সেই সকাল থেকেই টিভিতে প্রতিটি চ্যানেলে এক খবরই প্রচারিত হচ্ছে—“আইটি কোম্পানির সিইও মুনাওয়ার নিহালকে খুন করা হয়েছে। লাশ পরিত্যক্ত এক বিল্ডিং পাওয়া গিয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশি হেফাজতে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে লাশটি।”
বিরক্ত হলেন শুচিত্রা বেগম। সকাল সকাল এসব খুন-খারাপির কথা শোনাও যেন পাপ উনার নিকট। বিরক্তি নিয়ে চ্যানেল পাল্টালেন। আবারও সেই একই খবর। এবার টিভিটাই অফ করলেন তিনি। চোখ গেলো পাশে বসা বড় ছেলে শামসে’র দিকে। চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। ভ্রুজোড়া কুঁচকে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কি নিয়ে এতো ভাবছিস? চিন্তিত দেখাচ্ছে তোকে?ʼ
শিউরে উঠলেন যেন শামসে’র হক। এমন ভাবে তাকালেন যেন শুচিত্রা বেগম খুব ভয়ানক কিছু বলে ফেলেছে। এমন সময় আবার সিড়ি বেয়ে খুব দ্রুত পায়ে নেমে আসলো সিমানী। বাবার কাছে এসে বললো,“ বাবা আমার একাউন্টে ইমিডিয়েটলি পাঁচ হাজার টাকা পাঠাও। খুব জরুরি। আমি গেলাম। ʼ
চলে গেলো সিমানী। মেয়েটাকে চিন্তিত দেখালো। এদিকে শামসে’র হক নিজেও এতটাই চিন্তিত যে মেয়ের কথা শুনেছেন কিনা সন্দেহ। হয়তোবা শুনতে পেয়েছেন। তাইতো বিড়বিড় করে আওড়ালেন,‘তোর বাপ বেঁচে থাকবে কিনা সন্দেহ আর তুই পড়ে আছিস টাকা নিয়ে।’
পাশে বসা শুচিত্রা বেগম শুনতে পেলেন না ছেলের কথা। তবে ছেলের মুখ নড়তে দেখে বুঝলেন কিছু বলেছে শামসে’র। ভাবলেন হয়তোবা নাতিকে নিয়েই কিছু বলেছেন। তাই গলা খাকাঁরি দিয়ে বলে উঠলেন,“ সিমানী টাকা যেহেতু চেয়েছে নিশ্চয়ই কোনো কাজের জন্য চেয়েছে। পাঠিয়ে দে তাড়াতাড়ি। ʼ
“ আহ মা তুমি চুপ থাকো তো। এমনিতেই বাঁচি কিনা মরি ঠিক নেই। তোমরা আছো টাকা নিয়ে। ধুর। ʼ
মেজাজ দেখিয়ে কথাটা বলে উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন শামসে’র হক। ভারি অবাক হলেন শুচিত্রা বেগম। উনার ছেলে কি পাগল হয়ে গেছে নাকি বুঝতে পারলেন না। এমন সময় বড় বউ এলেন সেখানে। রূপা হককে দেখে শুচিত্রা বেগম বলে ওঠেন,“ বউ মা শামসে’র সাথে কি তোমার আবার ঝগড়া হয়েছে নাকি? ʼ
একটু ভড়কালেন রূপা হক,“ না মা, এমন কিছুই তো হয় নি। ʼ
কাজের কথা মাথায় এলো উনার বললেন,“ মা আজ হিমেলরা আসবে। ছেলেটার বিয়ে হয়েছে। তাই বললাম আজ আসতে। ʼ
মুখ বেঁকালেন শুচিত্রা। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“ ওই দুশ্চরিত্রটা এখানে এসে কি করবে? নাকি আমার নাতি নাতনিদেরও নিজের মতো হওয়ার পরামর্শ দেবে? ʼ
“ এভাবে বলবেন না মা। হিমেল আপনার ভাইয়ের নাতি হয়। ʼ
ভ্রু কুঁচকালেন শুচিত্রা বেগম,“ তো? সবাই আসতে পারলেও ওই হিমেল আর ওর বউকে আসতে বারণ করো নয়তো জুতোপেটা করবো ওদের। ʼ
উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন শুচিত্রা বেগম। ভুলে গেলেন ছেলের চিন্তার বিষয় সম্পর্কে।
মিটিং শেষে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন বাসনা আমান। মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ছেলের হেফাজতে রয়েছে। এ নিয়ে অভিযোগ না থাকলেও অন্তরের পরিবার থেকে নানা কথা শুনতে হয়েছে উনার। এতে উনার ইগোতে বড়সড় আঘাত হেনেছে। ছেলের ওপর ভীষণ রেগে আছেন। কাছে পেলে কয়েকটা থাপ্পড় দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। হঠাৎ ফোনে কল এলো উনার। অপরিচিত নাম্বার!
এটা উনার পার্সোনাল নাম্বার হওয়ায় গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কারোর পক্ষেই পাওয়া সম্ভব নয় এই নাম্বার। তবে এই সময় কে কল করলো। কল রিসিভ করলেন বাসনা আমান। ওপাশ হতে গমগমে আওয়াজে কেউ বলে ওঠে,“ আমি বলছি। ʼ
কণ্ঠ শুনে চিনতে কষ্ট হলো না বাসনা আমানের। কাঠকাঠ আওয়াজে বলে উঠলেন,“ বেয়াদব ছেলে। তোমাকে সামনে পেলে চড়িয়ে একদম মেরেই ফেলবো আমি। সাহস কি করে হয় আমার মান সম্মান নিয়ে খেলার? মরতে চাও? ʼ
বাহারাজ খুব একটা গুরুত্ব দিলো না এই মহিলার কথা। সেটা তার কথাতেই স্পষ্ট হলো, “আমার পেছনে লোক লাগানো বন্ধ করুন। ওভাবে মধ্যরাতে কাউকে খুন করে প্রিয় মানুষের চোখে ভয়ানক কেউ হতে চাই না। নেক্সট টাইম হতে এমন ভুল অবশ্যই নয়। ভুলে যাবেন না আমিও বাহারাজ দেওয়ান। ʼʼ
কল কেটে গেলো। বাসনা আমান স্থির চেয়ে রইলেন সামনে। উনার মুখ দেখে বোঝা গেলো না কি ভাবছেন।
এদিকে বাহারাজ সামনে চেয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে শায়ন। বাহারাজের ফোনে কল এলো। অভ্র কল করেছে। বাহারাজ কল রিসিভ করতেই অভ্র বলে ওঠে,“ দোস্ত পৌঁছে গেছি আমরা। ʼ
বাহারাজের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো শায়ন। দাত কেলিয়ে হেসে শায়নকে বললো,“ শালা নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা। বীথিকে কষ্ট দিস না কিন্তু। মেয়েটা এমনিতেই নাদুসনুদুস।ʼ
আরও অনেক কথা বলছে শায়ন। তবে বাহারাজের সেসবে মন নেই। সে তাকিয়ে আছে সামনে। কাউকে দেখছে।
_______________________
খুবই অদ্ভুত আর ভয়ানক একটি দিন। গাছের ডালে ডালে বসে থাকা পাখিগুলো গান গেয়ে গেয়ে নিজেদের জানান দিচ্ছে। রাস্তার পাশে কয়েকটা কুকুর একাধারে অবিরাম ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে। আর এদিকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ-কেও হার মানিয়ে একাধারে অপ্রয়োজনীয় সব কথাবার্তা বলে যাচ্ছে নকিব। জিনিয়া স্মরণের মাথায় পানির বোতল নিয়ে পানি ঢালছে। স্মরণের ১০০° জ্বর।
এদিকে নকিবের এমন ফালতু বকবকে অতিষ্ট হয়ে তুষার ধমকে বললো,“ ওই তুই চুপ থাক এবার। এখান থেকে যা। ʼ
জিনিয়া দাতে দাত পিষে বলে উঠলো,“ ওর কি কোনো আক্কেল আছে নাকি? শুধু বকবকই করতে পারে। চাপার জোড় আছে তো।ʼ
নকিব কটমট চোখে চাইলো জিনিয়ার দিকে। জিনিয়া চোখ রাঙালো। নয়ন স্মরণের মাথায় হাত রেখে বললো,“ দেখ দোস্ত তুই হয়তো রাতে ভুল দেখেছিস। এমনটা কিছুই নয়। আর… আর বাহারাজ ভাই অনেক ভালো মানুষ। দেখ তুই ওখানে প্রায় অনেকদিনই হলি কই তোর তো কোনো ক্ষতি হয় নি বল?ʼ
সিমানী মুখ ভেংচে বলে ওঠে,“ স্মরণের চোখে কি ছানি পড়েছে নাকি? যে ভুল দেখবে?ʼ
নকিব বেশ চিন্তিত গলায় বলে ওঠে,“ আচ্ছা ওই মেয়েটা কোথায় গেছে তাহলে? ওই বাসায় অনেক গরমিল আছে যা বুঝলাম। ʼ
জিনিয়াও তাল মেলালো,“ অনেক না প্রচুর।ʼ
নয়ন চিন্তিত হলো। তুষার বললো,“ তুই রুম ছেড়ে দে স্মরণ। আমরা আবার নতুন বাসা খুঁজে দেবো। ʼ
স্মরণ কোনো কথা বলছে না। আপাতত মাথা ঘুরছে তার। রাতে যা হলো! গা শিউরে ওঠার মতো অনুভুতি। তার শুধু কানে বাজছে বাহারাজের একটা কথা,
“ যা দেখেছো সব ভুলে যাও। এই বাহারাজ পুরো দুনিয়ার চোখে খারাপ, ভয়ানক হলেও তুমি নামক স্মরণের চোখে নিজেকে সুপুরুষ দেখতে চাই। তোমার ওই দুচোখে আমার জন্য ভয় নয় ভালোবাসা দেখতে চাই। ʼʼ
চলবে,…
- Junani CH