঘুমাননি, বিছানায় পড়ে থেকেছেন ঘোরহীন চোখে। আলীর কবর দর্শনের আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বারংবার, হয়তো একবার কবরের মাটি ছুঁয়ে ক্ষমাভিক্ষা চাইলে এই উদ্বেলিত হৃদয়ে অল্প শান্তি নেমে আসত। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবেই যাননি। তিনি নিজের দণ্ড কামনা করেন। এই অন্তর্যন্ত্রণাই তার প্রাপ্য। ক্ষমাপ্রার্থনা করলে তো সান্ত্বনা পেয়ে যাবেন!
স্মৃতির ভারে কোহিনূরের কাঁপা চোখে জমে ওঠে টলটলে জলের ফোঁটা। একজন প্রেমিকের নিষ্পাপ চোখে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়ার দায় তিনি আজীবন ধরে বহন করবেন…আজীবন ধরে!
সন্ধ্যার উন্মত্ত ঝড় রক্তপিপাসু শিকারির মতো সবকিছু ছিঁড়ে-ফুঁড়ে দিয়ে গেছে। উপড়ে যাওয়া গাছের শিকড় এখন মৃত দানবের মতো পড়ে আছে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা ডালপালা। আকাশ পরিষ্কার, নির্বিকার৷ যেন কিছুই দেখেনি, কিছুই জানে না। নিঃসাড়, মসৃণ সেই আকাশের নিচে হালকা, ভ্রান্তচঞ্চল বাতাস কেবল জাওয়াদের কপালের ভেজা চুলগুলোকে ধীরে ধীরে নাচিয়ে চলেছে। সে চোখ মেলল।
দৃষ্টিপটে প্রথমে সবকিছু ঝাপসা, ধোঁয়াটে। একপ্রকার অস্বস্তিকর ভার তাকে চেপে ধরে। তারপর ধীরে ধীরে আলো ও ছায়ার খেলা স্পষ্ট হয়। দেয়ালে ফাটল, খসে পড়া চুন-সুরকি, দরজার ফ্রেমে ঝুলছে মরিচা ধরা তালা।
হঠাৎ করেই স্মৃতির দরজা খুলে যায়। রাজ্জাক আর অরিজিতকে অনুসরণ করে ঝড়ের কারণে সে এই পরিত্যক্ত স্থানে পা রেখেছিল। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা আকাশচেরা গর্জনে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সেই বিভ্রান্ত মুহূর্তেই কাঁধের কাছে একটা সূক্ষ্ম বিষের টান লাগে, যেন কেউ সূঁচ ফুটিয়েছে চুপিসারে। তারপর অন্ধকার।
জাওয়াদ হাত রাখে ঘাড়ে, চামড়ার নিচে এখনো তপ্ত তীরের মতো পোড়ে সেই বিন্দুটি। তীব্র ক্রোধে তার বুক কাঁপে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ায় সে, ভাঙা দরজার খিড়কি ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে মৃদু ঠান্ডা বাতাস, চারদিকে নিস্তব্ধতা…না রাজ্জাক, না অরিজিত আর না অন্য কেউ…কারোরই কোনো চিহ্ন নেই।
উত্তপ্ত পায়ে সে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় এক বিবর্ণ, পচন ধরা গাছের সামনে। রাগে লাথি হানে, গুঁড়ির গায়ে জমে থাকা সবুজ শ্যাওলা ঝরে পড়ে মাটিতে।
‘কারা ছিল ওরা?’ ঠোঁট নড়ল কিন্তু শব্দ বের হলো না। গলার ভেতর জমে থাকা ভয়, শঙ্কা আর সন্দেহ কণ্ঠরোধ করে ফেলল। অধৈর্য পায়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করল এপাশ-ওপাশ। তারপর হতাশার বোঝা কাঁধে নিয়ে ফিরে এলো মহলে।
যেখানে গুলনূরকে বসিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেই জায়গায় বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে ঢুলে পড়েছে সে। ওড়না ছড়িয়ে আছে অগোছালোভাবে, পায়ের কাছে খোলা খাতা, পাশটিতে একটি কলম। জাওয়াদ থমকে দাঁড়াল দৃশ্যটি দেখে। বাতাসের দোলায় তার কাঁধের কাপড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে এলো প্রেমময় অনুভূতির সুরেলা গুনগুন।
সে নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগোল আস্তে আস্তে। ঘুমন্ত মুখের কাছে এসে বসল নিঃশব্দে, গুলনূরের দিকে তাকিয়ে রইল মুগ্ধ চোখে। কী মায়াবী মুখখানি…এমন মায়াময় মুখ কি সে আর কোথাও দেখেছে?
