আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে

আষাঢ় নামে সন্ধ্যে খামে | পর্ব -০১

লেখা: ইলমা বেহরোজ

___________

আমিরাহ টেবিল ক্লিন করে রুমে আসে।বিছানার দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।নিজের জীবনটাকে তাঁর ব্যর্থ সাদা খাতা মনে হচ্ছে।যে খাতার নিষ্প্রাণ পাতা হৃদয়।হৃদয়টা যদি কেটে কুচিকুচি করা যেতো তবে সে তাই করতো।রাত এগারোটা বাজে এখনো রওশান বাড়ি ফেরেনি।নিস্তব্ধতায় চারপাশ হাহাকার করছে যেন!এমন নিস্তব্ধতা কখনো তাঁর সংসারে আসবে সে ভাবেনি।রাজিয়া সুলতানা রুম থেকে আওয়াজ করে, রাণী, রাণী ডাক পাড়াতে আমিরাহর চারপাশের নিস্তব্ধতা মুহূর্তে ভেঙ্গে যায়।রাণী বলে যখন রাজিয়া প্রথম ডাকতেন আমিরাহ বেশ বিরক্ত হতো।এরপর অবশ্য ভালো লেগেছিল।কিন্তু কাল থেকে কী আর এই সংসারের রাণী সে থাকবে?আমিরাহ ধীর পায়ে রাজিয়ার রুমে আসে।রাজিয়া আমিরাহকে রুমে ঢুকতে দেখে বলেন,

— “পোলায় এখনো ফিরে নাই?”

শ্বশুর শফিউল্লাহ দু’হাত বুকে ভাঁজ করে রেখে ঘুমাচ্ছেন।আমিরাহ শফিউল্লাহর গায়ে কাঁথা টেনে দিতে দিতে রাজিয়ার জবাব দেয় শান্তকন্ঠে,

— “আসলে তোমার কাছেই আগে আসবে আম্মা।”

রাজিয়া আমিরাহর থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকান।বুক ছিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। ছয় মাসে সংসারটা কেমন পাল্টে গেছে। তিনি মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করেন,

— “তোদের মধ্যে কি সমস্যা হইছে জানি না। যা ই হোক, আমার অনুরোধ রইলো দুজন মিলেমিশে সমস্যা মিটমাট করে নে।ডিভোর্সের কি প্রয়োজন?”

আমিরাহ রাজিয়ার কথা অগ্রাহ্য করে বললো,

— “রাত বারোটা বাজে। ঘুমিয়ে পড়ো।ফজরে নামায পড়তে উঠতে হবে।বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাবো?”

রাজিয়া অসন্তুষ্ট হোন।তিনি বুঝতে পারেন আমিরাহ আর এইসব নিয়ে কথা বলতে চাইছে না। তাই তিনি আর কথা বাড়ান না। চুপচাপ শুয়ে পড়েন।আমিরাহ বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে যায়।রাজিয়ার চোখের কার্ণিশ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। তখনি কেউ একজন এসে জড়িয়ে ধরে।রাজিয়া স্পর্শটা চিনতে পারেন।আমিরাহ! আমিরাহ ধরা গলায় বললো,

— “ডিভোর্স হলেও তোমার সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে আম্মা।আমাদের সম্পর্কটা যে আত্মার।”

রাজিয়া টের পান, বুকের ভারটা ম্যাজিকের মতো নাই হয়ে গেছে।স্বস্তির হাওয়া ঢুকে গেছে বুকের ফাঁক ফোঁকর গেলে।তবুও অভিমান নিয়ে বলেন,

— “তুই ছাড়া এই সংসার মৃত্যুপুরী। থাকবো না এখানে।সাথে নিয়ে চল।পোলা একাই থাকুক।”

— ” ও তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবে না। ছেলেটা তো তোমার। থাকো না।আমি কয়দিন পর পর তোমার সাথে কোথাও একটা দেখা করবো।”

রাজিয়া বিপন্ন গলায় বলেন,

— “তবুও….

— “আর কথা না আম্মা।আল্লাহ যা লিখেছেন তাই হবে।”

রাজিয়া আমিরাহর কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলেন,

— “রাত জাগিস না।ঘুমাবি কিন্তু।”-

— “আচ্ছা আম্মা।”

আমিরাহ রুমে এসে বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে।চাপা কান্না।ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে, রাত একটার।বিছানায় শুয়ে আমিরাহ বুঝতে পারলো তার মাথাটা ধরেছে।চোখ দুটিও জ্বলছে ভীষন, ভীষণ ভাবে। জ্বর আসতে পারে।বুকের ভেতর দলা পাকানো কষ্ট পাথরের মতো ভারী হয়ে চেপে বসে আছে। পাথরটার ওজন কত হবে? পরিমাপ করা যাবেনা বোধহয়। অনেক…..অনেক ওজন।

বাচ্চা বয়স থেকে প্রেম দুজনের।তেরো বছরের প্রেম!তিন বছরের সংসার।ষোল বছর পর দুজনের মনে হলো কেউ কারোর নয়!দুজন দু’টি আলাদা আলাদা ব্যক্তি। যাদের পথ আলাদা, চয়েজ আলাদা। সত্যিই কি সব আলাদা ছিল? নাকি হুট করে হলো।নাহ,আমিরাহর একদম ইচ্ছে করেনা এসব প্রশ্নের উত্তর হন্ন হয়ে খুঁজতে।

সে স্টাডি রুমে চলে আসে উপন্যাস লিখার জন্য। বইমেলা আসার বাকি আর মাত্র পাঁচ মাস।এখনো উপন্যাসটির এক অংশ ও শেষ হয়নি।কত-শত পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমিরাহ সিদ্দিকার নতুন উপন্যাস পড়ার জন্য। এতো মানুষের মন ভাঙ্গার  সাহস তার নেই। জনপ্রিয় একজন লেখিকা হিসেবে লেখালেখি তাকে চালিয়ে যেতেই হবে।ব্যক্তিগত জীবনে যাই হয়ে যাক। ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।রওশান এসেছে! আমিরাহর ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে দরজা খুলে মানুষটার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।এতদিন তো তাই হয়ে এসেছে।কিন্তু জেদ, ইগো আটকে দিলো।আরো বার কয়েক কলিং বেল বাজে।আমিরাহ চুপ করে শুধু শুনে।

ঘুমু ঘুমু চোখ নিয়ে দুলে দুলে আসে চুমকি।কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে কপালে তার বিরক্তির ছাপ।দরজা খুলে রওশানকে দেখে বিরক্তির ছাপ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে।

— “ভাইজান আপনের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছেনা।খুইলা ঢুইকা পড়তেন।হুদাই ঘুমডা ভাঙ্গাইলেন।”

রওশান জবাবে মৃদু হাসে।অবাধ্য চোখ দু’টি এদিক-ওদিক তাকিয়ে কেউ একজনকে খুঁজে।এতোবার কলিং বেল বাজানোর কারণটা কি মেয়েটা ধরতে পারেনি?রওশান দরজা লাগিয়ে রুমে আসে।রুমেও নেই!সে সেকেন্ড কয়েক দাঁড়িয়ে থাকে ঝিম মেরে।কিছু একটা ভাবে।এরপর ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে।ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।ঘুমে চোখ দু’টি জ্বালা করছে।পাঁচ মিনিটের মাথায় ঘুমিয়ে পড়ে।হারিয়ে যায় অন্য এক জগতে।সেই মুহূর্তে রুমে ঢুকে আমিরাহ।রওশান কে ঘুমাতে দেখে ঠোঁটে ফুটে উঠে ম্লান হাসি। বিয়ের পর তোমাকে বুকে না নিয়ে একদিন ও

ঘুমাবোনা,  বলা মানুষটা তার মুখ অব্দি দর্শন না করেই কত আরামে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মানুষ কত কথাই বলে!করে কয়টা?

আমিরাহ ঘুরে দাঁড়ায় রুম থেকে বেরিয়ে যেতে।আবার ফিরে তাকায়।অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাঁথাটা টেনে দেয় রওশনের গায়ে।এরপর বাতি নিভিয়ে স্থান ত্যাগ করে।আজ সারারাত সে জাগবে।বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াবে।আগামীকাল তার বিদায়!তার জায়গাটা দখল করবে অন্য কেউ।আমিরাহ বিড়বিড় করে,

— “অন্যকেউ!”

অন্যকেউ শব্দটা মস্তিষ্কে আসতেই মন পাহাড়ে বজ্রপাত শুরু হয়।

অসহনীয় কষ্ট অনুভব হয়।আমিরাহ ব্যস্ত পায়ে দ্রুত ছাদে আসে।

দূর্বল পায়ে হেঁটে রুমে আসে আমিরাহ।দরজা লাগিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। চোখ রাখে শূন্যে।শাড়ির আঁচলটা ফ্লোর ছুঁই,ছুঁই।খুব, খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। এতো চেষ্টা করেও মন শক্ত করা যায়নি।আমিরাহ দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো।রওশানের হুট করে ঘুম ভেঙ্গে যায়।কেনো জানি বুকে তোলপাড় হচ্ছে।কাঁথা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চোখ যায় বাম পাশের দেয়ালটায়।মনে হচ্ছে আমিরাহ এই দেয়ালের অন্য পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।রওশান দেয়ালের পাশে এগিয়ে আসে।এক হাত দেয়ালের উপর রাখে।আমিরাহর নিঃশ্বাস স্পষ্ট! কাঁদছে!রওশান দেয়াল ঘেঁষে ঘুরে দাঁড়ায়।চোখ দু’টি বেয়ে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।চোখের জল মুছে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে।আবার উঠে বসে।কাঁথা,বালিশ নিয়ে হেঁটে আসে দেয়ালের পাশে।এরপর দেয়াল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে।

আমিরাহর ঘুম ভাঙে রাজিয়ার ডাকে।চোখ খুলে দেখে সে দেয়ালের পাশেই ফ্লোরে ঘুমিয়ে পড়েছে।গলা ব্যাথা করছে।ঠান্ডা লেগে গেছে।ফ্রেশ হয়ে সময় দেখে, দুপুর দুইটা!নিজে নিজে বিড়বিড় করে,

— “এতোটা!”

দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে আসে।এসে দেখে সব রান্না শেষ। শেষ তো হবেই।এতো বেলা অব্দি কেউ না খেয়ে থাকবে নাকি।আমিরাহ রাজিয়ার রুমে আসে।অপরাধী স্বরে বলে,

— “সরি আম্মা।আরো সকালে ডাকতে পারো নাই।”

— “ফজর বেলা ঘুমাইছোস।সকালে কোন আক্কেলে ডাকবো।”

— “তবুও আম্মা।রান্না কি চুমকি করছে?”

— “হ।”

— “চুমকির হাতের রান্না তোমার ছেলে পছন্দ করে না।”

রাজিয়া তীর্যক ভাবে তাকান।বলেন,

— “ওই হারামজাদার কথা তুই ভাবিস না।”

আমিরাহ মুচকি হাসে।রাজিয়া আমিরাহকে টেনে পাশে বসিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললেন,

— “চইলা যাবি এই মা রে রেখে?”

আমিরাহ উঠে দাঁড়ায়।কপট রাগ নিয়ে বললো,

— “এইটাই ফাইনাল ডিসিশন। বিকেলেই বের হবো।”

রাজিয়ার মুখ চুপসে যায়।তিনি প্রশ্ন করেন,

— “রাতের ট্রেনে যাবি?”

— “না।বাসে যাবো।”

— “বমি করিস তো বাসে।সামলাবে কে? তোর আব্বারে বলবো দিয়া আসতে?”

— “আব্বারে বলার দরকার নাই।একাই পারবো।বাকী জীবন  টা তো একাই পার করতে হবে।”

রাজিয়া ফোঁস করে উঠেন।

— “যা। চলে যা।পরের মেয়ে তো। কেন শুনবি আমার কথা।আপন মা হলে এমনে কথা ফেলতে পারতি না।”

— “আম্মা কতবার বলছি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল না করতে।”

কথা শেষ করে আমিরাহ নিজ রুমে চলে আসে।অতিরিক্ত ভালবাসাও মাঝে মাঝে বিরক্ত মনে হয়।খুব বেশি।রাজিয়া পিছুন, পিছুন আসেন।আমিরাহকে বলেন,

— “আমার ভালবাসার দাম নাই?”

আমিরাহ কাপড় গোছাতে গোছাতে কেঁদে কেঁদে বলে,

— “শ্বাশুড়ি হয়ে কেনো এতো ভালবাসো।কি দরকার এতো ভালবাসার।ঠেকা পড়ছে আমার ভালবাসার?আমারে কি ভালবাসার আর মানুষ নাই?”

রাজিয়া আমিরাহর কথায় খুব কষ্ট পান।চলে যেতে নিলে আমিরাহ জড়িয়ে ধরে রাজিয়াকে।ঠোঁট টিপে কাঁদে।এরপর আফসোস করে বলে,

— “কেন তুমি বরের মা হলে আম্মা।আমার মা হতে পারলানা।”

আজ আষাঢ় মাসের প্রথম।দিন।আবহাওয়া প্র‍থম দিনই চেঞ্জ।মৃদু, মৃদু বাতাস।আকাশ পরিষ্কার। তবে, বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।আমিরাহ লাগেজ নিয়ে গ্যারেজে আসে।গাড়িতে ড্রাইভার নেই।রাজিয়াকে আমিরাহ জিজ্ঞাসা করে,

— “ড্রাইভার কই?”

রাজিয়া আমতা আমতা করে বলেন,

— “ও ছুটি নিছে।”

আমিরাহ বেশ বুঝতে পারছে তার শাশুড়ীর কাজ এটা।ভাগ্যিস শ্বশুর শফিউল্লাহ জানেন না সে যে চলে যাচ্ছে।শাশুড়ীকে খুব সহজে সামলানো গেলেও শ্বশুরকে সামলানো যায় না।এমন শ্বশুর – শাশুড়ী ছেড়ে যাওয়া কঠিন পরীক্ষাও বটে। যার উছিলায় এমন শ্বশুর – শাশুড়ী পাওয়া গেছে তার সাথেই যখন আর সম্পর্কটা ভালো নেই।এই বাড়িতে থাকার তো কোনো মানে নেই।আমিরাহর জেদ বরাবরই আকাশচুম্বী।আমিরাহ রাজিয়াকে বলে,

— “আম্মা ড্রাইভারকে কই পাঠাইছেন?”

রাজিয়া কাচুমাচু হয়ে এদিক-ওদিক তাকান।রওশানকে গ্যারেজে আসতে দেখে আমিরাহর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।রওশান ড্রাইভিং সিটে বসে আমিরাহর উদ্দেশ্যে বলে,

— “আমার বাইরে কাজ আছে।বাস ষ্টেশনের পাশেই।যদি চাও….

আমিরাহ দরজা খুলে পিছনের সিটে বসে।রওশান গাড়ি স্টার্ট দেয়।রাজিয়া ছলছল চোখ নিয়ে বিদায় জানান হাত নেড়ে।আমিরাহ আড়চোখে একবার রওশানকে দেখে।কত ফ্রেশ লাগছে রওশানকে!লাগবেই তো। আপদ বিদায় হচ্ছে যে!

রওশান গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তার কোনো কাজ নেই।তবুও মিথ্যে অজুহাত দিয়ে আমিরাহর সঙ্গে যাচ্ছে।কেনো যাচ্ছে সে জানে না।আমিরাহ যখন সেদিন বললো, ডিভোর্স চাই।তখন এক সেকেন্ড ও সময় নেয়নি রওশান।সাথে সাথে উত্তর দেয়,

— ” আমিও চাই।”

এরপর থেকে রুমটাও আলাদা হয়ে যায়।পাঁচ – ছয় মাস আগে, সপ্তাহখানেক কোম্পানিতে লসের মুখোমুখি হতে হয় রওশানকে।তাই প্রতিদিন দেরি করে বাড়ি ফিরতে হতো।মেজাজ থাকতো খিটখিটে। ফলে, আমিরাহর কোনো অভিযোগ শুনলেই মেজাজ চটে যেতো। শুনিয়ে দিতো এক,  দু’টো কথা।আমিরাহ বরাবরই খুব রাগী, জেদি টাইপের। সে ও তাল মিলিয়ে তর্ক করে যায়।এভাবেই দূরত্ব বাড়তে থাকে।প্রতিদিন ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। আঘাত করে কথা বলা, অপমান করা,  অতীত নিয়ে খোটা দেওয়া, রাতের পর রাত না খেয়ে থাকা,মানসিক অশান্তিতে ভোগা সব হয় কয়টা মাসে।এরকম সম্পর্কের শুরু থেকেই হয়।কিন্তু এবার যেন বেশি।কোনো ভাবেই দুজনের মিল হচ্ছিলো না।তাই রাগে একদিন আমিরাহ বলে ফেলে, ডিভোর্সের কথা।তাতে সায় দেয় রওশান।

গাড়ি চলছে তার গতিতে।দুজনের কেউ কথা বলছেনা।নিরবতা ভেঙে রওশান আগে বলে,

— “বিয়ে করবে নিশ্চয়ই?”

— ” করবো তো অবশ্যই করবো।তুমিও তো বিয়ে করবা অন্যকেউ কে।এজন্যই তো ডিভোর্স দিচ্ছো।”

— “অন্যকেউ টা কে?”

— “মেয়ে মানুষ। হিজরা অবশ্যই বিয়া করবানা?”

— “মুখ ভালো করো।এই মুখ খারাপের জন্যই সম্পর্কটা ভেঙে যাচ্ছে।”

— “আজীবন আমাকেই দোষ দিয়ে গেলা।”

— “দোষ আছে বলেই দেই।প্রতিদিন সন্দেহ করো, যাই হয়ে যাক মেয়ে নিয়ে আসো কথার মাঝে।আমাকে তোমার এতোই খারাপ মনে হয়। ষোল বছরেও চিনতে পারোনি আমাকে।বুঝতে চাও না আমাকে।”

— “যে বুঝবে তাকেই বিয়ে করোনা।”

— “আস্তে  কথা বলো।এটা বাসা না।”

আমিরাহ গলার জোর বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠে,

— “তোমার মতো ছেলেরে ভালবাসা আমার জীবনের বড় ভুল। সেই প্রথম থেকে আমার জীবনটা নিয়ে খেলে আসতেছো।কখনো ভালবাসনি।”

— “কখনো ভালবাসিনি?”

— “না বাসোনি।”

— “এভাবে মিথ্যে বলো না।”

— “আমিই মিথ্যাবাদী-ই।যাও না মুক্ত করে দিচ্ছি তো।সত্যবাদী খুঁজে খুঁজে বিয়ে করো।”

— “আমার আরেকটা বিয়ের শখ নেই।”

— “শখ আছে না নেই বুঝি সেটা।বুড়ি হচ্ছি তো মন ভরে না আমাকে দিয়ে। কচি মেয়ে চাই কচি! তাইনা?”

রওশান যতটুকু সম্ভব রাগ কন্ট্রোল করে চাপা স্বরে বলে,

— “শাট-আপ।ফালতু কথা আমার সাথে জড়িয়োনা।”

— “আমি ফালতু তাই আমি ফালতু কথা বলি।ফালতু বিয়া করলা কেন?সতী দেখে বিয়ে করতে পারলানা?”

— “দেখো, আমি তোমাকে ফালতু বলিনি।”

— “বুঝাই গেছে কি বলছো।’

রওশান বুক ছিড়েখুঁড়ে রাগ বের করে দেওয়ার জন্য লম্বা করে নিঃশ্বাস ফেলে।এই মেয়ের সাথে কখনো কথায় সে পারেনি। আর পারবে ও না।বুঝতে পেরেও নিজের ভুল কখনো স্বীকার করে না।নিজ ইচ্ছায় সরি কখনো বলে না। আর মুখের ভাষা বরাবরই খুব খারাপ। অথচ,বহু সংখ্যক পাঠকের সামনে এই মেয়ে নিতান্তই একজন ভদ্র, শান্ত, বুদ্ধিমান, মানুষ। মানুষের কত রূপ! ষোল বছরের সম্পর্কে ভুল যারই হোক রওশান সরি বলে এসেছে।এবার সে ধীর প্রতিজ্ঞা করেছে, ডিভোর্স হলে হউক তবুও সে আগ বাড়িয়ে পা ফেলবেনা।ইগো, জেদ ভীষণ ভাবে কাজ করছে।

হৃদস্পন্দনে যন্ত্রণারা খুঁড়ছে অবিরাম।মন আকাশে বৃষ্টির ধারার মতো বিষণ্নতা আছড়ে পড়ছে। বিষন্নতার বিষবাষ্পে ভেতর চেঁচাচ্ছে।চোখ কার্ণিশে জল এসে থেমে যাচ্ছে।তবুও দুজনের কেউ নিজ থেকে বলার সাহস পাচ্ছেনা, চলোনা আবার নতুন করে শুরু করি।আমিরাহ বাইরে তাকিয়ে ঢোক গিলে।গলাটা জ্বলছে খুব।আর পাঁচ-ছয় মিনিট।তারপরই….পথচলার সমাপ্তি!অথচ,কথা ছিল মৃত্যুর আগ অব্দি একজন আরেকজনের। রওশান আড়চোখে একবার তাকায়।আমিরাহ সবসময় শাড়ি পরে।নিজেকে পরিপাটি রাখে।এখনকার মেয়েরা শাড়ি পড়ে দু’পাও এগোতে পারেনা।সেখানে আমিরাহ চব্বিশ ঘণ্টা শাড়ি পরে থাকে।নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে।প্রতিদিন প্রেমে পড়ার মতো একটা মেয়ে।অথচ,তার মেজাজ, স্বভাব! রওশান চোখ ফিরিয়ে নেয়।যথাসময়ে বাস স্টেশনে চলে আসে।আমিরাহ  লাগেজ নিয়ে গাড়ি থেকে নামে।রওশানের বুক ছ্যাৎ করে উঠে।

আমিরাহ ছলছল চোখ নিয়ে রওশানের দিকে তাকায়।রওশান মুখ ভঙ্গি শক্ত করে দূরে তাকিয়ে আছে।আমিরাহ আস্তে করে বলে,

— “আসি।”

কথা শেষ করে সামনে হাঁটে।শাড়ির আঁচল সন্ধ্যে হওয়ার পূর্ব মুহূর্তের মিষ্টি বাতাসে মৃদু উড়ছে।রওশানের চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।দ্রুত চোখের জল মুছে গাড়ি ঘুরায়।আমিরাহ পিছন ফিরে তাকায়।রওশান চলে যাচ্ছে তাকে একা ফেলে!

আংশিক হলেও আশা  ছিল রওশান তাকে যেতে দিবে না।আমিরাহ পিছুটান ছেড়ে টিকেট কাউন্টারে আসে।টিকিট কাটে।আরো ত্রিশ মিনিট পর বাস ছাড়বে।আমিরাহ সিটে গিয়ে বসে।জানালার বাইরে তাকায়।বিয়ের পর একা প্রথম জার্নি। পাশে রওশান নেই।চোখ বেয়ে টুপ টুপ করে জল পড়তে থাকে। ভেতরের আমিরাহ আর্তনাদ করে বলে,

— “একটাবার সরি বলে বুকে টেনে নিতে পারলে না।আমি জানি আমার দোষ ছিল।তোমাকে বোঝার চেষ্টা করিনি।তুমিও তো রাগারাগি করেছো। একবার বুকে টেনে নিয়ে দেখতে, আমি আমার ভুল স্বীকার করে নিতাম।আমি কীভাবে থাকবো তোমাকে ছাড়া।”

রওশান ভাবছে খুব ভাবছে।সে কি ভুল করছে? কোনোদিন এজন্য আফসোস হবে না তো? একটা মানুষের কি সব গুণ থাকে? দোষ থাকতে পারে না?সূর্য পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিম দিকে ডুবে এটি যেমন চিরন্তন সত্য, তেমনি চিরন্তন সত্য আমিরাহ তাকে পাগলের মতো ভালবাসে। এবং এখনো তার কথায় ভাবছে।এখনো ভালবাসে।রওশান তা বিশ্বাস করে।শুধু রাগ, জেদ বেশি। নিজের মতো কিছু না হলে রেগে যায়, মুখ দিয়ে যা আসে বলতে থাকে।শুধু মাত্র এই দোষের জন্য কাউকে ছাড়া যায়? রওশানের মনে পড়ছে গত বারের কথা।দশ দিন সে দূর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল।এই দশ দিনের একটা সেকেন্ড ও তাকে একা ফেলে রাখেনি আমিরাহ। আচ্ছা, এখন কি সকালে কেউ টাই বেঁধে দিবে? প্রতি রাতে বাড়ি ফেরে দরজার ওপাশে কাকে দেখবে? তারপর ঘামে দুর্গন্ধ হওয়া শার্টের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কে বলবে?

— ” সারাদিন কয়টা মেয়েটার সাথে কথা হইছে হা?

রওশান ভাবতে পারছে না।বুক দুরু দুরু করছে।প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফিরে আর কি দেখা হবে, টেবিল জুড়ে সাজানো তার সব পছন্দের খাবার। কাপড় চেঞ্জ করে খেতে না বসাতে কেউ কি খুন্তি হাতে নিয়ে হুমকি দিবে? এইযে এই…. এই বা পাশের বুকটা কি এখন শূন্যতায় খাঁ খাঁ করবে? ফজরে মুখে পানি ঢেলে কেউ ঘুম ভাঙাবে? রিমোট নিয়ে মারামারি কেউ করবে? সারাক্ষণ কে জ্বালাবে? কে এতো ভালবাসবে? কারো কি সেই সাধ্যি আছে? রওশান গাড়ি থামিয়ে হাঁপাতে থাকে।একা লাগছে, বড্ড একা লাগছে।কেউ নেই, নেই, আমিরাহ নেই।ওই বাসা মরুভূমি হয়ে গেছে।ওই বাসায় একা গেলে সে কিছুতেই বাঁচবে না।কিছুতেই না।এতকাল যখন সে সরি বলতে পেরেছে,আজও পারবে।পারতে হবে।রওশান গাড়ি ঘুরায়।

বাস ছেড়ে দিতেই আমিরাহর পা কাঁপতে থাকে। এই পা যখন, তখন হোঁচট খায় তখন রওশান সামলায়। তার যত আবদার সব পূরণ করে রওশান।চাওয়ার আগে সব এনে হাজির করে।জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডের পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে নেয় না।বিয়ের প্রথম বছরই ভীষণ বাজে জ্বরে আক্রান্ত হয় আমিরাহ। রওশানের শার্টে, শরীরে বমি করে।রওশান তার জন্য একটুও রাগে নি।নিজেকে সহ আমিরাহকে পরিষ্কার করেছে। এরপর বুকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। যতদিন অসুস্থ ছিল রওশান কোম্পানির কোনো কাজে মাথা ঘামায় নি।লস হয়েছে কিছু।তবুও রওশানের কোনো মাথাব্যথা ছিল না।তার কাছে ইম্পোরটেন্ট ছিল আমিরাহর সুস্থতা। কথায়, কথায় সন্দেহ করার পর ও রওশান হাসিমুখে প্রমাণ দিতো সে নির্দোষ। এমন একজন মানুষ কয়দিন দেরি করে ফিরাতে সন্দেহবশত রাগারাগি করে খারাপ কথা বলাটা কি ঠিক হলো? না হয় নি।হয় নি ঠিক।আমিরাহ চোখের জল মুছে ফোন বের করে।এইবার সে-ই সরি বলবে।কিছুতেই রওশানকে ছাড়া থাকা যাবে না।কিছুতেই না।আমিরাহ টাইপিং করতে করতে রওশানেত মেসেজ আসে,

” আমি সরি।প্লীজ আমাকে ক্ষমা করো।আমি রাগারাগি করে ভুল করেছি।তোমাকে বরাবরের মতো বোঝানো উচিৎ ছিল।আমি জানি তুমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারো না। আমাকে সামলাতে হয়। তবুও  বকে ফেলেছি।প্লীজ যেও না, প্লীজ।আমি কিভাবে কি বলবো বুঝতেছি না।তুমি জাস্ট যেও না।ফিরে আসো প্লীজ।”

আমিরাহ এক হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে উঠে।বাসের কয়েকজন যাত্রী হা করে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।তখনি ফোনের রিংটোন বেজে উঠে।স্ক্রিনে নাম উঠে – শান!আমিরাহ দ্রুত রিসিভড করে।ওপাশ থেকে কাঁপা কন্ঠ স্বর ভেসে আসে,

— “সরিহ!”

আমিরাহ প্রতিউত্তরে কিছু না বলে কল কাটে।কাঁপা হাতে ফোন দ্রুত ব্যাগে ঢুকিয়ে লাগেজ নামায়।এরপর ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,

— “প্লীজ বাস থামান।আমি নামবো।”

বাসের যাত্রীরা একস্বরে বলে উঠে,

— ” না না থামানো যাবে না।বললেই হলো।”

আমিরাহর মাথার রক্ত টগবগ করে উঠে। ড্রাইভারকে হুমকি দেয়,

— “এখুনি বাস না থামালে আমি ঝাঁপ দিবো।কাউকে শান্তি দিবোনা।”

ড্রাইভার বিড়বিড় করে,

— “কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম।”

এরপর আমিরাহকে বলে,

— “থামাচ্ছি।”

বাস থামতেই তড়িঘড়ি করে নামে আমিরাহ।অনেকটা দূরে চলে এসেছে বাস।দ্রুত হাঁটতে থাকে।সন্ধ্যার আযান পড়ছে।আমিরাহ শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নেয়।সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আষাঢ়ের বৃষ্টি। বৃষ্টি বাড়ছে।রাস্তা খালি হচ্ছে।এরি মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।

রওশানের বুক উত্তেজনায় কাঁপছে।আজ রাত টা আমিরাহর সাথে কাটানো যাবে তো? আমিরাহ ফিরবে?চোখ যায় দূরের রাস্তায়, শাড়ি পরা একটি মেয়ে দ্রুত হেঁটে এদিকটায় আসছে।গাড়ি থেমে যায়। রওশান বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে।মুখখানা অকস্মাৎ হা অবস্থায় স্থির হয়ে গেল, দৃষ্টি গেল আমিরাহতে থমকে।পিল চমকে উঠলো।অনুভূতি সেই প্রথম দেখার মতো।আমিরাহর মুখ বৃষ্টিতে ভিজে চোখের কাজল গেছে লেপ্টে। রওশানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে যায়।কোনো এক মাতাল নেশায় বিভোর হয়ে লাগেজ রেখে ছুটে আসে রওশানের দিকে।মাথা থেকে আঁচল পড়ে যায়।ঝাঁপিয়ে পড়ে রওশানের বুকে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।রওশান লোক সমাজের দৃষ্টি উপেক্ষা করে দু’হাতে আমিরাহকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

— “সরি রাহা।তোমাকে কাঁদানোর জন্য খুব সরি।”

আমিরাহ রওশানের মুখে নিজের নিকনেম শুনে আপ্লুত হয়ে রওশানের চোখে চোখ রেখে আদুরে গলায় বলে,

— “আমিও সরি, তোমার মতোই খুউবব সরি।”

দুজন একসাথে হেসে উঠে।

সমাপ্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *