অটোপসি রিপোর্ট | ক্রাইম থ্রিলার উপন্যাস

 

_ক্যানভাসার

   সপ্তাহখানেক ধরে উত্তরের বাতাস বইছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। এখনো জেঁকে বসেনি যদিও, তবু শীত চলেই এসেছে প্রায়।

কাল রাত থেকে উৎসবের মন এলোমেলো।

পিবিআই থেকে সিআইডি তে বদলি হয়ে এসেছে সবে মাস দেড়েক। এরই মধ্যে তার মাথার চুল ছেড়ার দশা।

মাত্র একুশ বছর বয়সে অনার্সে থাকা অবস্থাতেই রাজনৈতিক লবিং নিয়ে এএসআই হিসেবে চাকরিতে জয়েন করেছিলো সে। যোগ্যতার দিক থেকে কিছুটা হয়তো পিছিয়ে ছিল, তা সে নিজেও জানে। চাকরি পেতে কিছুটা অনৈতিক কাজ সে করেনি তা সে নিজের মনের কাছে অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু চাকরির পাশাপাশি গ্রাজুয়েশন, তারপর এসআই তে প্রোমোশন থেকে পিবিআই হয়ে আজকে উৎসব মাহমুদ সিআইডি হেডকোয়ার্টারের একজন ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট, সময়টা প্রায় বিশ বছর পেরিয়েছে। সেদিনের সেই উচ্ছল দুরন্ত তরুন উৎসব এখন চল্লিশ ছুঁয়েছেন। আগের চাইতে অনেক পরিণত, শান্ত, ধীর এবং তুখোড় বুদ্ধিমান। চাকরির ফাঁকে সময় বের করে তাকে সপ্তাহে দুদিন সাইকোলজির ক্লাস নিতে যেতে হয়। একা মানুষ, কোন পিছুটান নেই। সব কিছু ভালোই চলছিলো। 

বারান্দা থেকে স্টাডিতে ঢোকার সময় আনমনে চোখ বুলিয়ে দেখে দেয়ালে সাজানো দুডজন পদকের দিকে। এসব নিয়ে তার গর্ব হতো খুব।

ঝামেলা বেধেছে গতমাসে, সিআইডিতে জয়েন করার তিন দিন পরেই। গর্ব ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে তার গত দেড়মাস ধরে।

   প্রথম লাশটা পাওয়া যায় টঙ্গীর তুরাগ নদীর পাড়ে। বিকৃত ভাবে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে পুরো শরীর। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী কাঁধ থেকে হাতের আঙুল, হাঁটু থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত শরীরের তিরিশটা জয়েন্ট এক এক করে ভাঙা হয়েছে, তারপর স্পাইনাল কর্ড, সবশেষে ভারী কিছু দিয়ে খুলিটা গুড়িয়ে দিয়ে লাশটা পোড়ানো হয়েছে দীর্ঘক্ষণ।

সেই লাশের অটোপসি রিপোর্ট যখন উৎসবের হাতে পৌছে তার মিনিট পাঁচেক পর একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে তার ফোনে। ট্রু কলার বলছে নাম্বারটা আয়ারল্যান্ডের। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেঘের গর্জনের মতো গম্ভীর অথচ শান্ত ভাবে একটা কন্ঠ বলে ওঠে,

 

– লাশের পরিচয় খুঁজে পাবেন না। স্কালের শেপ জোড়া দিয়ে চেহারা উদ্ধার সম্ভব না তা তো জানেনই। ডিএনএ সার্চ করেও কোন হসপিটাল বা থানা থেকে পরিচয় উদ্ধার সম্ভব নয়।

– তাহলে কি করতে বলেন? উৎসব শান্ত কন্ঠেই বলে।

– আপনার বুদ্ধির পরীক্ষা করতে চাইছি। তবে এতোটা কাঁচা আপনি নন, ঠিকই বের করে ফেলবেন জানি, তাই আপনার জন্যে কাজটা একটু কঠিন করতে চাচ্ছি। এতো সহজ রহস্য আপনার ঐ ব্রেনের জন্যে অসম্মান হবে।

কলটা কেটে যাবার পরেও দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড ফোন কানে লাগিয়ে রাখে উৎসব।

   এরপর থেকে ঝামেলার শুরু। গত দেড় মাসে আরো চারটা লাশ পাওয়া গেছে। প্রতিটাই বীভৎস ভাবে খুন, কোনটারই শনাক্ত করার উপায় রাখা হয়নি।

সিগারেটের শেষাংশে লম্বা একটা টান দিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল আর মধ্যমার মাঝে একটা টোকা দিলো উৎসব, বারো ফিট দূরে বারান্দার গ্রিল। কোথাও বাঁধা না পেয়ে গ্রিলের ছোট ছোট ফাঁক দিয়ে বাইরে চলে গেলো সেটা, তার মানে মন আর মস্তিষ্ক শান্ত আছে তার, মনোযোগের হেরফের নেই। নিজেকে উৎসব ভালোভাবেই চেনে।

   স্টাডিতে ফিরে টেবিলে বিছানো আছে দশ ফিট বাই বারো ফিট ঢাকা বিভাগের ম্যাপ। কয়েকটা রঙিন পেন্সিল নিয়ে বসলো সে। ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে তার প্রতিটা নিউরন সেল জুড়ে। সূত্র গুলো সহজ ছিল। কিন্তু মনোযোগের অভাবে কাজ করতে পারছিলো না সে। কয়েকটা সরল রেখা মুছে নতুন কয়েকটা আঁকলো। 

সব শেষে ম্যাপটা দেয়ালে ঝুলিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিছুক্ষন নিরীক্ষণ শেষে ফোনটা হাতে তুলে কল করলো হেডকোয়ার্টারে।

– স্যার, সাঈদ বলছি।

– মামুন কোথায়? জানতে চাইলো উৎসব

– মামুন ভাই একটু কাস্টমসে গেছেন।

– টিমের সবাইকে ডাকো। আমি এক ঘন্টার মধ্যে আসছি।

কল কেটে দিয়ে কোমরে নিজের পুরো ক্যারিয়ারের একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গীকে গুঁজে বেরিয়ে গেলো উৎসব।

 

   বিশাল বড় কনফারেন্স রুমটায় স্বল্প আলোর চারটা বাতি জ্বলছে। মোহনীয় আবছা নীল আলো-আধারী খেলা করছে পুরো রুম জুড়ে। টেবিল জুড়ে বাইশটা চেয়ারে কালো স্যুট পরিহিত বাইশজন বিভিন্ন বয়সী কঠোর চেহারার পুরুষ, কারো মুখেই কোন অভিব্যক্তি নেই। কঠিনতম পরিস্থিতিতেও এরা শান্ত থেকে অভ্যস্ত। রুমের এক প্রান্তে দেয়াল জুড়ে উজ্জ্বল মনিটরে শোভা পাচ্ছে ঢাকা বিভাগের মানচিত্র। সেখানে ছয় জায়গায় লাল ডট চিহ্ন।

– তার মানে আপনি বলতে চাইছেন পরবর্তী লাশটা মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর ব্রিজের আশেপাশে পাওয়া যাবে?

– জ্বি।

– ব্যাখ্যা করুন উৎসব সাহেব।

– এ পর্যন্ত পাওয়া পাঁচটা লাশের প্রতিটাই কোন না কোন নদী বন্দর বা ঘাট এলাকায় পাওয়া গেছে। ম্যাপে লক্ষ্য করে দেখুন, এখানে একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে ইংরেজি E বর্ণের মতো। এখানে E এর মাঝের বিন্দুটা যদি আমরা ধরতে যাই তাহলে মুক্তারপুর ছাড়া অন্য কোন পয়েন্ট নেই।

– আর কিছু?

– প্রতিটা লাশ পাওয়া গেছে সপ্তাহের শেষে, ছুটির দিনে। তারমানে খুনি লাশটা ফেলে দিচ্ছে বৃহস্পতিবার শেষ রাতের দিকে। কোন লাশই পচে ভেসে ওঠেনি, এর মানে লাশ গুলো কয়েকদিন আগের ফেলে যাওয়া নয়। সদ্য ফেলে যাওয়া।

– সূত্র একটা মিলিছে বটে কিন্তু আপনার এই থিওরী যৌক্তিক হলেও এতে অনেক ত্রুটি আছে মিস্টার উৎসব।

– সেটা আমিও জানি। কিন্তু যেখানে কোন সিসিক্যামেরার ফুটেজে কিছু মিলছে না, কোন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যাচ্ছে না সেখানে আমরা হাত গুটিয়ে বসে না থেকে অন্তত এই সূত্রটা ধরে আগাতে পারি।

– ঠিক আছে। আমরা নজরদারীর ব্যাবস্থা করছি। অবশ্যই এটা একটা রেড এলার্ট। আপনি নিজে নিশ্চয়ই অপারেশনে উপস্থিত থাকতে চান?