অল্পক্ষণ পরেই গুলনূর চোখ খুলল। সামনে কাউকে দেখে চমকে উঠতেই জাওয়াদ তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি… ভয় নেই।’
গুলনূর সম্বিত ফিরে পেয়ে সোজা হয়ে বসল। তার চোখে ঘুমের ঘোর আর সংকোচ মিশে একাকার। পাশে পড়ে থাকা খাতা-কলমে নজর পড়ল জাওয়াদের। সে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি এতক্ষণ এখানেই বসে ছিলে?’
গুলনূর তড়িঘড়ি করে কলম তুলে লিখল, ‘ক্ষমা করবেন হুজুর, একবার বড় বেগমের ঘরে আরেকবার গোসলখানায় যেতে হয়েছিল।’ তার মাথা নুয়ে পড়েছে, চোখে-মুখে এক ধরনের গ্লানিমাখা আত্মসংবরণ। নিজেকে আড়াল করার প্রয়াসে সে একটু দূরে সরে গিয়ে আঁচল তুলে মাথা ঢাকতে চাইল…জাওয়াদ হাত বাড়িয়ে ওড়না টেনে ঘোমটা দিতেই দুজনের চাহনি মিলে গেল। কিছু মুহূর্ত নিস্তব্ধতা, কোনো কণ্ঠস্বর নেই, শুধু বুকের ভেতর থেকে ভেসে আসে মিহি কম্পন।
জাওয়াদ মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলতে চাও?’
গুলনূর চোখ নামিয়ে অলস হাতে কলম তুলে খাতায় লিখল, ‘বিয়েতে আমার সম্মতি চাওয়া হয়নি, হুজুর।’
জাওয়াদের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। ‘তোমাকে কেউ জোর করে কোনো কাজে বাধ্য করতে পারবে না, গুলনূর।’
‘কিন্তু একজন নারীর জীবন তো বিয়ের মধ্য দিয়েই সার্থকতা পায়, সমাজ তাকে তখনই মর্যাদা দেয়।’
‘কী বলতে চাইছ? তাহলে তুমি বিয়েতে সম্মত?’
গুলনূরের হাত স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে লিখল, ‘না, হুজুর। যে নারীর জীবনে পুরুষ মানেই আতঙ্ক, বিতৃষ্ণা… যে অন্ধকারে পুরুষের উপস্থিতিতে ভয় পায়, যে নিজের সম্ভ্রম হারিয়েছে কোনো এক পুরুষের কারণে, সে কীভাবে আরেকজন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে পারে? কিন্তু আমি তো একজন দাসী… আমার মতামতের তো কোনো মূল্য নেই। মালিকের আদেশই চূড়ান্ত।’
জাওয়াদ দু’পা গুটিয়ে গুলনূরের সামনে বসে বলল, ‘না গুলনূর, এখন সময় বদলেছে। তুমি কারো দাসী নও। তুমি মানুষ। তুমি নারী। স্বাধীনতা আর সম্মানের দাবিদার।’
‘দাসী তো… এক বস্তুমাত্র। প্রভু তার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার করে।’
‘এসব অতীতের কথা। এখন তুমি নিজ জীবনের নিয়ন্ত্রক। তোমার অনুমতি ছাড়া কেউ তোমার ভাগ্যে কিছু আরোপ করতে পারবে না।’ বলেই জাওয়াদ দু’অঙ্গুলিতে গুলনূরের থুতনি তুলে ধরে, চাহনি স্থির করল নয়নে নয়নে। বলল, ‘তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছুই ঘটতে দেব না। আসাদের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না। আমি আছি তোমার পাশে, সকলের বিরুদ্ধে লড়ব আমি।’
তার কথা শুনে গুলনূরের দেহে শিহরণ জাগে, সূক্ষ্ম রোমকূপগুলো কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে ফজরের আযানের সুর। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় – আল্লাহু আকবার…
বৈঠকখানার জানালা গলে সূর্যের কোমল আলো এসে পড়েছে শব্দরের মুখে। সে বসে আছে চুপচাপ, কোমরে একটা হালকা চাদর জড়ানো, শরীরে এখন আর ক্লান্তির ছাপ নেই। পাশে বসা সুফিয়ান দ্বিতীয়বারের মতো তাকে সদরের হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও, শব্দর নিঃসংশয়ে জানিয়ে দিল, এখন সে পুরোপুরি সুস্থ, দুইদিনের দুর্বলতার জন্য শহরে ছুটে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
সুফিয়ানও আর তর্কে গেলেন না। তিনি বইয়ের পাতায় চোখ রাখলেন, আর শব্দর মনোযোগ দিল কিছু কাগজপত্রে। সম্ভবত জমির নথিপত্র কিংবা কোনো ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশ।
দাসীরা নীরব পদচারণায় প্রাতরাশের আয়োজন করছে৷ কাঁসার থালায় সযত্নে রাখা হচ্ছে গরম রুটি, দেশি ঘি-তে ভাজা সবজি, আর মৌসুমী ফলের ছোট্ট ঝুড়ি। তখন অতিথি ভবন থেকে প্রবেশ করল নাভেদ। বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু করে শ্রদ্ধাভরে সালাম জানাল সুফিয়ানকে।
সুফিয়ান চোখ তুলে বললেন, ‘এসো নাভেদ, বসো।’
নাভেদ বসে কিছুক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে ঝুঁকে বসে রইল, তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘চাচাজান, আপনাকে ব্যক্তিগত কিছু কথা জানানো দরকার।’
সুফিয়ান উৎসুক হয়ে বললেন, ‘নিঃসংকোচে বলো।’
নাভেদ কিছুটা সংকোচে, কিছুটা সাহস নিয়ে বলল, ‘আমি একজনকে ভালোবেসেছিলাম বছর তিনেক আগে। গরীব ঘরের মেয়ে। বাবা রাজি হননি, তাই বছরখানেক আগে গোপনে বিয়ে করি।’
শব্দর কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে তাকাল তার দিকে, চোখে বিস্ফারিত কৌতূহল। নাভেদ বিরতি না নিয়ে বক্তব্য অব্যাহত রাখল, ‘মেয়েটার নাম বেলি। এখনো বিয়ের কথা কেউ জানে না। মামার বাড়িতে থেকে দশম শ্রেণী অবধি পড়েছে। এখন তাকে রাজধানীতে কলেজে ভর্তি করিয়েছি। কাল ছুটিতে এসেছিল বাপের বাড়ি… এখান থেকে দু’গ্রাম পরেই উজানচর, ওখানেই তার বাবার বাড়ি। একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম… হঠাৎ রাস্তায় ঝড় উঠে গেল…’
সুফিয়ান মন দিয়ে শুনছিলেন। নাভেদ লজ্জায় কথা শেষ করতে পারছিল না দেখে তিনি হাসিমুখে নাভেদের কাঁধ স্পর্শ করে বললেন, ‘এতো খুবই ভালো খবর! আর লুকোচুরির দরকার নেই। তোমার বউকে নিয়ে এসো, এখানেই থাকো তোমরা। নতুন সংসার পাতো, আমার দোয়া তোমাদের সঙ্গে থাকবে সর্বক্ষণ।’
নাভেদের মুখে তখনই হাজার আলো ছড়িয়ে পড়ল, যেন অনেক দিনের জমানো বোঝা নেমে গেল তার কাঁধ থেকে। সে বলল, ‘কলেজ শেষ করতে এখনো ছ’মাস সময় লাগবে, তারপরেই নিয়ে আসব, চাচাজান।’
শব্দর হেসে বলল, ‘তাই বল! আড়ালে এত কাণ্ড চলছে? এতদিন পাশাপাশি থেকেও টের পেলাম না যে আমার সঙ্গী সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই গৃহী মানুষ।’
নাভেদ লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নুইয়ে হাসল। তাকে এমন কিশোরের মতো লজ্জা পেতে দেখে শব্দর আর সুফিয়ান দুজনেই এক সঙ্গে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
সবাই দীর্ঘক্ষণ ধৈর্য ধরে বসে থাকার পর অবশেষে নাস্তার আসরে এসে উপস্থিত হলেন কোহিনূর। তার মুখে কোনো আবেগের ঢেউ নেই, যেন কোনো স্থির জলাশয়ে পাথর ছোড়া হয়নি বহুদিন। রাতভর তিনি ঘুমাননি। সুফিয়ান, শব্দর, রাইহা, জুলফা, ললিতা, নাভেদসহ সমবেত সবাই সালাম জানালে তিনি কেবল হিমেল কণ্ঠে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন, অতিরিক্ত একটি বর্ণও উচ্চারণ করলেন না।
মুহূর্তপরেই এলো জাওয়াদ। কেউই তার প্রতি বাক্য বিনিময়ে উদ্যোগী হল না, একমাত্র শব্দর তার দিকে করুণাভেজা দৃষ্টি মেলে কোমলস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘শরীরটা ভালো বাবা?’
জাওয়াদ মৃদু মাথা দোলালো আর বলল, ‘ভালো।’ এরপর নিঃশব্দে খাবারে মনোযোগ দিল। গুলনূর অন্যান্য পরিচারিকাদের সাথে মৌন থেকে খাবার পরিবেশন করে যাচ্ছে।
যখন ভোজন প্রায় অন্তিমে পৌঁছেছে, তখন মনির পা টিপে টিপে কোহিনূরের সামনে এসে উপস্থিত হলো নত মাথায়। জাওয়াদের দিকে ক্ষণিকের জন্য আতঙ্কিত দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আওয়াজ নামিয়ে বলল, ‘বিয়ের তালিকায় আর কিছু কি যোগ করতে হবে, দাদিজান?’
কোহিনূর কিছু বলার আগেই জাওয়াদের কণ্ঠস্বর মেঘগর্জনের মতো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল, ‘এ বাড়িতে কোনো বিয়ে-টিয়ে হবে না।’
গতকাল থেকে জমিয়ে রাখা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন সুফিয়ান, ‘কেন হবে না বিয়ে?’
জাওয়াদ পিতার দৃষ্টিতে দৃষ্টি স্থির রেখে অবিচল কণ্ঠে বলল, ‘একজন নারীর মতামত ছাড়া আপনি তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারেন না।’
সুফিয়ান ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্রতি আঘাত হানলেন, ‘গুলনূর তো কোনো আপত্তি জানায়নি! তাহলে তোমার এত হইচই কিসের জন্য?’
‘আপনারা কি কখনও ওকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন?’
‘জিজ্ঞেস? একজন দাসীকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন কোথায়? তাছাড়া আমরা ওর কল্যাণের জন্যই তো বিয়ে ঠিক করেছি। মুখে ভাষা নেই যে মেয়ের, শেষমেষ নিজের সংসার পাবে, নিজের ঘরবাড়ি হবে এই তো পরম সৌভাগ্য!’
‘মঙ্গলের নামে জোর-জবরদস্তি বিয়ে দেওয়াটা সঠিক পথ নয়।’
ক্রোধে উত্তাল সুফিয়ান চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন, ‘তাহলে কী করাটা সঠিক? শহরে নিয়ে গিয়ে কোনো অভিজাত পরিবারের ছেলের সঙ্গে এক ঘরে থাকা?’
‘বাবা!’ জাওয়াদের কণ্ঠধ্বনি যেন মুহূর্তেই বাতাস চিরে দ্বিখণ্ডিত করল।
‘তুমি তো তাই করেছো। এখনো তাই চাও, অস্বীকার করতে পারবে?’
জাওয়াদ এক নিঃশ্বাসে বলল, ‘না, আমি তা চাই না। আমি গুলনূরের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যৎ কামনা করি।’
‘তাহলে বিয়েতে বাধা কেন?’
‘বিয়েই সবকিছু নয়। বিয়েই মেয়েদের একমাত্র পথ নয়।’
‘একজন নারীর জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা তার স্বামীঘরে থাকে। স্বামীই তার আশ্রয়, তার সম্মান।’
এবার ধীর-স্থির স্বরে শব্দর মধ্যস্থতার প্রয়াস নিল, ‘গুলনূরের বয়স হয়েছে, জাওয়াদ। আসাদ ছেলেটি মন্দ নয়, ওর সঙ্গে সুখেই থাকবে গুলনূর। তুই যদি এই সম্বন্ধ ভেঙে দিস, মেয়েটার জীবন অন্ধকারে ডুবে যাবে।’
জাওয়াদ স্বর উঁচু করে বলল, ‘আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না, বিয়েই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের একমাত্র দিশা নয়!’
সুফিয়ান বললেন, ‘তাহলে তুমি কি কোনোদিনই ওর বিয়ে হতে দেবে না? মেয়েটার নিজের একটি পরিবার থাকবে না? বার্ধক্যে কে রক্ষা করবে ওকে?’
জাওয়াদ থমকে গেল। কথা বলতে গিয়ে যেন শব্দগুলি হারিয়ে ফেলল। ‘তা নয়…’
শব্দর পুনরায় যুক্তি দিল, ‘বিয়ে ছাড়া মেয়েটার পরিণাম কী হবে? নারী জাতির নিয়তিই তো স্বামীর সংসার। আজ তুই আছিস… আমরা আছি। কিছুকাল পরে? তোর সংসার হবে, জীবনসঙ্গিনী হবে, সন্তান-সন্ততি হবে। গুলনূরের ভবিতব্য কী? ও কি সারাজীবন নিঃসঙ্গতায় ক্ষয়ে যাবে? পরের বাড়ি দাসীবৃত্তি করে জীবন কাটাবে?’
জাওয়াদ যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
সুফিয়ানের কণ্ঠে আগুন জ্বলছে, ‘স্পষ্টভাষায় উচ্চারণ করো আজ। আজই সমস্ত জটিলতা নিষ্পত্তি করে ফেলো। গুলনূরকে কেন্দ্র করে তোমার এই অভিনয় আর সহ্য করব না।’
‘গুলনূরের বিয়ে হবে…’
‘কবে? বয়স বাড়লে কে বিয়ে করবে? তখন দায়িত্ব কে বহন করবে? তুমি? তোমার কি সংসার হবে না? কোন সম্পর্কের দায়ে ওর দায়িত্ব নেবে?’
‘আমি… আমি বিয়ে করব গুলনূরকে!’
কথাটি শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রাণরোধী এক নৈঃশব্দ্য ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। ললিতার মস্তিষ্কে ঘূর্ণিঝড় বইতে থাকল… তিনি একদা এক কিশোরী কন্যার জিহ্বা কর্তন করে বাকশক্তি হরণ করেছিলেন! এখন কি সেই রকমই আরেক বাকহীন তরুণী তার পুত্রবধূ হবে! এ কেমন দণ্ড !
তাদের বিস্মিত মুখকে আরও বিস্মিত করে দিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে কোহিনূর বললেন, ‘তবে তাই হোক। তুই গুলনূরকে বিয়ে কর। আমি তোদের বিয়ে দেব।
নবোঢ়া [পর্ব-৪৬]
