পথ যেনো আজ শেষ হবার নাম-ই নেই। আজ নিত্যদিনের আসা-যাওয়ার পথটুকু বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে নীলিমার। পেটের ব্যাথায় বারবার সে কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। প্রতি মাসের অসুস্থতায় পেটের সাথে পাল্লা দিয়ে দু’পা আর মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে পেটের ক্ষুধা তো আছেই। শরীরের অবস্থা এতোটাই খারাপ আর বিধ্বস্ত যে হোস্টেলে ফিরে রান্না কিভাবে করবে সেটা ভাবতে গিয়েই চোখে পানি এসে যাচ্ছে বারবার।
নীলিমার পাশের রুমে থাকে রিমি আর তার পরের রুমটিতে থাকে মিতা। রিমি আর নীলিমা সেম ইয়ারে হলেও তাদের সাবজেক্ট আলাদা। মিতা তাদের টু ইয়ার সিনিয়র। মিতা বেশ অমায়িক এবং বন্ধুসুলভ। কিন্তু রিমি একদমই আলাদা। সে খুবই গম্ভীর এবং চুপচাপ। এমনকি থাকেও সবকিছু থেকে নিজের মতো এবং আলাদা। নীলিমা আর মিতা তার সাথে সহজ হবার চেষ্টা করলেও কখনোই রিমির দিক থেকে সাড়া আসেনি। বলতে গেলে সে নিজের মতো একা থাকতেই ভালোবাসে কারও সঙ্গ ছাড়া। পুরোপুরি নিজের মতো নিজের জগতে যেখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। কোনো কথা জিজ্ঞেস করলেও যদি প্রয়োজন মনে করে তো গোমড়া মুখেই ছোট্ট করে উত্তর দেয়। নীলিমা আর মিতা তাদের রান্না এবং খাওয়া একসঙ্গে করলেও রিমি নিজের রান্না, খাওয়া সব একাই করে। রিমির স্বভাবের কারণে তাই নীলিমা আর মিতাও তাকে বিরক্ত করে না। তবে কোনো সমস্যা হলে যেনো কখনো কোনো সংকোচ না করে তাদের বলতে, তা বলেছে। মিতা আর নীলিমার বেশ সখ্যতা। এই যেমন, মিতা থাকলে হয়তো আজ রাতে তাদের দু’জনের রান্না নীলিমার করবার কথা থাকলেও তার এই শারীরিক অসুস্থতায় মিতা নিজ থেকেই তাকে রান্না করতে দিতো না। কিন্তু মিতা আজ পারিবারিক একটি বিশেষ প্রয়োজনে সকালেই তার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই হোস্টেলে ফিরে দরজায় নক করলে রিমি এসে দরজা খুলে দিয়ে সোজা তার রুমে চলে গেলো। নীলিমাও তার টেবিলে ব্যাগ রেখে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। যাবার আগে রিমিকে জিজ্ঞেস করলো –
“রিমি, আমি গোসল করতে যাবো। ফ্রেশ হয়ে বের হতে আমার একটু সময় লাগবে। তোমার কোনো অসুবিধে নেই তো?”
রিমি দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে নেই জানালো। নীলিমাও আলতো হেসে “ঠিক আছে” বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে তার টেবিলে চোখ যেতেই চমকে গেলো। কাছে গিয়ে দেখলো সেখানে একটি খাবার প্লেট আরেকটি প্লেট দিয়ে ঢেকে রাখা। প্লেটের উপর ছোট্ট একটি চিরকুট আর তার পাশেই পানি এবং একটি পেইন কিলারের পাতা। ঢেকে রাখা প্লেটটি উল্টে দেখলো তাতে নরম করে রান্না করা খিচুড়ি আর সেদ্ধ ডিম রাখা আছে। নীলিমা খাবারের প্লেটটি আবার ঢেকে রেখে চিরকুটটা খুললো। দেখলো তাতে লিখা আছে-
“খেয়ে নিও। পাশেই পেইন কিলার রাখা আছে। প্রয়োজন মনে হলে খাওয়ার পর খেয়ে নিও। ব্যাথা কিছুটা কমতে পারে।”
নীলিমা যারপরনাই অবাক হলো। কারণ মিতা আজ সেই সকালেই তার বাড়ি চলে গেছে। তাহলে অবশ্যই এসব রিমি করেছে যা সে ভাবতেই পারছে না! নীলিমা চিরকুটটা হাতে নিয়েই রিমির রুমের দরজার দিকে তাকালো। দেখলো দরজা খোলা। সে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো দু’হাতে বই জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হয়তো চোখে তার ঘুমও চলে এসেছে। রিমির দিকে তাকিয়ে থেকে নীলিমার মুখ এবং মন অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো! কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে উঠলো। সে এটা বুঝতে পারলো আমরা সবসময় মানুষকে দেখে যেমনটা বিচার করি তা সবসময়ই ঠিক নয়। কারও কারও কাঠিন্য এবং গাম্ভীর্যের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে তার আবেগ, অনুভূতি, মায়া এবং ভালোবাসা। কেউ হয়তো প্রকাশ করতে পারে না আর কেউ হয়তো তা নিজ থেকেই লুকিয়ে রাখে। আবার কেউ হয়তো নিজেই বুঝতে পারে না তার কাঠিন্য এবং গাম্ভীর্যের আড়ালে থাকা মায়া আর ভালোবাসাকে। রিমির ক্ষেত্রে হয়তো তার ভেতর কোনোটি। তা না হলে সে রিমিকে কিছু বলা ছাড়াই রিমি তার শারীরিক কষ্ট কখনোই বুঝতে পারতো না। হয়তো তাকে দেখে অথবা ওয়াশরুমে গিয়ে ধারণা করতে পেরেছে। কিন্তু তা তার কাঠিন্য ভেদ করে তার যত্নশীল মনকে প্রকাশ করেছে। প্রকাশ্যে এনেছে সত্যিকারের রিমিকে যাকে তারা হয়তো আগে চিনতে পারেনি। নীলিমা রিমিকে ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। সে মনেমনে ভাবলো-
“সরাসরি কিছু বললে চুপচাপ গম্ভীর মেয়েটা হয়তো নিজেই সংকোচে পড়ে যাতে পারে। থাকুক তবে কিছু মানুষের কিছু অনুভূতি এভাবেই লুকোনো! আমরা সেই বিপরীত মানুষটির কাঠিন্যর আড়ালে ভালোবাসা আর যত্নশীল মনকে বুঝে গেলেও তাকে আর তা বুঝতে না দেই! যদি বুঝতে দিলে তারা হারিয়ে যায় অথবা নিজেরাই লজ্জা কিংবা সংকোচে পড়ে যায়! তবে একটা ছোট্ট করে ধন্যবাদ তো দেয়াই যায়!”
কথাগুলো আপনমনে বলে নীলিমা চিরকুটটির উল্টোদিকে শুধু লিখলো-
“অনেক ধন্যবাদ রিমি। ভালোবাসা নিও।”
লিখে গুটিগুটি পা’য়ে গিয়ে রিমির জড়িয়ে থাকা বইটির উপর চিরকুটটি রাখলো। আবার একবার তার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসলো। এর মধ্যেই রিমি হালকা নড়ে উঠলে নীলিমা তাড়াতাড়ি তার রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রিমি তার বইয়ের উপর রাখা চিরকুটটি পড়ে আবার পাশ ফিরলো। সেদিকে ফিরে থাকা তার হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত অমায়িক মুখটি কিন্তু নীলিমার অজানাই থাকলো!