– জ্বি অবশ্যই।

– তাহলে কাজে নেমে পড়া যাক।

 

কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকলো উৎসব। খোঁজ নিলো তাকে আয়ারল্যান্ড এর নাম্বার থেকে যে কল টা করা হয়েছিলো সেটার অগ্রগতি কদ্দুর। কমিউনিকেশন সেকশন থেকে জানানো হলো কলটা স্পামার কল ছিল। আয়ারল্যান্ডের একটা ফোন বুথ পেয়েছে ত্তারা, সেখান থেকে ট্রেস করে আমেরিকা, মেক্সিকো, রাশিয়া, তাইওয়ান ঘুরে ফিলিপাইনে গিয়ে শেষ হয়েছে। ফিলিপাইনের পুলিশের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে নাম্বারটা এক মৃত চাষীর। 

চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো উৎসবের, এমনই হবে সে জানতো।

   আজ বুধবার, টিম নিয়ে আজ সকালেই মুক্তারপুর চলে এসেছে উৎসব। লোকাল পুলিশ আর ইনফর্মার মিলে প্রখর নজরদারী চালাচ্ছে চারদিক। দুপুর তিনটা থেকে মুক্তারপুর ব্রিজের এপার ওপার আর নদীর দুদিকের চার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে মাছ ধরা নৌকায় জেলের ছদ্মবেশে আছে তারা, মোট আটটা নৌকায়।

   বৃহস্পতিবার রাত, ঘড়ির কাঁটা বলছে এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট হতে চললো প্রায়। গত বত্রিশ ঘন্টা ধরে দশটা জেলে নৌকা একই ভাবে ঘুরাঘুরি করছে মুক্তারপুর ব্রিজের নিচ থেকে আশেপাশের চার – পাঁচ কিলোমিটার নদী জুড়ে। নৌকায় মাছ কিছু উঠছে কি উঠছে না সেদিকে অলস মাঝিদের কোন খেয়াল না থাকলেও চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের সাথে আছে এক সাংবাদিক, নদীর চারপাশের ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফী করছে সে। আপাত দৃষ্টিতে তার হাতে ক্যামেরা মনে হলেও ওটা আসলে একটা নাইট ভিশন লেন্স লাগানো মডিফায়েড ডিস্ট্যান্স ভিউ ফাইন্ডার যা একই সাথে হাইলি সফিসটিকেটেড বাইনোকুলারও বটে।

এমন সময় একটা কল আসলো সাংবাদিকের মুঠোফোনে। অদ্ভুত সিরিয়ালের নাম্বার, ট্রু কলারে কোন আইডেনটিটি দেখাচ্ছে না। দুবার রিং হতেই সাংবাদিক কল রিসিভ করলো।

ওপাশ থেকে শোনা গেলো একটা শান্ত ভরাট কন্ঠস্বর,

– রাত তো অনেক হলো মনোবিদ সাহেব। ঘুমাবেন না?

– খুব মিস করছিলেন বোধহয় আমাকে?

– আপনাকে বেশ বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম। এই বয়সেই বুদ্ধিতে জং ধরে গেলে চলবে? আমার সামান্য মনটা বুঝতে পারলেন না! আফসোস!

– এত রাতে আমার বুদ্ধির সমালোচনা করতেই কল করেছেন বুঝি?

– নাহ, একটা বিষয়ে পরামর্শের জন্যে।

– বলেই দেখুন, আমার স্বল্প বুদ্ধিতে সাহায্য করার চেষ্টা করবো অবশ্যই। আফটার অল আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী বলে কথা!

– হাহাহা, ভালো বলেছেন, আচ্ছা বলুন তো, ভালো জংলা মাঠ কোথায় পাওয়া যাবে?

– হুট করে মাঠের খবর নিচ্ছেন?

– অনেক তো নদীতে, বন্দরে ঘুরলাম, এবার ভাবছি একটু মাঠে প্রান্তরে ঘুরলে মন্দ হয় না। কি বলেন?

   উৎসবের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। ওপাশ থেকে ততক্ষণে কলটা কেটে গিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *