শৈশব স্মৃতি

আমাদের যাদের গ্রামে জন্ম,   মাঠে ঘাটে ধানের আইলে দৌড়া-দৌড়ি করে কাটানো আমাদের শৈশব। আমাদের জন্য  বছরের এই  মৌসুমটা (শীত-বসন্ত) কালটা   ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

অগ্রহায়ণী  ফসল কাটা শেষ হত,  শীতের আমেজ পড়তো।  ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর একটা নীরব প্রতিযোগিতা শুরু হত। কিছু কিছু পিঠা আবার সকালের সিগ্ধ রোদে শুকাতো মায়েরা। ভাল লাগায় সময় আরো ভাল লাগতো যখন বিকাল হত, খোলা মাঠে গুল্লাছুট খেলতাম। কিংবা খোলা  আকাশে  ঘুড়ি উড়াতাম। 

ইংরেজি বছর শেষপ্রান্তে থাকতো।  ঘরের ক্যালেন্ডার ছিড়ে, ঘাবের কষকে আঠা হিসেবে ব্যবহার করে ঘুড়ি বানাতাম শৈল্পিক ভাবে আমরা। ঘুড়ি ছিড়ে আমাদের গ্রাম থেকে দূরে অন্য গ্রামে চলে যেত, আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দৌড়ে যেতাম ঘুড়ির পিছনে পিছনে। 

আমাদের শৈশবের সময়টায় গ্রামে সবার ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। 

কয়েকপাড়ায় একেক ঘরে থাকতো টেলিভিশন। এতেই আমরা  বৃহস্পতিবার আর  শুক্রবার বিকালে বাংলা সিনেমা দেখার জন্য রীতিমত ভিড় জমাতাম  ঐ বাড়িতে। যারা গৃহকর্তার কাছের মানুষ তারা ভাল আসনে  বসতো। আর  বাকিরা মাটিতে পীড়িতে যে যার মত বসতো।  তবে আনন্দের মাঝে কারো বিন্দুমাত্র তফাৎ থাকতো না। সবার চোখে বিষ্ময় আর তৃপ্তির ঢেকুর থাকতো। 

মুগ্ধতা নিয়ে আমরা প্রতিটি বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দেখতাম। 

সন্ধ্যার পর শুক্রবারে “আলিফ লায়লা” যে কি পরিমান রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিত, তা বর্তমানের ১০-২০ টা হিট সিনেমার সাথে ও  তুলনা করা যায় না। 

ঐ  সময়টায়  আমাকে ঘরে আটকানো খুব মুসকিল ছিল । সরিষার ক্ষেতে ঘুরতাম। আমার বড় বোন প্রায় সময় দেখতাম আলুর ক্ষেত থেকে (বত্তার শাক) তুলতো,  মা রান্না করতো, এই স্বাদ আর জীবনে ও ঐ ভাবে মুখে ফিরবে না কোনদিন,  এটা আমি নিশ্চিত। ঐ প্রাকৃতিক ভাবে উৎপত্তি নেয়া শাক যা এখন কোন ভাবেই সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। 

মাঠের পাশের নিচু গর্তকে আমরা খাদ বলি। এই সময়ে(মৌসুমে)  খাদ সেঁচার ধুম পড়তো । আমাদের বংশের সবার প্রায় (১৪ পরিবারের)   এজমালী (যৌথ)  একটা খাদ ছিল সবাই মাছ ভাগাভাগি করলে ও প্রতি পরিবারের মিনিমাম ২-৩ মাসের মাছ এর যোগান দিত ঐ একটি মাত্র খাদ। ৪-৫  দিন পানি সেঁচার সাথে সাথে একটা উৎসবের ভাব আসতো সবার মনে। 

একেকজনের মাঝে থাকা ছোট মনমালিন্য দূর হত এক সাথে কাজের সুবাদে। 

 

ছেলে মেয়ে বয়সী সবাই মাঠে গর্ত করে একসাথে যে যা পারতাম যোগাড় করে রান্না করে খেতাম। 

সামান্য কিছুই থাকতো আমাদের সংগ্রহে। ক্ষেতের পাশের হেলেনসা শাক কিংবা সংগ্রহ করা চালের খিচুড়ি রান্না করতো মেয়েরা।  কুড়িয়ে আনা পাতার আগুনে রান্না হত। 

আর কলা পাতায় পরিবেশন করা হত খাবার।  ঐ ভাবে করা আয়োজন আমাদের যে  আনন্দ আর সুখ অনুভূতি দিত, বর্তমান সময়ে প্রচলিত  পিকনিক নামে পার্কে সস্তা বিনোদন আমি নিশ্চিত এর ১ ভাগ ও  আনন্দ দান করে না। 

এই ভাবে দিন কাটার পর ফাল্গুন  মাস আসতো। ধানের ক্ষেতে পানি দিয়ে কলের লাঙ্গল চালানো হত। শালিক পাখি  পোকা খেতে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে। 

কোন কোন কৌশলি মানুষ ফাঁদ তৈরী করতো গরুর লেজের মজবুত চুল দিয়ে।  অনেক  শালিক  পাখি ধরা পরতো ফাঁদে। 

সবাই কোন একটা নিদিষ্ট পুকুরে জমা হতাম গোসল এর জন্য। একসাথে বসে আড্ডায় ই সময় চলে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা গোসল এর কথা মনে ই থাকতো না। 

কেউ কেউ পানি গোলা করতো অকারণে । 

একটু বয়স্ক  মুরব্বীরা বকা দিত। 

কোন কোন দুর্ভাগা লোক সাবান হারাতো পানিতে কিংবা কাক পাখির শিকারে পরিণত হত সাবান। ঐ সময়টা গ্রামে কসকো নামের একটা সাবান বেশ জনপ্রিয় ছিল।  এর কারণ দীর্ঘ দিন যেত সবানটা, তবে ফেনা কম তুলতো। এখন গ্রামের লোক এই সাবান চেনে ই না প্রায়। 

২১ শে ফেব্রুয়ারিতে কলা গাছের শহিদ মিনার তৈরীতে শরিক  হয়ে গর্ব বোধ করতাম আমরা । শিমুল ফুল নিম ফুল নানা জংলি ফুল দিতাম কলা গাছের অস্থায়ী শহিদ মিনারে। কারো বাড়িতে গাঁদা ফুল থাকলে আগের রাতে পাহারা দিয়ে রাখতে হত , নয় চুরি হবার সম্ভাবনা শত ভাগ ছিল।  তাও কিছু কৌশলী ছেলে চুরি করতো ফুল৷ গ্রামে এসব চুরি কোন অপরাধ নয়। 

আমাদের শৈশবের সময় গুলি এভাবেই রঙিন অনূভুতি দান করতো আমাদের । আমাদের পূর্বসূরিরা ও এভাবেই দিন যাবন করতো হয়তো।  কিন্তু অভাগা এই সময়ের ছেলে মেয়েরা নিঃসন্দেহে গ্রামে কিংবা শহরে আমাদের মত এমন রঙিন দিন তারা শত চেষ্টা করলে ও পাবে না। আমি নিজেও খুব বেশী পাইনি। আমি বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই মধুময় দিনগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। আমি শুধু ইবতেদায়ী পযন্তই সেই দিনগুলো পেয়েছি। 

বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা  ঘুড়ি উড়ানোর স্বাদ পাবে না। আমাদের মত। 

স্বাদ পাবে না ঝড়ের মাঝে আম কুড়ানোর। বৈশাখের তপ্ত গরমে তেতুল দিয়ে কাঠালের মুচি ভর্তা খাওয়ার। 

কলা পাতায় খাবার খাওয়ার কিংবা খাদের কোমড় পর্যন্ত কাঁদাতে গিয়ে বাইম গুতুম শিং মাছ ধরার। 

এই প্রজন্মের সবাই স্বাদ খোঁজে   কৃত্রিমমতায়। এদের সুখ অনূভুতি ভিন্ন। কেউ ফোনে কিংবা অন্য ভাবে সুখ খোঁজে। কি পায় জানি না। তবে আমার আপনার শৈশবের সুখ স্মৃতির সাথে কোন ভাবেই তুলনা করা যায় না। 

আমাদের দিন গুলি আসলেই সোনার খাঁচায় বন্দি করার মত। আমাদের ঐ সব দিনরাত্রি ছিল আসলেই সৌভাগ্যের আর সৌরভ ময়। 

বেঁচে থাকুক আপনার /আমার/আমাদের হৃদয়ে হাজার বছর এই সোনালী দিনগুলি। ভালবাসার সহিত পরম যতনে। যেই মিষ্টি স্বাদযুক্ত বর্ণালি সময়গুলি স্মৃতির পাতায়। বেঁচে থাকুক।

    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *