চুমকির চিকন একটা শরীর। লম্বা লম্বা হাত পায়ে মাংস নেই বললেই চলে। কিন্তু, চিকন চুমকির পেটটা উঁচু হয়ে আছে! ৭ মাস চলছে ওর, দিনদিন পেটটা বেঢপ আকৃতির হচ্ছে।
এই চিকন শরীরে এই উঁচু পেট বেমানান লাগে। তারচেয়ে বড় কথা, এতটুকুন শরীর এই পেটের ভার সইতে পারে না। কিন্তু চুমকি সয়ে যায়। শুধু কি সয়? এই উঁচু পেট নিয়ে কতো কাজ করে রোজ!
চুমকির স্বামীর নাম রকি। ৩ বছর আগের কথা, কোনো এক ফেব্রুয়ারির দিনে নায়কের মতো আবির্ভাব হয়েছিল সে চুমকির জীবনে। চুমকি তার ছোটবোন রুমকির সাথে বাজারে এসেছিল। রুমকি হঠাৎ বায়না ধরল পিয়াজু খাবে। সে বায়না মেটাতে ফুটপাতের ভাজাপোড়া দোকানটায় গেলো ওরা। সেই দোকানেই কাজ করতো রকি। সেখানেই কি যে হলো চোখে চোখে!
ঐ যে, একটা গান আছে না, চোখ যে মনের কথা বলে? অমনই কথা হয়েছিল ওদের। চোখে চোখে কথা হলো, কিছুদিন প্রেম চলল। তারপর ওরা গাঁটছড়া বাঁধল। রকি নিজেই একটা ভাজাপোড়ার দোকান দিলো রেলগেটের পাশে। চুমকি হলো সে দোকানের সহকারী। চুমকি একটু পড়াশোনা করেছিল কিনা, তাই ও হলো ম্যানেজার! চুমকি খাবার দেয় কাস্টমারদের, প্লেট ধুয়ে রাখে, টিস্যু পেপার দেয়, পানির বোতল দেয় আর হিসেব করে টাকা বুঝে নেয়।
আর রকি? সে একের পর এক পিয়াজু ভাজতে থাকে, বেগুনি ভাজতে থাকে, জারকা, সিঙ্গারা, আলুর চাপ ভাজতে থাকে। গরম উত্তপ্ত তেলে চলতে থাকে ওদের সংসার। এদিকে চুমকির পেট বড় হতে থাকে। চিকন শরীরের মেয়েটার পেট জানান দেয়, তাঁদের ভালোবাসার পূর্ণতা আসতে যাচ্ছে।
রাতে ঘুমানোর আগে চুমকির পেটে আলতো করে হাত রাখে রকি। রকির খুব ইচ্ছে, একটা মেয়ে বাচ্চা হোক।
‘আমগো একটা মাইয়া হইবো। আমি নাম ঠিক কইরা রাখছি। ‘
রকির কথায় চুমকি হাসে। বলে, ‘কি নাম রাখছো হুনি?
রকির মাইয়ার নাম হইব রুমঝুম। ওরে আমি নুপুর কিইনা দিমু, ও নাইচা নাইচা বেড়াইব।’ বলতে বলতে হাসে রকি। রকির চোখে আনন্দ দেখা যায়। সে আনন্দ নিখাঁদ, কোনো কৃত্রিমতা নেই সেখানে।
‘আর যদি পোলা হয়? তহন কি করবা হুনি?’ চুমকির একটা ছেলের শখ। সেকথাই জানান দেয় যেন।
‘কি করমু আবার? খুশি হমু। আমগো ছৈইল হইব। এইডাই হইলো খুশির কথা। পোলা হইল না মাইয়া হইল তাতে কিছু যায় আহে না।’ বলে রকি।
‘পোলা হইলে কি নাম রাখবা তাই শুনবার চাইছি।’ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে চুমকি।
‘তোমার তো পোলার শখ। পোলার নাম তুমিই ঠিক কইরা রাইখো।’ বলে রকি হাসে।
তারপর তাঁদের মাঝে আরো গুটুর গুটুর কথা হয়। কথায় কথায় মতবিরোধ হয়, ছোট ছোট ঝগড়া হয়। আবার দুজনেই খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে হাসির শব্দ যেন বাইরে না যায় তাই চুমকির মুখ চেপে ধরে রকি। চুমকির তাতে আরো বেশি করে হাসি পায়। কী অদ্ভুত!
ক্লান্ত রকি কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যায় একসময়। ঘুম আসে না চুমকির। ঘুমিয়ে যাওয়া রকির একটা হাত আলতো করে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমকি। তারপর ভাবতে থাকে, ছেলে হলে কি নাম রাখবে সে।
৭ মাস থেকে ৮ মাস হয়ে যায়। পেট বড় হতে থাকে চুমকির। সমস্যা বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। দোকানে থাকা খুবই কষ্টকর হয়ে যায় দিনদিন। দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিছুক্ষণ পরপরই বসতে হয়। পরক্ষণেই আবার দাঁড়াতে হয়। ফুটপাতের দোকানে বসে থাকার জো আছে?
একদিন রকি বলে, ‘কাল থাইকা তোমারে আর দোকানে যাওন লাগবো না। তুমি বাসায় থাইকো। আমি সব সামলামু দোকানে।’
চুমকি মুচকি হাসে। জানে, দোকান একা সামলানো কোনোমতেই সম্ভব হবে না রকির। ওকে যেতেই হবে দোকানে।
না, চুমকিকে আর দোকানে যেতে হয় না। রকি একটা ছেলে রাখে দোকানে। দিন ৩০০ করে দিতে হবে তাকে।
‘তুমি আমারে না জানাইয়া লোক নিছো কেন দোকানের?’ রেগে গিয়ে বলে চুমকি।
‘তোমার ভালামন্দ দেখতে হইব না আমার? তুমি এহন বাড়িত থাকবা। অনেক কষ্ট করছো। আর না।’ অপরাধীর কণ্ঠে বলে রকি।
‘রোজ যে ৩০০ টাকা দিতে হইব ছেলেটারে। তাইলে আমগো থাকবো কি?’ চুমকি টাকা জমাচ্ছিল রোজ। সেটা আর হবে না ভেবেই কষ্টে চোখ ভিজে আসে ওর। চুমকি জানে, ওর এই শুকনো শরীর বাচ্চা হবার সময় সইবে না। মেডিকেল যেতে হবে। টাকা পাবে কোথায় তখন!
রকি সান্ত্বনা দেয় চুমকিকে, ‘তুমি চিন্তা কইরো না তো। যতো টাকা লাগে আমি ম্যানেজ করমু। তুমি এহন বিশ্রাম নাও। সবকিছু ভালায় ভালায় হইয়া যাক।’
তারপর, চুমকি আর দোকানে যায় না। তাঁর ছোট্ট খুপরিতে বসে থাকে। রান্না করে, কাঁথা সেলাই করে। মাঝে মাঝে আনমনে ভাবে, ছেলে হলে কি নাম রাখবে তার।
আর রকি, সে দোকান করে। গরম তেলে ভাজে সিঙ্গারা, পিয়াজু, বেগুনি, আলুরচপ। ঘেমে একাকার হয়ে যায় গরমে, পরিশ্রমে। তবু তার দম ফেলার সময় হয় না। ওকে টাকা জমাতে হবে যে! চুমকির মেডিকেল খরচ জোগাতে হবে যে!
এমন-ই এক ক্লান্তিতে যখন ঘেমে একাকার হয়ে ছিলো রকি, তখনই খবর নিয়ে আসে রুমকি, চুমকির ছোটবোন। খারাপ খবর, প্রচণ্ডরকম খারাপ খবর নিয়ে আসে সে। গলা শুকিয়ে যায় রকির, গলায় যেন পাথর বাঁধা পরে। হাত থেকে পরে যায় তেলে ভাজার খুন্তি। সে কোনোরকমে শুধু জিজ্ঞেস করে, “চুমকি ঠিক আছে তো?”
সরকারি মেডিকেল কলেজের বড় একটা ওয়ার্ড। চারদিকে মানুষে থৈথৈ করছে। মা ও শিশু ওয়ার্ড কিনা, প্রায় প্রতিটা সময়ই কোনো না কোনো বাচ্চা কান্না করছে।
ভাগ্য ভালো চুমকির, একটা বেড পেয়ে গেছে সে। বিছানায় আলতো হেলান দিয়ে বসেছে সে। পাশেই চেয়ারে বসে বেডে মাথা রেখে ঝিমাচ্ছে রকি। গতকাল ঐ যে মেডিকেল নিয়ে আসলো, তখন থেকেই হাসপাতালে সে। বাসায় ফিরেনি, দোকান খুলেনি। এমনকি খাওয়া দাওয়াও ঠিক মতো করেনি।
গতকাল বিকেলে, হঠাৎ কি হয়েছিল কে জানে। চুমকি মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিল। তারপরে কি হয়েছে চুমকির কিছুই মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তার, নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পায়। রকি অবশ্য তাকে বলেছে যে সেরকম কিছুই হয়নি। আজ অথবা কাল বাড়ি ফিরে যাবে আবার।
চুমকির প্রচণ্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছে রকির সাথে। কিন্তু রকির ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্ত সেটাও সম্ভব না। চুমকি জানে, মাথায় হাত রাখা মাত্রই রকি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করবে, ‘ ব্যথা করছে? কিছু লাগবে? কিছু বলবা? খারাপ লাগছে? কিছু খাইবা?’
যতবারই চুমকি নড়ে ওঠেছে, রকি লাগাতার এসব প্রশ্ন করেছে। চুমকি রকির কাণ্ড দেখে মুচকি হাসে। মনে মনে বলে, ‘লোকটা পাগল হই গেছে মনে হয়।’
রকির ঝিমানো ঘুম ভাঙে, কারণ ডাক্তার এসেছে। ডাক্তার চুমকির রিপোর্ট গুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন রুমকি ম্যাম?’
‘এখন একটু ভালা আছি স্যার।’ একটু নড়েচড়ে বসে চুমকি। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর দেয়।
‘ভালো থাকলেই তো ভালো। আরো ভালো একটা খবর দেই। আপনার মেয়ে সন্তান হতে যাচ্ছে। এতোক্ষণ ইচ্ছে করেই জানাইনি। সরি।’
রকি, চুমকি দুজনেই খুশি হয়ে ওঠে। দুজনের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
আবার ডাক্তার বলে ওঠেন, ‘আচ্ছা, শরীরের এতো অযত্ন নিয়েছেন কেনো বলুন তো? শরীরে কিছুই নেই আপনার। ভালো মন্দ পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এখন। বুঝেছেন?’
‘ছোটবেলা থাইকায় আমার খাওয়ার রুচি কম, স্যার। খাইতে মন চায় না।’
‘মন না চাইলেও খেতে হবে এখন। বাচ্চার জন্য খেতেই হবে। এখন থেকে ফলমূল, পুষ্টিকর খাবার খাবেন বেশি করে।’
‘আইচ্ছা স্যার।’ বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে চুমকি, প্রচুর ফলমূল, মাছ মাংস খাবে এখন থেকে।
ডাক্তার এবার রকির দিকে ফিরেন। ‘আপনি একটু আমার সাথে আসুন। কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, নিয়ে আসবেন।’
ডাক্তারের পিছু পিছু চেম্বারে ঢুকে রকি। ডাক্তার সোজা গিয়ে তাঁর চেয়ারে বসেন। তারপর রকিকেও বসতে বলেন। রকি বুঝে, ওষুধ লিখে দেয়ার জন্য তাঁকে ডাকা হয়নি। ডাক্তার কিছু বলবেন। যা বলবেন, তা চুমকিকে জানাতে চাচ্ছেন না। সেকারণেই তাকে এখানে ডেকেছেন।
‘আপনার স্ত্রীর বয়স কতো?’ কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার।
অপরাধী কণ্ঠে রকি উত্তর দেয়, ‘১৭ বছর হবে স্যার।’
‘১৭! আমার তো মনে হয় বয়স আরো কম হবে। যা হোক, আপনার স্ত্রী খুবই রোগা। শরীরে পুষ্টির ঘাটতি আছে। সেকারণেই গতকাল মাথা ঘুরে পড়ে গেছে সে। আপনাদের ভাগ্য ভালো, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেও সেরকম ক্ষতি হয়নি বাচ্চার। কিন্তু!’ বলেই থামেন ডাক্তার।
‘কিন্তু কি স্যার?’
‘আপনার স্ত্রীর শরীরে যথেষ্ট বাজেভাবে আঘাত পেয়েছে। তাকে যথেষ্ট পরিমাণে যত্ন নিতে হবে এখন। পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। নয়তো, বাচ্চা হবার সময় আপনাকে আমার এভাবে বলতে হতে পারে, ‘ মাকে বাচাতে চান নাকি বাচ্চাকে?’ বলে থামেন ডাক্তার।
রকির কথাগুলো বিশ্বাস হয় না। এরকম ঘটনা দেখেছিল সে সিনেমায়। তার সাথেও এমন কিছু হতে পারে কল্পনাও করেনি সে।
‘আপনি আপনার স্ত্রীকে আজ নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু, আবার বলছি, ওকে যথেষ্ট পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। আর যেসব ওষুধ দিচ্ছি, সেগুলো একদম নিয়মমতো খাওয়াবেন।’ বলে কিছু ওষুধ লিখে দেন ডাক্তার।
‘আরো ভালো ভালো ওষুধ লেইখা দেন স্যার। আমার বউ আর বাচ্চা দুইজনেই যেন ভালা থাকে। কুনু সমস্যা যেন না হয়।’ রকির মনে ভয় ঢুকে গেছে। রকি সে ভয় কাটাতে পারে না।
‘কি সব পাগলের মতো কথা বলছেন? যা প্রয়োজন তাই লিখে দিয়েছি। আর যেসব বললাম সব পালন করবেন।’ বলেন ডাক্তার।
‘আচ্ছা স্যার, আমি তাই করমু।’ রকি উত্তর দেয়।
‘আপনার হাতে মাত্র ১ মাস আছে। আর হ্যাঁ, ব্যথা উঠলেই সোজা মেডিকেল চলে আসবেন। একদম দেরি করবেন না।’
‘আইচ্ছা স্যার।’
আর হ্যাঁ, একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন, ‘একটু এদিক ওদিক হলেই হয়তো কেউ একজনকে হারিয়ে ফেলবেন। খুব যত্নে রাখতে হবে এখন, খুব যত্নে।’
রকি আর ডাক্তারের কথার জবাব দেয় না। ওর মাথা ভার হয়ে ওঠে। কি হবে ভেবে কূল হারায় যেন।
চুমকির সামনে যেতেই চুমকি হেসে ওঠে। উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়, ‘কি কইলো ডাক্তার?’
রকি স্বাভাবিক হয়। হাসিমুখে বলে, তোমারে বাড়ি নিয়া যাইতে কইলো। কিছুক্ষণ পর আমরা বাড়ি যামু।’
চুমকির মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। এই মেডিকেল একদমই ভালো লাগছিলো না তার। এবার বাড়ি ফেরাটা তাঁর কাছে বিশেষ কিছু। কারণ, সে জানে; এবার তাঁর সঙ্গে রুমঝুম যাচ্ছে।
রকি আবার দোকান চালু করে। তেলে ভাজতে থাকে নাস্তা। বেচাকেনা চলে হরদম। চুমকি ভাত রান্না করে অপেক্ষা করে রকির জন্য। কখন ফিরবে রকি। রকি ফিরলে যেন প্রাণ ফিরে পায় সে।
রাতে রকি ভাত খেতে খেতে বলে, ‘ ছেলে তো হইলো না। তুমি মন খারাপ করলা নাকি?’
‘কি যে কও না তুমি? আমার রুমঝুম আইতাছে। মন খারাপ করমু কেমনে? আমগো ভালোবাসার প্রথম ফুল ফুটতাছে। এর চাইতে খুশির আর কিছু হইতে পারে না।’
‘আইচ্ছা, খুশি হইছো তাইলে? নাও, হা করো। আমার পেট ভইরা গেছে। এগুলা তুমি খাও এহন। আমি খাওয়ায় দিতাছি।’ বলে রকি চুমকিকে জোর করে ভাত খাওয়াতে থাকে। নিজের ভাগের মাছের টুকরাটা খাইয়ে দেয় চুমকিকে।
রকি ভাবে, চুমকি কিছু বুঝে না। কিন্তু চুমকি সব বুঝে। চুমকি জানে রকির পেট ভরে নাই। রকি ইচ্ছে করেই রোজ অযুহাতে ওর খাবার খাইয়ে দিচ্ছে চুমকিকে।
‘আইজকা আবার আপেল আনছেন কেন হুনি? কালকের আপেলই তো পইরা আছে এহনো!’ শুতে যাবার আগে বলে চুমকি।
‘পইরা আছে মানে? তুমি খাও নাই আপেল?’
‘খাইছি তো। অতো কি খাইতে পারি? নাও তুমি খাও তো এবার।, বলে রকির হাতে আপেল তুলে দেয় চুমকি।’
‘আচ্ছা, এখন ঘুমাই। আমার সকালেই দোকান যাইতে হইব। তুমি ঘুমায় যাও।’ বলে শুয়ে পড়ে রকি।
চুমকিও শুয়ে পড়ে। চুমকি শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু, রকি আসলে ঘুমায় না। ও চুমকির হাত জড়িয়ে ধরে বুকে। বারবার মনে পড়তে থাকে ডাক্তারের সেই কথাটা, ‘একটু এদিক ওদিক হলেই হয়তো কেউ একজনকে হারিয়ে ফেলবেন। খুব যত্নে রাখতে হবে এখন, খুব যত্নে।’
ডাক্তারের কথা মনে হতেই রকি শক্ত করে চুমকির হাত ধরে। ওর ভয় হয়, প্রচণ্ড ভয় হয়।
সেদিন রাতে, একসেট নীল চুড়ি কিনে আনে রকি। সে চুড়িতে কি যেন দেয়া, আলো গায়ে পড়লেই ঝিকিমিকি করে ওঠে। রকির ধারণা, এই ঝিকিমিকি চুড়ি দেখে চুমকি খুশি হবে, ওর চোখেও আলো ভরে উঠবে।
হাতমুখ ধুতে ধুতে রকি বলে, “ও রুমঝুমের মা। আমার জানু পাখিটা, ভালা আছো?”
চুমকি ভীষণ মন খারাপ ছিলো। তবুও, রকির প্রশ্ন শুনে হেসে দেয় সে। তারপর ন্যাকা সুরে বলে, ” ও মা! রুমঝুমের বাপের মনে দেখি ভালোবাসা জাগছে। তা কোনদিকে চাঁদ উঠছে হুনি?”
“কি কইবার চাইতেছো? তোমারে আমি ভালোবাসি না?” রকির মনে আঘাত পায় যেন, অভিমান ঝড়ে পড়ে কণ্ঠে।
“না, ভালোবাসো না। আমার তো এহন পেট উঁচা। বিশ্রী দেখায়। তাই আমারে আর ভালোবাসো না।” রকির চাইতেও বেশি অভিমান দেখায় চুমকি। রকির ততক্ষণে হাত মুখ মোছা হয়। চুমকির অভিমান সে বুঝতে পারে।
পুরুষ মানুষ নারীর মনের অভিমান বুঝবে না, তা কি হয়? রকি বুঝে চুমকির অভিমানের কারণ। বেশ কিছুদিন থেকেই রকি রাতে ফিরেই ঘুমিয়ে যাচ্ছে, সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়ছে। চুমকির সাথে কথা বলা হচ্ছে না বেশি একটা। সেকারণেই চুমকির অভিমান।
রকির এভাবে ব্যস্ত হবার অবশ্য কারণ আছে। রকির এখন অনেক টাকার দরকার। রকি জানে, যখন তখন চুমকিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে অনেক টাকার দরকার হবে। একটু হেলাফেলা হলেই ডাক্তার এসে বলবেন, “দুঃখিত, একজনকে বাঁচাতে পারিনি আমি।”
এই দুঃসময় আসার আগেই প্রচুর টাকা জমাতে হবে। রকি একটুও হেলাফেলা করতে চায় না চুমকির। একটুও না।
“আমার জানু পাখিটা রাগ করে না। এদিকে আসো দেখি।” বলে চুমকির হাত ধরে বিছানায় বসায় রকি। তারপর চোখ বন্ধ করতে বলে চুমকিকে।
নিমিষেই চুমকির অভিমান কেটে যায়। রকি তার জন্য কিছু একটা এনেছে! চুমকি চোখ বন্ধ করে ঠিকই, কিন্তু সে চোখে সুখ উপচে পড়ে। চুমকি চোখ খুলে যদি দেখে ১ টা ৫ টাকা দামের চকলেট এনেছে রকি, তবুও সে প্রচণ্ড খুশি হবে।
চোখ খুলতেই দেখে নীল চুড়ি! নীল রং চুমকির প্রিয় রং। তাই বুঝি রকি নীল রঙের চুড়ি কিনেছে। চুমকি চুড়িগুলো নিয়ে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যায়। সাথে সাথেই হাতে পরে ফেলে চুড়িগুলো। হাত নাড়িয়ে চুড়ি বাজাতে শুরু করে।
চুমকির এই বাচ্চামি দেখতে রকির ভালো লাগে। রকির নিজেকে প্রচণ্ড সুখী মানুষ মনে হয়। চুড়ির শব্দরা এতো সুখ বিলাতে পারে আগে ভাবেনি সে।
খাওয়া শেষে শুতে যাবার আগে চুমকি হঠাৎ বায়না ধরে, “আমারে একটা গান শুনাইবা? তুমি গান গাইবা, আমি নাচমু।”
রকি ভীমড়ি খায়! “কি বলো এসব, তুমি নাচবা কেমনে?”
“আরে, সত্যি সত্যি নাচুম না তো। শুধু হাত নাড়ায়া চুড়ি বাজায়া নাচুম। একটা গান গাও না! “
রকির গান গাওয়ার অভ্যাস নেই যদিও, তবু কিছু গানের কলি সে জানতো। চুমকি ভেবেছিল রকি গান গাইবে না এতো রাতে। এ ঘর, ও ঘরের সবাই শুনে হাসাহাসি করবে। কেউ কেউ রাগ ও করবে। কিন্তু, চুমকিকে অবাক করে দিয়ে গান শুরু করে রকি।
♪♪ওহে, কি করিলে বলো,
পাইবো তোমারে।
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে।
ওহে, এতো প্রেম আমি
কোথা পাবো না,
এতো প্রেম আমি
কোথা পাবো না।♪♪
রকি থামে। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, “কেমন গাইলাম জানু পাখি?”
চুমকি হাসে না। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কার দুঃখে এই দুঃখের গান গাইলা হুনি? তার মানে তুমি আমারে পাইয়া খুশি না? তুমি অন্য কাউরে চাইছিলা? কে সেটা? কারে তুমি চোখে রাখতে চাও হুনি?”
রকি ভাষা হারিয়ে ফেলে যেন। চোখেমুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। শুধু বলে, “কি মুসিবত। মাইয়া মানুষ এমন কেন যে! গান গাইয়া দেখি বিপদে পইড়া গেলাম।”
রকির অসহায় মুখ দেখে চুমকি খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে পাশের ঘরগুলোতেও। কিন্তু তাতে রকি চুমকির কিছুই যায় আসে না। কিছুই না।
৭ বছর পরের কথা। রকি ভাজাপোড়ার দোকানটায় ব্যস্ত। এখনো সে দোকান রেলগেটের পাশেই। সিঙ্গারা, পেঁয়াজু, পুরি, বেগুনি, আলুরচপ মচমচে ভাজে রকি। কাজের আরেকটা ছোটছেলে রেখেছে সে। লাবু নামে ডাকে তাকে। সেই ছেলে যথেষ্ট পটু। কিছু বুঝিয়ে দিতে হয় না। নিজ থেকেই কাজ করে যায়।
ঐ তো, বেণি দুলিয়ে স্কুল থেকে ফিরছে রুমঝুম। সাদা ধবধবে স্কুল ড্রেস আর সাদা জুতো পায় নেচে-গেয়ে আসছে সে। ওর গায়ের রং একদম চুমকির মতো, শ্যামলা, সুন্দর। চোখগুলোও চুমকির মতো, টানাটানা। চুমকির মতো চোখ নাচিয়া কথা বলে সে। চুমকির মতো অল্পতেই রেগে যায়, অভিমান করে।
” আব্বু, স্কুল ছুটি দিয়েছে। আজ সব পড়াই ঠিকঠাক দিয়েছি আমি। মিস আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন” রকির কাছে এসে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষায় বলে রুমঝুম।
” গুড মেয়ে আমার। রোজ পড়া দিতে হবে মা। তাহলে রোজ মিস আদর করবেন।” বলে রুমঝুমকে নিয়ে দোকানের একটু পাশে চলে আসে রকি। গরমে ঘেমে গেছে মেয়েটা। স্কুল ড্রেসটা খুলে দেয় রকি। স্কুল ড্রেসের নিচে একটা গেঞ্জি পরা ছিলো, সেটা পরে থাকে রুমঝুম।
ওদিকে দোকানে কাস্টমারের ভীড় জমে। লাবু কাজ করতে করতে হাপসে যায়। তবু রকিকে ডাকে না। লাবু জানে, রকি এখনি আসবে না দোকানে। সে এখন রুমঝুমের বেণি খুলে দিয়ে চুল আছড়িয়ে দিবে। তারপর নিজহাতে ভাত তুলে খাওয়াবে। তারপর ফিরবে দোকানে।
পাশ দিয়ে চুড়িওয়ালা যাচ্ছিল। তা দেখে রুমঝুম বলে ওঠে, ” আব্বু, আমি চুড়ি নিব।”
“চুড়ি নিবে? দাঁড়াও।” বলেই চুড়িওয়ালাকে ডাকে রকি। চুড়িওয়ালা সঙ্গে সঙ্গেই কাছে এসে দাঁড়ায়। “একসেট লাল চুড়ি দাও দেখি।” চুড়িওয়ালাকে বলে রকি।
চুড়ি হাতে নিয়ে রুমঝুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর বলে ওঠে, “এই চৃড়ি আমি নিব না আব্বু।”
“এগুলো নিবে না মা?”
“না আব্বু, আমি ওগুলো নিবো।” বলে আরেকসেট চুড়ি দেখিয়ে দেয় রুমঝুম। নীল রঙের চুড়ি।
এরকম নীল রঙের একসেট চুড়িই নিয়েছিল সে চুমকির জন্য। সেই চৃড়ি পেয়ে চুমকি ছোট বাচ্চার মতো খুশি হয়েছিল। হাত নাড়িয়ে শুনিয়েছিল চুড়ির নৃত্যের শব্দ।
রুমঝুম চুড়ি হাতে শব্দ করতে থাকে, ঠিক যেভাবে হাত নাড়িয়ে শব্দ করতো চুমকি, ঠিক সেভাবে। রুমঝুমের হাসিটা, ঠিক চুমকির হাসির মতোন যেন। রুমঝুমের মুখটা যেন চুমকিরই।
আজ ৭ বছর হয়ে গেছে চুমকি পৃথিবীকে বিদায় জানিয়েছে। ওর চিকন শরীর সইতে পারেনি রুমঝুমের আগমন। রুমঝুমের মুখটাও দেখে যেতে পারেনি সে।
অপারেশন রুমে ঢোকার আগমুহূর্তে রকির হাত ধরে চুমকি বলেছিল, ” আমি হয়তো আর ফিরুম না। আমি হয়তো রুমঝুমরে দেখতু পারুম না দুচোক্ষে। আমার হয়া তুমি রুমঝুমরে দেইখা রাইখো।”
চুমকির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। রকি সেই চোখের পানি মুছে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, “দূর বোকা, তোমার কিছৃই হইব না। কিছুক্ষণ পরেই তুমি আমি রুমঝুমরে কোলে নিয়া বইসা গল্প করুম। তুমি রুমঝুম দুইজনেই ঠিক থাকবা।” বলে চুমকির কপালে চুমু এঁকে দিয়েছিল রকি।
“আমার খুব শখ আছিল রুমঝুমরে মানুষের মতোন মানুষ করুম। শুদ্ধ ভাষায় কথা শিখামু। তুমি ওরে কিন্তু ভালা স্কুলে দিবা। শুদ্ধ কইরা কথা কওয়া শিখাবা।” চুমকি বলতে থাকে নিজের মতো। চোখ দিয়ে টপাটপ পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।
রকি চুমকির হাত শক্ত করে ধরে। “তোমার কিচ্ছু হইব না কইলাম। তুমি ভয় পাইয়ো না। তুমি এহনি ফিরা আইবা। তোমার কিচ্ছু হইব না।” বলতে বলতে চোখ ভিজে আমে রকির।
চুমকি মুচকি হেসেছিল শুধু। ভেজা চোখে চুমকির হাসি অদ্ভুত লাগছিল। রকি তখনো বুঝতে পারেনি, ঐ মুচকি হাসিটাই চুমকির শেষ হাসি হবে।
রুমঝুম হঠাৎ কথা বলে ওঠে, “তোমার চোখে পানি কেনো আব্বু? তুমি কি কাঁদছো?”
চোখের পানি মুছে নেয় রকি। মুখে হাসি এনে বলে, ” না মা, কাঁদছি না। আমি একটুও কাঁদছি না।”
” না আব্বু, আমি বুঝে গিয়েছি তুমি কাঁদছো। বড় মানুষদের কাঁদতে নেই, বুঝেছ?”
“আচ্ছা মা, আর কাঁদব না, একদম কাঁদব না আর।” বলে রুমঝুমকে বুকে জড়িয়ে ধরে রকি।
রুমঝুম হেসে ওঠে। স্নিগ্ধ হাসিতে হেসে ওঠে।
রুমঝুম জানে না, ওকে জড়িয়ে ধরে চোখের অশ্রুধারা লুকাচ্ছে তার বাবা। চোখ যে বাঁধ মানে না।
আচ্ছা, চুমকি কি ওদের হাসিকান্না দেখে? সে কি ঐ আকাশ থেকে ওদের হাসিকান্না দেখে উদ্বেলিত হয়?
কে জানে? হয়তো দেখে। হয়তো দেখে না।
…….”সমাপ্ত”…….