মেঘবালিকা | ভালোবাসার গল্প

 

” দেখি বউ,  হা করো”

আজকে আইড় মাছ কষিয়ে তাতে ছোট ছোট চেরি টমেটো আর বেশি করে দেশি কাঁচামরিচ ছেড়ে ঝাল করে রান্না করেছে জয়নাল মিয়া।

তার তুলে দেওয়া ভাতের দলা মুখে নিয়ে স্ত্রী বলে,  ” এত স্বাদের তরকারিতে একটু ধইন্যা পাতাও ছাইড়া দিতেন। দিলেন না ক্যান?”

” ঝুমঝুমির বাতাসা কিনতে গিয়া টাকায় টান পড়ছে।”

কথা শুনে স্ত্রী খিলখিল করে হাসতে থাকে। 

” এত হাইসো না। ভাত গিয়া তালুত ঠেকবো।” বিরক্ত হয়ে তাকে থামাতে চায় জয়নাল। 

জয়নালের স্ত্রীর সারা শরীর অবশ। আধশোয়া হয়ে কেবল কথা বলতে পারে।  

আগে অটো চালালেও কিছুদিন ধরে জয়নাল অবস্থাপন্ন এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে ফুট-ফরমায়েশ খাটা থেকে শুরু করে দাড়োয়ানের কাজ করে।  ঝুমঝুমি, সেই বাড়ির একমাত্র মেয়ে, সবার নয়নের মণি, রাজকন্যা। 

ঝুমঝুমি, জয়নালকে চাচ্চু ডাকে। পিঠে উঠে ঘোড়া চড়ায়। কাঁধে উঠে  বাইরে বেড়াতে যায়। জয়নাল লেখাপড়া জানে না। ঝুমঝুমি তাকে মাঝে মধ্যে ইংরেজিতে এ বি সি ডি ও শেখায়।

জয়নাল আজকাল প্রায় সারাক্ষণ উৎফুল্ল হয়ে  ঝুমঝুমির কথা বলে।

” এই ছোট বাচ্চা,

তার বুদ্ধি যদি দেখো!

তার মধ্যের সাহস যদি দেখো! তেলাপোকা উড়তে দেখলে খুশিতে সে হাততালি দেয়, ভাবা যায়?

পাঁচ টাকার বাতাসা কিন্যা বইসা বইসা খাইতেছিলাম। যেই না শ্যাষটা মুখে দিছি অম্নে কোথা থেকে দৌঁড়ায় আইসা কয়, ‘তুমি কি খাও?’

আমি তো আর মুখ থিকা বাইর কইরা তারে দিতে পারি না! 

একা একা খাইতেসি!

এতো খারাপ লাগলো!

দিলাম থুক কইরা ফালাইয়া। কইলাম, ‘বাতাসা’।  সে বকা দিয়া কইলো, ” ধুর বুদ্ধু, বাতাস কি খাওয়া যায়? বাতাস কি রান্না করা যায়? বাতাস তো বেলুনে থাকে শুধু। বাতাস তাহলে কিভাবে খায়?’ 

এইটুক মানুষ,  কত হাসি তামশার কথাও জানে! শুইনা তো আমি অবাক!

এইজন্য কালকে তাকে বাতাসা চিনাবো। 

বাতাস নাকি বেলুনে থাকে শুধু! 

হাহাহা! 

হাহাহাহোহো! “

হাসি যেন আর থামেই না।

স্ত্রীও খুশি মনে , জয়নালের এই  অপ্রকৃতস্থ হাসির দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে তাকিয়ে তার কান্না পায়।

আরেকদিন ঝুমঝুমির জন্মদিন উপলক্ষে বিরাট আয়োজন করা হলো। জয়নালকেও দাওয়াত দেওয়া হলো। বিরাট সব বক্স ভর্তি খাবার দাবার দুহাত ভরে এনে

সাজিয়ে রাখতে রাখতে সে স্ত্রীকে  বললো, 

” বুঝলা বউ, সে কি বড়ো বড়ো ঝাঁড়বাতি! চোখে ধাঁধা লেগে যায়। 

কয়টা বাতি দিয়া একটা ঝাঁড়বাতি বানায় কে জানে! কেমনে এত ঝিলমিল করে  কও দেখি! আরো কত কিছু দিয়া যে ঘর সাজাইছে আজকে! 

তুমি আমি নামও জানি না।

বোতলে চাপ দিলে  ভিতর থিকা মেঘের মতো দলা দলা পড়ে! 

এতো এতো আলো, ফুল, বেলুনের মধ্যে বাচ্চাটারে ঠিক একটা পরীর বাচ্চার মতো লাগতেছিলো, 

তুমি যদি খালি দেখতা।

ঢোকার পর স্যার নিজে আইসা আমারে সোফার এক পাশে বসতে কইলো। খাওয়ার সিস্টেম বুফে।

বুফে তো বুঝোনা? 

