“ তুই কি স্মরণকে পছন্দ করিস? ’’
বাহারাজ রিয়াদের কাঁধ হতে হাত সড়ালো। সিগারেটে আরেক টান মেরে উষ্ণ ধোঁয়া আকাশের দিকে মুখ করে ছেড়ে দিলো। শীতল আওয়াজে উত্তর দিলো,“ কোনো সন্দেহ? ’’
অভ্র ভেতর থেকে বলে উঠলো,“ সন্দেহ তো অবশ্যই আছে। খিটখিটে মেজাজের এই ছেলে কি আদও কাউকে পছন্দ করতে পারে? আমার তো অনেক সন্দেহ হচ্ছে। নতুন কোনো প্ল্যান করছিস না তো আবার বাহারাজ? ’’
বাহারাজ উত্তর দিলো না। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ভেতরে ঢুকে গেলো। রুম থেকে বের হওয়ার সময় দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ স্থির হলো। কিছু বলবে! কণ্ঠে তেজ এনে সিরিয়াসভাবে অভ্রর উদ্দেশ্যে বললো,“ পছন্দের নারীকে নিয়ে ভবিষ্যতের উজ্জ্বলতা পরিকল্পনা করতে হয়, নিজের কার্যসিদ্ধির পরিকল্পনা নয়। ’’
চলে গেলো বাহারাজ। অভ্র বোকা বনে গেলো। সব যেন মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তবে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বীথিকে মেসেজ করলো। আগামীকাল চলে যাবে তারা।
এদিকে রিয়াদ তখনও দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার হঠাৎ নিজেকে তুচ্ছ মনে হলো। স্মরণের জন্য তার হৃদয়ে অনেক আগে থেকেই সফট কর্ণার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সেটা যে ভাঙার পথে। বাহারাজ আর তার বন্ধুত্বের মাঝে না আবার ফাটল ধরে৷ তাও আবার এক মেয়ের জন্য। রিয়াদ ভাবলো সে কি আদও স্মরণকে ভুলতে পারবে?
বাহারাজ কম্পিউটারের সামনে বসলো। খুব মনোযোগ দিয়ে একটা আর্টিকেল পড়লো। ধারালো মস্তিষ্ক যখন কোনোকিছুর নিঁখুত সন্ধানে ব্যস্ত, ঠিক তখনই কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে ফোনে কল আসলো। বাহারাজ কোনোরূপ বিরক্তির প্রতিক্রিয়া দেখালো না। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই শায়ন বলে ওঠে,“ নিহাল মারা গেছেন। কেউ মেরে দিয়েছে। ’’
“ জানি। ’’
ওপাশ হতে বিস্ময়াভূত কণ্ঠ,“ তুই জানিস? কিভাবে কি? ’’
“ এসব ছোটখাটো বিষয় বাহারাজের নখদর্পনে থাকে সবসময়। ’’
“ হ্যা সেটা তো জানিই। আচ্ছা খুনটা কোথায় হয়েছে সেটা কি জানিস? ’’
“ আমার বাসার পাশে। ’’
অভ্র ফোন টিপতে টিপতে বাহারাজের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,“ কি তোর বাসার পাশে? ’’
“ খুন হয়েছে। ’’
অভ্র যেন চমকে উঠলো,“ কি বলছিস? কখন কি হলো? জানালি না যে? কোথায় খুন হয়েছে?’’ বলতে বলতে বাহারাজের একদম কাছে এসে দাঁড়ালো। কেমন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,“ আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। ’’
বাহারাজ ততক্ষণে শায়নের কল কেটে দিয়েছে। অভ্রর বলা কথায় বিরক্তি নিয়ে বললো,“ এত বড় দামড়া ছেলের আবার ভয় কিসের?’’
“ বীথি আর আমা…”
বাহারাজ অভ্রর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,“ কালকে সকালেই চলে যা তোরা। সবকিছু রেডি আছে। এখন তোর কাজ শুধু জীবনটা নতুন করে শুরু করা।’’
অভ্রর মুখটা এমন যেন এখনই কেঁদে দেবে। বাহারাজ বুঝতে পারলো। মুখ বেঁকিয়ে বললো,“ ঢং করা বাদ দে। সর যাহ।’’
অভ্র চোখের জল মোছার ভান করলো। এরপর বাহারাজের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলো,“ কিন্তু তোরা তিনজন কিভাবে এদিকটা সামলাবি?’’
“ ইফতি আসছে। ”
“ কিইই? কবে? তুই আমাকে জানালি না কেন? ”
বাহারাজ বিরক্ত হলো। কাঠকাঠ গলায় বললো,“ আস্তে কথা বলতে পারিস না? ”
তখনই সেখানে রিয়াদ এলো আর বাহারাজকে বললো,“ আমি ইফতিকে আনতে যাচ্ছি। ”
বলেই চলে গেলো রিয়াদ। অভ্র বাহারাজকে অবিশ্বাস্য গলায় বলে উঠলো,“ তোরা দুজনই জানিস, অথচ আমায় জানালি না! এই ছিলো তোদের মনে? ”
বাহারাজ কিছু একটা করতে করতে গম্ভীর স্বরে শুধু উত্তর করলো,“ এখান থেকে যা। ”
রিমঝিমে বৃষ্টি তখনও পড়ছে। রান্নাঘরে এসে স্মরণ পুনরায় নিজের কাজ ধরলো। রান্নার হাত ভালো তার। কেউ শেখায় নি। ইউটিউব থেকে দেখে দেখে শিখেছে। সমস্ত কাজ শুরু করে দিলো আর বীথিকে বললো,“ তুমি রেস্ট নাও।’’
বীথি গেলো না। বরং দূর থেকে স্মরণের কাজকর্ম দেখতে লাগলো। মেয়েটা দেখতে অতিরিক্ত সুন্দর। ঠোঁটের উজ্জ্বল হাসিটা বেশি সুন্দর। চুল ছেড়ে দিলে মেয়েটাকে সুন্দর লাগবে আরও তবে ঝুটি করে রেখে সামনের দিকে কিছু এলোমেলো পড়ে থাকা চুলে সৌন্দর্যতা বেড়েছে স্মরণের। বীথি একজন মেয়ে হয়েও অন্য এক মেয়ের রূপের বর্ণনা কি অবলীলায় করে দিচ্ছে, মনে মনে।
“ তোমার বাড়ি কোথায় বীথি? ’’
বীথি সম্বিত ফিরে পেলো,“ ঢাকাতেই। ’’
“ তোমার ফ্যামিলি যদি তোমার খোঁজ খোঁজ করতে করতে এখানেও চলে আসে? ’’
“ আসবে না। ’’
“ এত কনফিডেন্স? ’’
বীথি মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। বললো,“ এতই কনফিডেন্স। ’’
“ বাহ। ’’
বীথি পুনরায় স্মরণের দিকেই তাকিয়ে রইলো। স্মরণ কাজ করছে নিজমনে৷ বীথি হঠাৎ বলে ফেলল,“ তোমাকে আমার বড় ভাইয়ের সাথে দারুণ মানাবে। তুমি যদি আমার ভাইয়ের বউ হতে দারুণ হতো। ’’
কথাটা বলেই জিভ কাটলো বীথি। মুখ ফসকে বলে তো ফেললো। এখন কি হবে? স্মরণ হতবাক হয়ে চেয়ে আছে বীথির দিকে। বীথি হাসার চেষ্টা করলো। স্মরণ অপ্রস্তুত হলো। মাথা নামিয়ে কাজে হাত দিলো। আর ঢিমে আওয়াজে জিজ্ঞাসা করলো,“ তোমার বড় ভাই আছে? ’’
বীথি মাথা নাড়লো। স্মরণ ‘ ওহ ’ বলে আবারও জিজ্ঞাসা করলো,“ তোমার প্রেমিকের নাম কি? ”
“ অভ্র। ’’
স্মরণ বীথির দিকে তাকালো। থুতনিতে আঙুল ঘষতে ঘষতে বললো,“ এই নামটা যেন কোথায় শুনেছি। চেনা চেনা লাগছে। ’’
বীথি উত্তর দিলো না। বাহারাজ তাকে বলেছিলো পরিচয় গোপন রাখতে। বীথির ফোনে মেসেজ এলো। অভ্র মেসেজ করেছে। লিখেছে–
“ ভোর ছয়টায় বেড়িয়ে এসো। ’’
বীথি মেসেজের রিপ্লায় দিলো শুধু। স্মরণ নিজমনে কাজ করে যাচ্ছে। বীথি আবারও তার দিকে তাকিয়ে রইলো।
রাতে বৃষ্টির বেগ কমলো কিছুটা। ঠান্ডা হাওয়া বইছে এখন। স্মরণের ঘুম ভেঙে গেলো কিছু আওয়াজে। আওয়াজটা কোনোকিছু পড়ে যাওয়ার আর বিকট শব্দে বাজ পড়ার। শব্দটা শুধু স্মরণেরই কানে বেজেছে যেন। ঘুমঘুম চোখে যখন বীথির দিকে তাকিয়েছিলো মেয়েটা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলো। স্মরণ উঠে দাঁড়ালো। চোখ ডলতে ডলতে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। তখনও খচখচ আওয়াজ হচ্ছে। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখন। স্মরণ এদিক ওদিক দেখলো কিন্তু কিছু নেই। তবে গেইটের কাছে একটা গাড়ি দাঁড় করানো দেখলো। স্মরণের ঘুম উঁড়ে গেলো। অন্ধকারে কিছু দেখা গেলো না। কারেন্টও নেই আবার। যেন বর্ষাকালের কোনো বর্ষার দিন আজ।
হঠাৎ বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকালো। সেকেন্ডের জন্য আলোকিত হলো চারিপাশ। স্মরণ স্পষ্ট দেখলো বাহারাজকে। ওমনিই চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার জোগাড়। ভয়ে হিম হয়ে এলো দেহ। কল্পনাতেও যেন ভাবনাগুলো আসে নি তার।
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাহারাজ। উঁহু একা নয় আর না স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে। কাউকে ছুরিঘাত করছে সে।
চলবে,…