এই ইয়া ইয়া পাতিলে খাবার সারি ধরে মেলা থাকবে। সেখান থেকে যত ইচ্ছা নিয়া নিয়া খাবা।”

” ওমা! সত্যি নাকি? 

নিজের হাতে নিয়া নিয়া 

যত ইচ্ছা খাবো?! “

” হ। তয়, আমি কিন্তু  প্রথমে লজ্জায় কিছু নিতেই পারতাছিলাম না।

তাই দেইখা, ম্যাডাম নিজে আইসা কইলো,

‘জয়নাল ভাই, যা ভালো লাগে তাই নিয়ে প্লেট ভরে আরাম করে খান, সব খাবেন, কেমন? “

” ম্যাডাম তাইলে সত্যিই  অনেক ভালো মানুষ! ” হাসতে হাসতে বলে জয়নালের স্ত্রী। 

বউকে হাসতে দেখলে বড়ো শান্তি শান্তি লাগে জয়নালের। বুক পকেট থেকে ঝুমঝুমির একটা  ছবি বের করে তার সামনে ধরে সে। 

ছবিটা দেখতে দেখতে  চোখের তৃষ্ণা উপচে পড়ে স্ত্রীর। 

“মাইয়াডা আসলেই টুসটুইসা ডালিমের মতো! 

আর, দেখেন, তাকানোর ভংগিমাডা!

পুরাই আপনের মতো! 

অনেক কিন্তু মিল পাইতেছি আমি।” স্বামীকে খুশি করতে সামান্য মিথ্যে বলে সে।

 ” তাই নাকি! কও কি!” 

 অবাক দৃষ্টি মেলে আবার ছবির দিকে  তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে জয়নাল।

এই সব সময়ে তার স্ত্রীর কলিজাটা, বোবাকষ্টে  একেবারে মুচড়ে যায়,  বারবার মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে শেষ পর্যন্ত পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার দুর্ভোগে।

কেউ খাইয়ে না দিলে বিষ খাওয়ারও যোগ্যতা নেই তার। আবার, ওইদিকে হাসিমুখে জয়নাল  তার এতো যত্ন করে যে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে বিষ চাইতেও লজ্জা করে সত্যি!

সে কি নিদারুণ অভাগা নাকি অতুলনীয় ভাগ্যবতী- একমাত্র জয়নালের কারণে প্রায়শই এই দোটানার দ্বন্দ্বে ভোগে সে।

তারপর, হঠাত একদিন খুব মন খারাপ করে জয়নাল বাড়ি ফিরে আসে । সেদিন আরেকটুর  জন্যে ঝুমঝুমি নাকি তার হাতে মারাই যাচ্ছিলো!

জাম খাওয়াতে গিয়ে বিচি শ্বাস নালীতে আটকে গিয়ে। 

অবশ্য, স্যার যে রাগ করে একটা চড়ও মেরে দিয়েছেন, সেকথা সে স্ত্রীর কাছে গোপন করে গেল।

” এইটা কোন কথা! আপ্নে খেয়াল করবেন না? ” বউ বললো। 

জয়নাল সিদ্ধান্ত নিলো, সে আর কাজে যাবে না। খুব বেশি মায়ায় পরে গেছে সে বাচ্চা মেয়েটির। 

বিচি গলায় আটকে যাবার পরে সে নিজেও ভীষণ  ভয় পেয়েছিলো! 

আসলে কোনকিছুই বেশি বেশি ভালো না। বেশি মায়াও না।

সে রাতে, রাঁধতে গিয়ে সে ভাত পুড়িয়ে ফেললো। খাবার সময় চিন্তায় চিন্তায় একটুও লবণ ছাড়া আলু ভর্তা আর ডাল খুব স্বাভাবিকভাবে খেলো। 

তবে, সত্যিই সে আর কাজে গেল না। বাড়তি কথা বলাও বন্ধ করে দিলো। 

এসব দেখে জয়নালের স্ত্রী মনে মনে প্রমাদ গুণলেও কেবল দেখে যাওয়া ছাড়া তারও করার কিছু রইলো না।

সপ্তাহ দুই পরে ঝিরঝিরে এক সন্ধ্যায় ঘরে একটা বাচ্চা মেয়ের কন্ঠ শুনে জয়নালের স্ত্রী 

হঠাৎ ঘুমের ঘোরে থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো।

তাকিয়ে দেখে, ঝুমঝুমি ঘরময় নেচে বেড়াচ্ছে।

মেয়েটিকে কাছে ডেকে প্রচন্ড বুকে টেনে নিতে ইচ্ছে করলো জয়নালের স্ত্রীর। 

“জয়নাল ভাই কোথায়?” 

ওকে জিজ্ঞেস করলো মেয়েটির মা।

” এই তাহলে সেই ভালো মানুষ ম্যাডাম! ” ভাবলো সে। 

বললো,  

” আপা আপনাকে  কোথায় যে বসতে দেই?! কষ্ট করে ওই চেয়ার টেনে  বসতে পারেন কি? আমাদের ঘরে তো আসলে তেমন কিছুই নাই।

নাইলে বিছানায়ও বসতে পারেন..

পরিস্কার চাদর গতকাল বিছানো হয়েছে।  “

“আরে না না। আপনার কিছু করতে হবে না। কখন ফিরবে বলেছে?”

“সে যে কোথায় গেছে, সেটাই তো আমাকে বলে যায় নাই। কাউকে ডেকে খোঁজ করতে বলবো, আমার সেই উপায়ও নাই।”

” এই কাগজটা আপনি তাহলে  রাখেন। এই, যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, এই বাড়ির দলিল। 

ঝুমঝুমির বাবা এটা কিনে জয়নাল ভাইকে উপহার দিয়েছে। “

” কেন আপা! কেন? হঠাৎ? বাড়ি? ওমা! “

বিষ্ময়াভূত চোখে থতমত খেয়ে বলে উঠে জয়নালের স্ত্রী। 

” কেন নয় বলুন? আপনার স্বামী আমার মেয়ের গত জন্মদিনে একটা খামে ভরে তার পুরো একমাসের বেতন উপহার দিয়ে এসেছিলো। 

তখনই আমরা ভেবেছিলাম,  চলে যাওয়ার আগে উনার জন্য আমরা কিছু একটা করবো।”

” চলে যাবেন?

কোথায় চলে যাবেন আপা?”

” আসলে আজ রাতেই আমাদের ফ্লাইট।  সব কিছু বিক্রির ব্যবস্থা  করে দিয়ে আমরা কানাডা  সেটেল হয়ে যাচ্ছি। জয়নাল ভাইকে কয়েকবার আসতে বলার পরেও এলেন না দেখে বাধ্য হয়ে আমিই তাই এলাম।”

জয়নালের স্ত্রী এই কথা শুনে ঝুমঝুমিকে চোখে হারাতে শুরু করল। তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, 

” মারে, তুমি কি একটু আমার কাছে আসবা? একটু আদর করে দেই?”

ঝুমঝুমি কাছে এগিয়ে নিজেই ওর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে শেষ কথাটি বলে গেল,  

“বাই আন্টি”

এদিক সেদিক ঘুরে, টুকটাক কাজ করে ফিরতে ফিরতে সেদিন অনেক রাত হয়ে গেল  জয়নালেরও ।

তবে, স্ত্রীর মুখে ঘটনা শোনামাত্র, তাকে দেখা গেল, কোন কথা না বলে এক দৌঁড়ে শাঁই করে রকেটের গতিতে বেরিয়ে যেতে।

ওদিকে জানালার পাশে সেদিনও উঠে বসে ছিলো  হলদে পুরনো চাঁদটি।

যে চাঁদের গায়ে, বিবর্ণ  স্ত্রীটি কোন এক নিস্পাপ নবজাতকের চেহারা কল্পনায় আঁকিবুঁকি করে রোজ

একটু একটু  বেঁচে থাকে।

কিন্তু, আজ তাকেও দেখা গেল,

বিছানায় শুয়ে শুয়ে

চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে। 

কেন!

জয়নাল যদিও তাকে কোনদিনও 

বলে নাই, কিন্তু সে ঠিকই জানে,

শেষবারে প্রসবের পর তার কোল জুড়ে  এসেছিলো ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান । 

মৃত নয়, জীবিত। 

যাকে এক দালালের মাধ্যমে নি:সন্তান কোন এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে সেই টাকায়  তার চিকিৎসা করিয়ে, জয়নাল তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলো। 

ঝুমঝুমিদের বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই জয়নাল  দেখতে পেল, রাস্তায় ওদের গাড়িটাকে। 

জয়নাল প্রাণপণে চিৎকার করে বারবার ডাকলো,  “ঝুমঝুমি….ঝুমঝুমি… “

গাড়ির ভেতর থেকে কেউই সেই ডাক শুনলো না।

কেউ পিছনে ফিরেও দেখল না। 

ফিরে দেখলে  হয়তো অবাক হয়ে ভাবতো, জয়নালের মতো ভাংগাচোরা দুর্বল একজন মানুষ , কেমন করে আজ হঠাৎ গাড়ির ইঞ্জিনের সাথে পাল্লা দিয়ে 

চিতাবাঘের মতো ক্ষ্রিপ্ত গতিতে দৌঁড়াচ্ছে !?

.

……. “সমাপ্ত”…….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *